পুরনো জাহাজ কিনছে ১৫৬ কোটি টাকায়
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে সাড়ে ৮ বছর বয়সী একটি তেলবাহী জাহাজ কিনতে যাচ্ছে বিএসসি (বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন)। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়াই সংস্থাটি ১৫৬ কোটি টাকায় লাইটারেজ ট্যাংকারটি কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে এনেছে। এমটি পুলি নামের জাহাজটি কাক্সিক্ষত দামের চেয়ে বেশি অর্থে কেনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আফরোজ শিপিং লাইনকে কার্যাদেশও (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড ) দিয়েছে বিএসসি। পুরো ক্রয় প্রক্রিয়ার নেপথ্যে বড় অংকের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, বিএসসির জন্য পুরনো জাহাজটি কেনার লক্ষ্যে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়। ১২ আগস্ট কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। অনুমোদন না দিয়ে সংশোধনীসহ পুনরায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তাবটি বৈঠক থেকে ফেরত পাঠানো হয়। বৈঠকের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি লিখে দেন ‘পুরাতন কেন ক্রয় করা হবে? নতুন কিনতে হবে।’ মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের সারসংক্ষেপেও একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি নৌ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েও দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত পারচেজ কমিটির পরবর্তী বৈঠকে জাহাজ কেনার প্রস্তাবটি সংশোধনীসহ উপস্থাপন করা হয়। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি নীতিগত অনুমোদন (প্রত্যাশা অনুমোদন) দেয়। এ বৈঠকের সারসংক্ষেপও অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। এতে সপ্তম আলোচ্যসূচি ছিল জাহাজ ক্রয় সংক্রান্ত প্রস্তাবটি। ‘আলোচ্য বিষয় … ৭ অনুমোদনযোগ্য নয়’ বলে সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রী। ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্তের নথিতে স্বাক্ষর করেন। একই দিনে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে বিষয় জানিয়ে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এদিকে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই ১৯ আগস্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আফরোজ শিপিং লাইনকে জাহাজ সরবরাহের কার্যাদেশ দেয় বিএসসি। ২৫ আগস্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম নির্দেশ উপেক্ষা এবং দ্বিতীয় নির্দেশ হাতে পাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ম হচ্ছে, চূড়ান্ত অনুুমোদন পাওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিতে হয়। এক্ষেত্রে তা লংঘন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিএসসির পুরনো জাহাজ কেনার কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, বিষয়টি বিএসসির দোষ নয়। এমটি পুলি জাহাজটির দরপত্রের বৈধতার মেয়াদ ২২ আগস্ট শেষ দিন ছিল। ওই জাহাজ ক্রয়ে ১৯ আগস্ট সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রত্যাশা অনুমোদন চাওয়া হয়। প্রত্যাশা অনুমোদনের অর্থ হচ্ছে- আমরা আশা করতে পারি এটি অনুমোদন পাব।
প্রত্যাশা অনুমোদন পাওয়ায় বিএসসি জাহাজটি ক্রয়ে কার্যাদেশ দিয়েছে। তিনি বলেন, পরবর্তীতে যখন আমরা জানলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরনো জাহাজ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করেননি। তিনি পুরাতন নয়, নতুন জাহাজ কিনতে বলেছেন। এরপর থেকে আমরা পুরনো জাহাজ কেনার বিষয়ে আর এগোচ্ছি না। মন্ত্রী বলেন, কার্যাদেশ দেয়ার ঘটনায় একটা ভুল ধারণা হতে পারে। আমরা কিছু গোপন করিনি। আমরা কোনো অন্যায় করিনি। কার্যাদেশ দেয়ায় জটিলতা সৃষ্টির আশংকা করে তিনি বলেন, এতে একটা অসুবিধা হতে পারে। বিষয়টি যে কি হবে তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একই প্রশ্নের জবাবে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, পুরনো জাহাজ কেনায় প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি নৌ মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে। আর নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড দেয়া হলেও তা বাতিলের সুযোগ রয়েছে। এটি ক্রয় প্রক্রিয়ার একটি ধাপ। এখনও অনেক ধাপ বাকি রয়েছে।
এদিকে কার্যাদেশ পাওয়ার পর পুরনো এ জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল হলে ক্ষতিপূর চেয়ে মামলা দায়েরের হুমকি দিয়েছেন তুরস্কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্যামলিকা শিপিংয়ের বাংলাদেশীয় এজেন্ট মেসার্স আফরোজ শিপিং লাইন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মমিনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, শিপিং কর্পোরেশন থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছুই তাদের জানানো হয়নি। কার্যাদেশ বাতিল হলে তারা বিএসসির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন ।
সূত্র জানায়, কার্যাদেশ দেয়ার পর পুরনো জাহাজ ক্রয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার করতে ২৭ আগস্ট বিএসসির ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ফ্যাক্সে (ফ্যাক্স নম্বর ৯৫৬৫৫৮৯) একটি সারসংক্ষেপ নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই সারসংক্ষেপের কপি কাছে এসে পৌঁছেছে। এতে পুরনো জাহাজ কেনার যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ঢাকায় বিএসসির আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। সেখান থেকে কোনো সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে কিনা- সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম নিয়ে থাকে। এতে আমার কিছু করণীয় থাকে না।
অভিযোগ উঠেছে, ৮ বছর ৮ মাসের পুরনো এ জাহাজটি বেশি দামে কেনা হচ্ছে। মেরিন ট্রাফিক নামের আন্তর্জাতিক এক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, এমটি পুলি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তৈরি হয়েছে। এর আইএমও নম্বর ৯৩৩০৪৩৪। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৪৮ মিটার ও প্রস্থ ২২ মিটার। এর ধারণ ক্ষমতা (ডব্লিউটি) ১৫ হাজার ৮৫৭ টন। এটি মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ বলে ওই ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর এক ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, এ জাহাজটি বিক্রির জন্য এর আগেও বিজ্ঞাপন দেয়া হয়।
ওই বিজ্ঞাপনে জাহাজটির সম্ভাব্য দাম চাওয়া হয় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় ১১০ কোটি টাকা। অথচ একই জাহাজ ১২৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায় কিনতে যাচ্ছে বিএসসি। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১৫৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুরনো জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি খরচ নতুন জাহাজের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া এ জাহাজটি সর্বোচ্চ ২০ বছর বাংলাদেশের জলসীমায় চলতে পারবে। পুরনো জাহাজের কার্যক্ষমতা কম থাকে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন জাহাজ কেনা হলে এসব ঝক্কি-ঝামেলা থাকে না। কিন্তু বিএসসি রহস্যজনক কারণে বর্তমানে পুরনো জাহাজ দুটি বাদ দিয়ে আরও একটি পুরনো জাহাজই কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে যচ্ছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিবহন ও লাইটারেজ করার জন্য মূলত এমটি পুলি নামের এ তেলবাহী জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বহির্নোঙ্গর পর্যন্ত আসে। সেখান থেকে বিএসসির ২৭ বছরের পুরনো লাইটারেজ জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভে এ তেল চট্টগ্রামের রিফাইনারি জেটিতে নিয়ে আসা হয়। একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয় ও শিপিং কর্পোরেশনের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার পুরনো এ জাহাজ কেনায় বিশেষ আগ্রহ দেখা গেছে। অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা একাধিক কর্মকর্তা এ জাহাজ কেনার বিষয়ে তদবির করতে ঘন ঘন মন্ত্রণালয়ে আসা-যাওয়া করেন বলেও জানান তারা।
জানা গেছে এমটি বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ জাহাজ দুটি সিঙ্গেল হাল বিশিষ্ট। আইএমও বিধি অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে সিঙ্গেল হাল বিশিষ্ট জাহাজে যে কোনো প্রকার তেল পরিবহন নিষিদ্ধ। বয়সের কারণে জাহাজ দুটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অনেক বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে কর্ণফুলী চ্যানেলে স্রোতের প্রতিকূলে জাহাজ দুটি দুই নটের বেশি গতিতে চলতে পারে না।
এ অবস্থায় জাহাজ দুটিতে ক্রুড অয়েল লাইটারিং করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র দেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় চারটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নেয়। এখান থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে একটি আফরোজ শিপিং লাইন এবং অপরটি হচ্ছে ওভারসিজ মার্কেটিং কর্পোরেশন। দুই প্রতিষ্ঠানের দুটি জাহাজ সরেজমিন পরিদর্শন এবং কারিগরি মূল্যায়ন শেষে আফরোজ শিপিং লাইনের জাহাজ এমটি পুলিকে চূড়ান্ত করা হয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
দেশে রোলস রয়েস ১২টি, ছয় মাসে এসেছে আটটি
বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত গাড়ি বলা হয় রোলস রয়েসকে। তবে একটাবিস্তারিত পড়ুন
শফিকুল আলম: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু ইস্যু অন্যায্যভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুবিস্তারিত পড়ুন
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিলো হিন্দু, বৌদ্ধ -খ্রিষ্টান ছাত্র যুব ফ্রন্ট
ভারতের বিরুদ্ধে সনাতন ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা ও ধর্মীয়বিস্তারিত পড়ুন