আমাদের পৃথিবী বিলুপ্তির পথে, ঝুঁকিতে মানুষ
‘যদি মৌমাছিরা হারিয়ে যায় এই পৃথিবী থেকে, মানুষ তবে চার বছরের বেশি টিকে থাকতে পারবে না।’ আইনস্টাইন এমন মন্তব্য আদৌ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মৌমাছি না থাকলে (প্রকারান্তরে পরাগায়ন বন্ধ হয়ে গেলে) মানুষ যে খাবারের অভাবে বিপন্ন হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলে না, সে বিতর্ক নেইও।
তবুও মানুষ নাকি বিপন্ন হতে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, পৃথিবী যে পথে হাঁটছে, তাতে বিপদঘণ্টা বাজল বলে। মার্কিন গবেষকদের দাবি, পৃথিবী আরেকটি গণবিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে।
গবেষণা বলছে, এক সময়ের দাপুটে প্রাণী ডাইনোসর যেভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এ রকম গণবিলুপ্তির প্রথম শিকার হবে এই প্রতিবেদনটি যিনি লিখছেন আর যিনি এখন পড়ছেন— মানে আমি-আপনি পৃথিবীর সব মানুষ। সে রকমই বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন ও বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।
তাদের এই গবেষণা প্রকাশ করেছে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স এ্যাডভান্সেস।
সেখানে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পথে পৃথিবী। আর এই মহাবিপর্যয়ের প্রথম ও সবচেয়ে বেশি শিকার হবে মেরুদণ্ডী প্রাণী; আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে স্তন্যপায়ী (যেমন মানুষ) প্রাণীরা।
এদিকে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংঘ আইইউসিএনের বাংলাদেশী এক বন্যপ্রাণী গবেষক দ্য রিপোর্টকে বলছেন, বাংলাদেশে শতকরা ৩০ ভাগ বন্যপ্রাণী ঝুঁকিতে রয়েছে। জীবাশ্মলিপিতে বিপদের চিহ্ন। গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বিলুপ্ত হওয়ার হার ১১৪ গুণ বেশি।
গবেষক দলের প্রধান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী গেরার্ডো সেবালোস বলেছেন, ‘যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে জীবন স্থিতি হতে লাখ লাখ বছর লেগে যাবে। আর যথাসম্ভব আমাদের প্রজাতি (হোমো স্যাপিয়েন্স) নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে প্রথমেই।’
পৃথিবীতে এ রকম গণবিলুপ্তির ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছিল সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। বিশাল এক উল্কা আঘাত হেনেছিল পৃথিবীকে। আর তাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ডাইনোসররা।
তিন প্রজন্মের মধ্যেই মৌমাছির পরাগায়ন বলে কিছু থাকবে না— এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরাগায়ন বন্ধ মানে মানুষ শস্যশূন্য বা খাদ্যশূন্য হয়ে পড়বে।মেরুদ ণ্ডী প্রাণীরা কী হারে হারিয়ে যাচ্ছে তা জানার জন্য বিজ্ঞানীরা জীবাশ্মলিপি (ফসিল রেকর্ড) নিয়ে কাজ করেছেন। তারা দেখেছেন, পৃথিবী এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শতাধিক গুণ বেশি বিপন্নতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে চার শতাধিক মেরুদণ্ডী প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের সময় প্রতি ১০ হাজার বছরে একবার আসে। সায়েন্স এ্যাডভান্সেস সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও বন উজাড় করার কারণে এই গণবিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন, এ রকমটা চলতে থাকলে আগামী তিন প্রজন্মের মধ্যে মৌমাছির পরাগায়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল আরলিক বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী অনেক প্রজাতিই ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।’
সমূলে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে সবচেয়ে এগিয়ে লেমুর। ছবি : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। বাংলাদেশে বণ্যপ্রাণী ও বিলুপ্তির পথরেখা। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংঘ আইইউসিএন এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, প্রতি বছর ৫০ প্রাণী বিপন্ন হচ্ছে। ঝুঁকিতে প্রকৃকির মেরুদণ্ড শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইইউসিএন বলেছে, প্রায় ৪১ শতাংশ উভচর প্রাণী ও ২৫ ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী, সমূলে বিপন্ন হওয়ার সবচেয়ে ভয়ানক হুমকিতে রয়েছে লেমুর। সংস্থাটি বলছে, শতকরা ৯৪ ভাগ লেমুর জীবনই ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশে কোন কোন প্রাণী বিপন্নমুখী— এ নিয়ে কথা হয় আইইউসিএন বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপুর সঙ্গে। শনিবার বিকেলে দ্য রিপোর্টকে টেলিফোনে এই গবেষক বলেন, ‘বাংলাদেশে এক হাজারের মতো বন্যপ্রাণী রয়েছে। এদের শতকরা ৩০ ভাগ বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।’
খুব দ্রুতলয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিলুপ্ত হতে বসেছে শকুন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই বিলুপ্তি ঘটছে এই প্রাণীর। সীমান্ত দীপু বলেন, ‘উপমহাদেশে ৪ কোটি শকুনের মধ্যে এখন মাত্র ১০ হাজার রয়েছে। বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা মাত্র আড়াইশর মতো।’
নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে বাংলাদেশের শকুন। এই ছবিটি তুলেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. এম মনিরুল এইচ খান প্রাণী বিলুপ্তির কারণ হিসেবে মানুষের প্রভাবকেই দুষলেন আইইউসিএনের গবেষক সীমান্ত দীপু।
মৌলিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শন ছড়ানো ব্রত সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্টের অন্যতম জ্যেষ্ঠ এই বিজ্ঞানকর্মী বলেন, ‘আগেভাগে বন্যা, অতিখরা— জলবায়ু পরিবর্তনের খড়গ তো আছেই, তবে বাংলাদেশে মানুষ সৃষ্ট দুষণই বন্যপ্রাণী বিপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ।’
বাংলাদেশে প্রকৃতি সংরক্ষণে আইইউসিএন কী ভূমিকা রাখছে- এই প্রশ্নের জবাবে সীমান্ত দীপু বলেন, ‘দেখুন, আইইউসিএন মূলত নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সরকারকে প্রভাবিত ও সহযোগিতা করে থাকে। প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করে এমন এনজিও এবং সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করছি আমরা।’
প্রসঙ্গত, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী স্ট্রুয়াট পিম দাবি করেছিলেন, মানবজাতি ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে।
এমনকি পিমের গবেষণা বলেছিল, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিপন্ন হওয়ার হার এক হাজার গুণ বেশি। নতুন গবেষণা প্রবন্ধের লেখকরা অবশ্য বিপদ এড়ানোর একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘জীববৈচিত্র্যের নাটকীয় অবক্ষয়’ এড়াতে হলে সেভাবে প্রকৃতি সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগী হতে হবে।
তথ্যঋণ : সায়েন্স এ্যাডভান্সেস জার্নাল, বিবিসি।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন
কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারণায় বাজবে এ আর রহমানের গান
আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসেরবিস্তারিত পড়ুন
উপদেষ্টা আদিলুর: পূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেবিস্তারিত পড়ুন