কোটি টাকার ‘দুর্নীতি’তে দুই খাদ্য কর্মকর্তা
রাজশাহীর তানোর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক এবং সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, এলএসডি) তারিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতর অভিযোগ উঠেছে। এ দুই খাদ্য কর্মকর্তা মিলেমিশে ছয় মাসের মধ্যে প্রায় কোটি টাকা হতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে তোলপাড়।
তাদের এমন অনিয়ম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নজরে এলে গত ৩১ ডিসেম্বর উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় তারা উত্থাপন করেন। কলমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার ময়না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শওকত আলীর কাছে বিষয়টি তদন্তেরও দাবি জানান। এসব বিষয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকেও অবহিত করা হয়েছে।
তানোরের ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, সম্প্রতি ভিজিডি (ভার্নেবল গ্রান্ড ফিডিং) চাল সরবরাহের জন্য উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটির জন্য তানোর সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারিকুজ্জামানকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) দেওয়া হয়। এ পরিমাণ ডিওর বিপরীতে মোট ৫০ টন ভিজিডি চাল সরবরাহ করেন তিনি। ভিজিডির বিধিমালা অনুযায়ী সেদ্ধ চাল সরবরাহের কথা। কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ করা হয়েছে আতপ চাল।
সরকার নির্ধারিত সেদ্ধ চালের মূল্য কেজিপ্রতি ৩৯ টাকা। আর আতপ চালের কেজি ৩০ টাকা। ফলে প্রতিকেজি চালে ৯ টাকা করে খাদ্য কর্মকর্তা এবং উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা আত্মসাৎ বলে অভিযোগ উঠেছে।
চলতি মৌসুমে বোরো চাল সংগ্রহেও অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বোরো চাল সংগ্রহ অভিযোনের মোট ৪২৩ টন চালই ওএমএস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয় জুলাই থেকে। শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। আর ওএমএস সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়। শেষ হয় ১৫ ডিসেম্বর। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওএমএস চাল বোরো সংগ্রহ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এছাড়া কিছু আতপ চালও বোরো চালের খামালে রাখা হয়েছে। এসব ওএমএস চাল ডিলারদের কাছ থেকে কেনেননি গুদাম কর্মকর্তা তারিকুজ্জামান। এছাড়া সরকারের ইপি (এসেনশিয়াল প্রায়োরিটি)’র ডিও এর চালও তারিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে কেনার অভিযোগ রয়েছে। এসব চালও বোরো সংগ্রহ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ওএমএস চাল ডিলাররা সরকার নির্ধারিত দামে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করেন ৩০ টাকায়। কিন্তু তারিকুজ্জামান ডিলারদের কাছ থেকে কিনেছেন কেজিপ্রতি ৩১ টাকায়। আর বোরো চাল কেজিপ্রতি সরকারের নির্ধারিত দাম ছিলো ৩৪ টাকা। এর মধ্যে শ্রমিক, রাইস মিলের মালিক ও দাপ্তরিক খরচ বাবদ আরো দেড় টাকা ব্যয় করেন তিনি। ফলে প্রতিকেজি চালে দেড় টাকা লাভ করে এ দুই খাদ্য কর্মকর্তা প্রায় ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে চাল সঙ্কটের সময়ে সরকার তিন লাখ টন আতপ চাল বিদেশ থেকে আমদানি করে। এ চালের মধ্যে তানোর খাদ্য গুদামে ১২০ টন মজুদ করা হয়। আমদানিকৃত চাল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলতি ওএমএস মৌসুমে সরবরাহ করে সরকার। এসব চাল ডিলারদের কাছে সরবরাহও করা হয়। কিন্তু পরে সেগুলোই আবার চাল ডিলারদের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। এরপর তা বোরো চালের খামালের ভেতরে রেখে বোরো সংগ্রহ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, গুদামের ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তাকে একাজে সহযোগিতা করেছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক।
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে আমন চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা সংগ্রহ শুরুর আগেই আমন চাল নিজ গুদামসহ চাল ব্যবসায়ীদের কাছে সংরক্ষণ করেছেন। এ গুদামে চলতি আমন মৌসুমে ৪২২ টান চাল সংগ্রহের নির্দেশনা থাকলেও পরে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৯২২ টন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ টন নতুন ধানের আর বাকি চাল পুরনো বোরো মৌসুমের হাইব্রিড এবং অটোরাইস মিলের বাছাইয়ের উচ্ছিষ্ট চাল কিনে গুদাম ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অথচ নীতিমালা অনুযায়ী নতুন চাল কেনার নিয়ম। কিন্তু নিয়ম ভেঙে পুরাতন চাল কিনছেন ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা। এর সঙ্গেও সম্পৃক্ত আছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৫ দিন পর গুদাম পরিদর্শন করার কথা থাকলেও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তা করেন না। কারণ তিনিও নিয়ম ভেঙে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারিকুজ্জামানের আবাসিক কোয়ার্টারে বসবাস করেন। নেন আর্থিক সুবিধাও।
অপরদিকে তানোর খাদ্য গুদামের সাথে চারজন মিল মালিক আমন চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মিল মালিকদের চাল নিজেই সরবরাহ করছেন ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা তারিকুুজ্জামান। তার বাড়ি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুরে। এর পাশেই নওগাঁ। এসব এলাকা থেকে তার বিরুদ্ধে চাল কেনার অভিযোগ রয়েছে।
এই কর্মকর্তা এর আগে বগুড়ায় দুপচাঁচিয়ায় এবং রাজশাহীর পুঠিয়ায় ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু এসময় নানান অভিযোগ উত্থাপিত এবং তা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ওই দুটি খাদ্য গুদাম থেকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রত্যাহার করা হয়।
নতুন আমন চাল সংগ্রহে সরকারের নির্ধারিত দাম ৩৯ টাকা। কিন্তু আমন না নিয়ে বোরো জাতের হাইব্রিড পুরাতন চাল গুদামে ঢোকানো হয়েছে। আর পুরাতন চাল বাইরে থেকে কেনা হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৪ টাকায়। প্রতিকেজিতে ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা এবং মিল মালিক ৫ থেকে ৭ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রায় ৯০০ টন চালে চলতি মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তানোরের কয়েকজন মিল মালিক জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক বলেন, ‘আমি কোন অনিয়ম বা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত নই। আর গুদামে পুরাতন চাল কেনা হয়েছে কি না দেখার দায়িত্ব খাদ্য বিভাগের টেকনিক্যাল টিমের। সবকিছু দেখভালের সার্বিক দায়িত্ব খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার। অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আসছে কেন- তা মাথায় ঢুকছে না।’ তবে তিনি ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার আবাসিক কোয়ার্টারে রাতে অবস্থান করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
জানতে চাইলে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারিকুজ্জামান বলেন, তানোরে যোগদানের পর তিনি গুদামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন। তাই সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ছড়াচ্ছে। বাস্তবে এসবের কোন ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবকিছু মনিটরিং করেন। অনিয়ম করার কোন সুযোগও নেই।’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
টাঙ্গাইলে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ হাসান ঝলককে বাড়ি থেকে ডেকেবিস্তারিত পড়ুন
সন্ত্রাসী হামলায় আইনজীবী আহত
নিজস্ব সংবাদদাতা : কোর্টে বিরোধীদলীয় মামলা পরিচালনা করার কারনে সন্ত্রাসীবিস্তারিত পড়ুন
ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি: জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিগত ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেবিস্তারিত পড়ুন