আগুনে বসুন্ধরায় ১০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত
রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে আবারো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল রোববার বেলা সোয়া ১১টায় মলের ষষ্ঠ তলায় একটি জুতার দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট একযোগে প্রায় ১০ ঘণ্টা চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে এ ভবনটিতে চতুর্থ দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
আগুনের সময় অনেকেই ভবনে ও ছাদে আটকা পড়লেও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের নিরাপদে উদ্ধার করেন। তবে জুতায় আগুন জ্বলতে সহায়তাকারী দাহ্যপদার্থ থাকায় আগুনের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দিকে আগুনের সময় শপিংমলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুল পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল দেয়। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা জানিয়েছেন, শপিংমলের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তা ছাড়া ভবনটি কাচ দিয়ে ঘেরা থাকায় ধোঁয়া বের হতে পারেনি, যার কারণে অক্সিজেন মাক্স পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে করেছেন তারা। অবশ্য পরে ভবনের বিভিন্ন তলার কাচের গ্লাস ভেঙে দেয়া হয় ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য। এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ এ শপিং কমপ্লেক্সে লাগোয়া দু’টি ভবন রয়েছে। এর পান্থপথ সড়কমুখী আট তলা ভবন এবং পেছনের ১৯ তলা ভবন। গতকাল রোববার সকালে শপিংমলের দোকানগুলো একে একে খুলতে শুরু করে। তখনো ক্রেতাদের ভিড় জমতে শুরু করেনি।
আগুনের সূত্রপাত হওয়া লেভেল-৬-এর ৬০ নম্বর দোকানের পাশের ৫৯ নম্বর দোকানের মালিক তানভির জানান, বেলা সোয়া ১১টায় তিনি ব্যাংকে যাবেন বলে ক্যাশ থেকে টাকা বের করে গুনছিলেন। এ সময় তার পাশের দোকানের গোডাউনে (মূল দোকানের সাথে লাগানো বোর্ড দিয়ে পার্টিশন করা) একটি শব্দ হয়। তিনি সেলসম্যানকে বলেন, ‘কী হয়েছে দেখো তো, ভূমিকম্প শুরু হলো কি না’। সেলসম্যান দোকান থেকে বের হয়েই চিৎকার দিয়ে বলে ‘বস পাশের দোকানে আগুন লাগছে’। আমি তাড়াতাড়ি ওই দোকানে গিয়ে চিৎকার করে বললাম, চাচা আপনার দোকানে আগুন লাগছে। এরপর নাইট্রোজেন গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নিজের দোকান সেভ করতে ছিটাতে শুরু করলাম। কিছু সময়ের মধ্যে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের লোকজন এসে বলল, ‘আপনারা চলে যান আমরা দেখছি’। তারপরও নিজের দোকান ছেড়ে যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে সেখানে দাঁড়াতে পারিনি। তানভির বলেন, তার দোকানে জুতা ও ব্যাগসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার মাল রয়েছে। মূল্যবান কাগজপত্র, গাড়ির চাবি, নগদটাকাসহ কিছুই বের করতে পারিনি। তার মতে, যে গোডাউনে আগুন লেগেছে সেটি ৬০ নম্বর স্মার্ট নামক দোকান। তবে ওই দোকানের মালিকের নাম বলতে পারেননি তিনি।
এ দিকে আগুন লাগার কিছু সময়ের মধ্যে মলের সাইরেন বাজতে শুরু করে। এ সময় অন্য দোকানদার ও ক্রেতারা ভয়ে ভবন থেকে বের হতে শুরু করেন। এ দিকে জুতার দোকান থেকে ধোঁয়ার সাথে সাথে আগুনের কুণ্ডলী বের হতে শুরু করে। এ সময় শপিংমলের নিরাপত্তাকর্মীরা ভবনের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুন তাদের ব্যর্থ করে দিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হলে প্রাথমে আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতার কারণে সর্বশেষ ২৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। মাঝপথে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো থেকে পানি শেষ হয়ে গেলেও পরে নতুন করে কাজ শুরু করে তারা। আগুনের কারণে শপিংমলের দোকানব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বের হতে পারলেও ১১ জন বের হতে পারেননি। তারা কেউ কেউ ভবনের ছাদে চলে যান। পরে ফায়ার সার্ভিস এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) ব্যবহার করে তাদের নামিয়ে আনে। বেলা ১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান সাংবাদিকদের জানান, আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে অনেক দাহ্যপদার্থ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ডিডি) মিজানুর রহমান জানান, বসুন্ধরা সিটির দোকানগুলো তালাবদ্ধ থাকায় আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়ে। তালাবদ্ধ থাকায় আগুন দোকানের ওপর দিয়ে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে দোকানগুলোর তালা ভেঙে পানি দিতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ১৯ জনকে উদ্ধার করেছে। তাদের মধ্যে আটজনকে ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডার দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। আর ১১ জন নিজে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে একজন নারী। এ ছাড়া আহত একজনকে রেড ক্রিসেন্টের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, শুরুতে তারা ভবনের কাচ ভাঙার পরিকল্পনা নিয়ে গেলেও বসুন্ধরা সিটি কর্তৃপ ভাঙতে দেয়নি। কাচ ভাঙা গেলে ধোঁয়া বেরিয়ে পরিস্থিতি আরো দ্রুত উন্নতি হতো। অবশ্য পরে কাচ ভেঙে ধোঁয়া বের করে দেয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) আলী আহমদ খান জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে ঘটনাটি তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, শপিংমলে মোট ১১ জন আটকা পড়েছিলেন। এর মধ্যে প্রায় সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ হাসানসহ পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের দোকান মালিক, কর্মচারী, তাদের আত্মীয়-স্বজনসহ শত শত উৎসুক মানুষ জড়ো হন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বসুন্ধরা সিটি শপিংমলেই কেন বারবার আগুন লাগে। এ নিয়ে তিন তিন বার আগুন লাগল এই বসুন্ধরা সিটিতে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর এ বিষয়টি নিয়ে বসুন্ধরা সিটি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা হবে। রোববার বেলা সোয়া ১টায় ঘটনাস্থলে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের বরাদ দিয়ে তিনি জানান, আগুন লাগার পরপরই বসুন্ধরা সিটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিস তাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তার কথা হয়েছে। আগুন নেভানোর ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প থেকে ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানান মেয়র।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, পুরো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। বিপুল পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সূত্র মতে, ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ এই ভবনের ওপরের দিকে ভয়াবহ আগুনে সাতজনের মৃত্যু হয়, আহত হন শতাধিক। এরপর ওই বছরেরই আগস্টে এবং ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা সিটিতে আরো একবার অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের আগুন আয়ত্তে আনা হয়েছে। তবে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো সময় লাগবে। আগুনে প্রায় ১০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামী বুধবারের আগে বসুন্ধরা সিটি খোলা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আগুনের পরিধি এখন চার থেকে পাঁচটি দোকানের মধ্যে রয়েছে। এগুলো বেশির ভাগই জুতার দোকান। সেখানে রাবারও আছে। আগুনের ফলে জুতা ও রাবার গলে গিয়ে দরজা স্পর্শ করায় তা অনেকটা সিলগালার মতো হয়ে গেছে। তাই দরজা কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। বসুন্ধরা সিটির তত্ত্বাবধায়ক পিআইএম লতিফুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, এটা বড় ধরনের কোনো আগুন নয়। ছোট আগুন থেকে এ আগুনের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ১০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছয় থেকে সাতটি দোকান সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তারা মনে করছেন, আগামী বুধবারের আগে বসুন্ধরা সিটি খোলা সম্ভব হবে না। বসুন্ধরা সিটি মালিক সমিতির সভাপতি হান্নান আজাদ বলেন, প্রত্যেকটা দোকানে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপকবিস্তারিত পড়ুন
দুই দফা কমার পর ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম
টানা দুই দফা কমার পর দেশের বাজারে ফের স্বর্ণের দামবিস্তারিত পড়ুন
চট্টগ্রামে দুর্ঘটনার কবলে হাসনাত-সারজিসের বহরের গাড়ি
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে সড়কবিস্তারিত পড়ুন