আমার স্বামী পরকীয়া ও নির্যাতনে করে, আমি মুক্তি পেতে চাই!
রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের মহিলা অধিদপ্তরে প্রতিদিনই বেশ কিছু নারী আসেন। কারও সঙ্গে হয়তো থাকে ছোট সন্তান, কারও সঙ্গে কোনো অভিভাবক। তাদের মুখ মলিন, দুঃখ ও কষ্টের ছায়া পুরো অবয়বে।
তাদের কেউ এসেছেন স্বামীর পরকীয়া বা দ্বিতীয় বিয়ের প্রতিকার চেয়ে, কেউ এসেছেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অভিযোগকারী স্বামীর কাছে থেকে মুক্তি চান কিংবা ভরণপোষণের দাবি জানান।
মহিলা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিদিন পঁচিশটির মতো অভিযোগ আসে তাদের কাছে, যার বেশির ভাগ পরকীয়া-সংক্রান্ত।
কেস স্ট্যাডি: এক
পাপিয়া (ছদ্মনাম) বেগম। একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। মাস কয়েক আগে তার অজ্ঞাতে স্বামী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর গোপনে পাপিয়াকে তালাক দেন নজরুল।
হঠাৎ করে স্বামীর আচরণ ও চালচলনে পরিবর্তন দেখে পাপিয়ার সন্দেহ হয় এবং তিনি খোঁজ নিয়ে নজরুলের দ্বিতীয় বিয়ের খবর জানতে পারেন। হতাশা ও ক্ষোভে বিপর্যস্ত পাপিয়া একাধিকবার চেষ্টা চালান আত্মহত্যার।
মানসিকভাবে বিধ্বস্ত পাপিয়া ইস্কাটন গার্ডেনের মহিলা অধিদপ্তরে আসেন স্বামীকে ফিরে পেতে। মহিলা অধিদপ্তরে পাপিয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
চট্টগ্রামের পাপিয়া জানান, দুই বছর আগে একই জেলার নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। নজরুল একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। তাদের সংসারে এক বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। স্বামীর কাছে ফিরে যেতে না পারলে তার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নে্ই।
মহিলা অধিদপ্তরের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার কাছে নজরুলের স্ত্রীর অধিকার ফিরে পেতে আবেদন করেন পাপিয়া। তিনি ওই কর্মকর্তার কাছে জানান, নজরুলকে ফিরে না পেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।
ওই কর্মকর্তাকে পাপিয়া বলেন, “আমি বাঁচব না, আপা। নজরুলকে ফিরিয়ে দিন। ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে আমি একা কীভাবে বাঁচব।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলা অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, “পাপিয়া অভিযোগ দিয়েছে। আমরা ওর স্বামীকে নোটিশ করেছি। কিন্তু সে আসেনি। তাকে ফের নোটিশ করা হবে।”
নজরুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
কেস স্ট্যাডি: দুই
ছদ্মনাম মাশিয়া বীথি(২৭)। তিন সন্তানের জননী। থাকেন রাজধানীর বনশ্রীতে বাবার বাসায়। স্বামী মিশা রহমানের সংসার করতে চান না তিনি।
বীথির অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালে রাজধানীর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা মিশা রহমান সঙ্গে বিয়ে হয় বীথির। এক বছর পর তার কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান। এরপর থেকেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন বীথিকে ভিন্ন চোখে দেখতে থাকে। এর দুই বছর পর তার আরেক কন্যাসন্তান জন্ম হয়। এরপর তাকে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। শাশুড়িও তাকে নির্যাতন করেন। এরপর তার এক পুত্রসন্তান জন্ম হয়। কিন্তু থেমে থাকেনি নির্যাতন।
বীথির অভিযোগ, স্বামী মিশা মাদকাসক্ত। দুই মাস একসঙ্গে থাকে তো তিন মাস উধাও। কোথায় কী করে কেউ জানে না। তার কাছ থেকে ব্যবসার নামে ১০ লাখ টাকা নিয়ে সে টাকা খেয়ে ফেলেছে। কোনো কাজে আসেনি। বিয়ের ১০ বছর পার হলেও তিনি কোনো কাজে যোগ দেয়নি। বিথি বলেন, শাশুড়িও তাকে প্রচুর নির্যাতন করেছে। স্বামী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসারও অভিযোগ তার।
কিন্তু তার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাশুড়ি রহিলা রহমান। ঢাকাটাইমসকে তিনি অভিযোগ করেন, “বিথি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।”
মহিলা অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়ার পর দুই পক্ষকে ডেকে নারী নির্যাতন সেলের কর্মকর্তারা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তারা তিন মাস সময় দিয়েছেন বীথি ও মিশাকে। এর মধ্যে মিশা কাজ নেয়ার চেষ্টা করবেন। আর প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা তার মার কাছ থেকে এনে বীথিকে দেবেন সংসার চালানোর জন্য। তিন মাস পরে মিশা যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে আর কাজে যোগ দেয়, নতুন করে তারা সংসার করবে। আর না হলে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ হবে।
কেস স্ট্যাডি: তিন
ছদ্মনাম শাম্মী আক্তার (২৮)। বাড়ি ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। চার বছর আগে ঢাকার বাসিন্দা সাত্তারের সঙ্গে প্রেমের বিয়ে তার। শাম্মী ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। একটি চাকরিও করতেন। কিন্তু স্বামীর চাপে চাকরি ছাড়তে হয় তাকে। ঢাকার মীরবাগে তাদের আবাস। সেখানেই স্বামীর সঙ্গে থাকতেন তারা।
বিয়ের প্রথম তিন বছর ভালোই ছিল তাদের সংসার। অনেক দেশে ঘুরেছেন তারা। কিন্তু গত এক বছর ধরে তাদের মধ্যে অশান্তি চলছে।
শাম্মীর অভিযোগ, স্বামীর সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ। তার পরও ভালোবাসার টানে এত দিন সংসার করে আসছেন। কিন্তু এখন নির্যাতনের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে, কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।
ঢাকাটাইমসকে শাম্মী জানান, স্বামী তাকে ঘরে আটকে রাখতেন। মানসিক নির্যাতন করতেন। কিছুদিন আগে তাকে জোরপূর্বক ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। এখন তিনি বাবার বাড়িতে আছেন।
কেস স্ট্যাডি: চার
বরিশালের স্বরূপকাঠীর বিলকিসের (ছদ্মনাম) সঙ্গে জামালপুরের ছাদেকের বিয়ে হয় ২০১৪ সালে, গাজীপুরে। প্রেম করেই তারা বিয়ে করেন। বিলকিস একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। আর বাছেদ গাড়ি চালান। বিয়ের কয়েক মাস যেতেই বিলকিস জানতে পারেন ছাদেকের আরেকটি বউ আছে। সে ঘরে সন্তানও আছে।
বিলকিস এ খবর জানার পর তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ছাদেক তার কাছে টাকা দাবি করেন। বিলকিস নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে তার জমানো ৮০ হাজার টাকা দিয়ে দেন। এরপর কয়েক মাস ভালো কাটলেও বিলকিসের ওপর ফের নির্যাতন শুরু হয়। গত বছরের ২২ নভেম্বর বিলকিসের কাছে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন ছাদেক।
এসব বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে দুই মাস আগে মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে আবেদন করেন বিলকিস। অধিদপ্তর থেকে দুই পক্ষকেই নোটিশ দেয়া হয়েছে। আগামী মাসে তাদের আবেদনের বিষয়ে শুনানির তারিখ রয়েছে।
মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে এমন অভিযোগ প্রতিদিন গড়ে ২৫টি করে আসে। এসব অভিযোগের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যা সমাধানে কাজ করে এই সেল। আর বাকি সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দিয়ে বিদায় করা হয়।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের দেয়া তথ্যমতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যার মধ্যে ৬০ শতাংশ অভিযোগ তারা সফলভাবে নিষ্পত্তি করতে পারে। বাকি অভিযোগগুলো তারা সমাধানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরপর সেগুলো থানার মাধ্যমে কোর্টে পাঠানো হয়। আর এসব অভিযোগ পরিচালনায় সব ধরনের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে এই সেল।
মহিলা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই দপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের কার্যত শাস্তি দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। তারা দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিক সমাধান করার চেষ্টা করে। তা না হলে তারা এটিকে থানায় ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। তবে এ পর্যন্ত অনেক অভিযোগই সফলভাবে নিষ্পত্তি করেছে এই সেল।
সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে লাভলী-সোহান দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বিয়ের কাবিনের পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে দেয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল। এ ছাড়া তিন মাসের ভরণপোষণও আদায় করা হয়।
সুমি-স্বাধীন দম্পতির বিচ্ছেদের পর কাবিনের এক লাখ টাকা আদায় করে দিয়েছে এই সেল। গত বছর বরিশালের সাথী বেগমের কাবিনের দেড় লাখ টাকা আদায় করে দিয়েছে এই সংস্থা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের গবেষণায় দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যার বেশির ভাগই পরকীয়া সম্পর্কিত। পরকীয়া সম্পর্কিত অভিযোগ আসে ৪৫ শতাংশ। আর ৩০ শতাংশ অভিযোগ আসে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেয় না স্বামী। আর নির্যাতনসহ অন্যান্য অভিযোগ ২৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের উপপরিচালক মোসা. ফেরদৌসী বেগম বলেন, “স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ার অন্যতম কারণ পরকীয়া। এ কারণে বেশির ভাগ দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এ ছাড়া নির্যাতনের কারণেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ দেখা দেয়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি এই সমস্যা সমাধান করার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হই। কিছু ক্ষেত্রে সফল না হলেও বাদীকে আইনি পরামর্শ দেয়া হয়।”
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন
কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারণায় বাজবে এ আর রহমানের গান
আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসেরবিস্তারিত পড়ুন
উপদেষ্টা আদিলুর: পূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেবিস্তারিত পড়ুন