অজ্ঞাত রোগে এক পরিবারের চারজনের মৃত্যু, পঙ্গু আরও ১০
পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪। এদের মধ্যে অজ্ঞাত রোগে ইতোমধ্যেই চার জন মারা গেছেন। বাকি ১০ জনের মধ্যে সবাই আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে জীবন যাপন করছেন। ৩১ বছর আগে হঠাৎ গৃহবধূর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই পরিবারে দুঃসময় শুরু হয়। জমি-জমা যা ছিল সব বিক্রি করে চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করলেও অজ্ঞাত রোগ থেকে মুক্তি মেলেনি। যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের জীবন চলছে এখন অনাহারে-অর্ধাহারে।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মৃত আলতামুদ্দিনের পরিবারের কথাই বলছিলাম এখানে।
পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আলতামুদ্দিনের ছিল সুখের সংসার। নিজেদের জমিজমা আবাদ করে দিব্যি সংসার চলছিল। ছিল গোয়াল ভরা গরু। জোয়ান ছেলেরা সবাই চিল কর্মঠ। কৃষি কাজ, গরুর গাড়ি চালানো, কাঠকাটা, গ্রামের বিভিন্ন মেলায় মিষ্টির দোকান দিয়ে ব্যবসা করে বেশ ভালোভাবেই সংসার চলছিল। রসগোল্লা, চমচম ও জিলাপীসহ হরেক রকমের মিষ্টি জাতীয় খাবার রান্নায় পুরো পরিবার ছিল সিদ্ধহস্ত।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামে গ্রামে নতুন ধান উঠা শুরু হলেই পুরো গ্রাম-বাংলায় শুরু হতো নব্বান্ন উৎসব। এই সময় মানুষের হাতে থাকতো পয়সা-ধান। টানা দুই মাস ওইসব মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য সামগ্রীর ঝুড়ি (বাইক) নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে আয় করতেন মোটা অংকের অর্থ। গায়ের শিশু-বৃদ্ধ-বধূরা নতুন ধানের বিনিময়ে রাখতেন এসব মিষ্টি সামগ্রী। এ সময় আলতামুদ্দিনের পুরো পরিবার ব্যবসার পাশাপাশি নিজেরাও মেতে থাকতেন উৎসবে। এই পরিবারের জন্য এসব এখন শুধুই স্মৃতি।
যেভাবে রোগের শুরু:
১৯৯৬ সালে হঠাৎ এক অজ্ঞাত রোগে মারা যান আলতামুদ্দিনের বড় ছেলে জামাল উদ্দিন। এর ১১ বছর আগে মারা যান তার মা ভানু বিবি। ভানু বিবির মৃত্যুকে অনেকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলেও তার বড় ছেলের মৃত্যুকে পরিবারের সদস্যরা এবং গ্রামের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। ছেলের মৃত্যুর পর পরই আলতামুদ্দিন নিজে আক্রান্ত হয়ে বিছনায় পড়ে যান। প্রায় দুই বছর ঘরে পড়েছিল আলতামুদ্দিন। অবশেষে ১৯৯৮ সালে আলতামুদ্দিন মারা যান।
আলতামুদ্দিনের মৃত্যুর পর পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যরাও একে একে সেই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন। কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। সেই একই কায়দায়। রোগের লক্ষণটি এমন- আক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ করে আক্রান্ত ব্যক্তি হাত বা পায়ের জোর হারিয়ে ফেলেন। এক পর্যায়ে সে বিছানায় পড়ে যায়। আস্তে আস্তে মৃত্যুর মুখে পড়ে যায়। আলতামুদ্দিনের মৃত্যুর পর তার ছেলের ঘরের নাতি সুমি আক্তার অজ্ঞাত রোগে মারা যায়।
দুই বছরের সন্তান সুমিকে হারিয়ে এবং মৃত্যুভয়ে জামালের স্ত্রী স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। চিকিৎসাও হয়েছে অনেক তবে রোগ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু একে একে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সেই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হতে থাকে।
আলতামুদ্দিনের তৃতীয় ছেলে আনছার আলী (৭০) এবং তার ছেলে মনোয়ার হোসেন (৩২), আলতামুদ্দিনের চতুর্থ ছেলে হেকমত আলী (৪৭) এবং তার ছেলে জহিরুল (১৬), আলতামুদ্দিনের ছোট ছেলে বাবলু (২৭) এবং বাবলু ছোট ছেলে জাহিদুল (৮) এখন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অচল হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কাজ কর্ম করে খাওয়া তো দূরের কথা এদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
মৃত্যু ভয়ে আলতামুদ্দিনের দ্বিতীয় ছেলে মো. আব্দুল রহমান (রহম) একটু দুরে গিয়ে বাড়ি করলেও তার দুই মেয়ে রিনা আক্তার (২০) ও রুমা আক্তার (১৮) এখন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।
নিজের পরিবারের সদস্যদের একই রোগে চোখে সামনে মারা যেতে দেখে আনছারের স্ত্রী ময়ুর জান (৬০) প্রায় পাগল হয়ে ঘর ছেড়েছেন। সে এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ান। তাতেও তার রেহাই মেলেনি, সম্প্রতি তিনিও এই রোগে আক্রান্ত। কথা হয় ময়ুর জানের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমে আমার স্বামী, দেবর ও ছেলেরা ভালই ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। এরপর অনেক চিকিৎসা করানো হলেও তারা কেউ সুস্থ হয়নি।
তিনি বলেন, এই রোগে আমার ছোট দেবর হেকমত আলী অসুস্থ্য হয়ে ঘরে পড়ে গেলে তার স্ত্রী জহুরা পাগল হয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়। এখন জহুরার এক ছেলে আমার কাছে থাকে আর অপর জন নানার বাড়িতে থাকে। তারা দুজনই এই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
ময়ুর জান আরো বলেন, এই রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে জমি জমা যা ছিল সবই শেষ হয়েছে। আয়ের কোন পথ এখন নেই। আয় রোজগার করার মত মানুষ নেই। এই রোগে আক্রান্ত হবার পর আমাদের কেউ খোঁজ খবরও নেয়নি।
ময়ুর জান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আপনারা কিছু একটা করেন, যাতে সরকার আমাদের দিকে তাকায়। আমার স্বামী-সন্তান-দেবর-ভাতিজাদের একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। হুনছি আমাগো মানিকগঞ্জে মন্ত্রী আছে। আমরা তো তার কাছে যাইতে পারুম না। আপনারা কিছু করলে আমাগো উপকার অইবো। চোখের সামনে সবকিছু শেষ হয়ে যাইতেছে, আর সহ্য করতে পারতাছি না।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই পরিবারের চেয়ে আর কোন অসহায় পরিবার অত্র এলাকায় নেই। আমি নতুন নির্বাচিত হয়েছি। এ ব্যাপারে যতদূর সম্ভব আমি তাদের জন্য করবো।’
এ ব্যাপারে শিবালয় উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আকবর বলেন, ‘এমন খবর আমার জানা ছিল না। আমি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের লোক পাঠিয়ে অসহায় পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।’
অজ্ঞাত রোগে একটি পরিবারের শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মানিকগঞ্জ ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। হাসপাতালের চেয়ারম্যান এস. এম রইসউদ্দিন বলেন, ‘এটি একটি মানবিক বিষয়। আমরা এই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত সকলকে এনে বিনা খরচে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে সুচিকিৎসা করানোর সব ব্যবস্থা করাবো।’
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. ইমরান আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার একেবারেই অজানা। আমি বৃহস্পতিবার একটি টিম পাঠিয়ে তাদের খোঁজ নিব। অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত এমন পরিবার যদি থাকে, আমি তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক ব্যবস্থা নিব। তিনি দ্রুত অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত ওই পরিবারের সদস্যদের তার সাথে যোগাযোগ করার কথা বলেন।’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ডিএমপি: ৫ আগস্ট পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. সারোয়ার জাহানবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
নারায়নগঞ্জে কোটা আন্দোলনকারীর উপর আক্রমন
নিজস্ব প্রতিবেদক : নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী সংগঠকবিস্তারিত পড়ুন