এইচআইভি এইডস: সচেতনতাই যার প্রতিষেধক
মানবজাতির জন্য আজ যে ক’টি রোগ হুমকিস্বরূপ তার অন্যতম প্রধান হলো এইডস। ১৯৮১ সালে আমেরিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই রোগ সনাক্ত করেন। এইচআইভি ভাইরাস থেকে এইডসের জন্ম। এইডস-এর পুরো নাম একোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েনসি সিনড্রম। যার অর্থ হচ্ছে দুর্বল শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। যে জীবাণুর মাধ্যমে এইডস রোগ জন্ম নেয় সে ভাইরাসটির নাম হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস, সংক্ষেপে যাকে এইচআইভি বলা হয়। এই ভাইরাসটি রক্তের সাদা কোষ ধ্বংস করে দেয়। ভাইরাসটি ব্যাকটেরিয়া থেকেও ছোটো এবং সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এইডসের বিস্তার ঘটছে। এক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারী এবং শিশুরাও এইচআইভি এইডসের শিকার।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রোগের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের রোগপ্রতিরোধক কোষ যেমন-হেলপারটি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স, মস্তিষ্ক ও গোয়াল সেল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে এবং সেগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মানবদেহের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন যেকোন সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে। এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার অবস্থাকে এইডস বলে। এই অবস্থায় শরীরে প্রতিরোধ করার মতো কার্যকরী কোষ না থাকায় বিভিন্ন রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে নানা উপসর্গসহ এর বিস্তার ঘটায়।
এক মাসের বেশি সময় ধরে একটানা শুষ্ক কাশি, সারাদেহে চুলকানিজনিত চর্মরোগ, মুখ ও গলায় ঘা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া, স্মরণশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পাওয়া, ক্লান্তি ও ক্ষুধাহীনতায় শরীরের ওজন কমে যাওয়া, বিনা কারণে এক মাসের বেশি সময় ধরে একটানা বা থেমে থেমে পাতলা পায়খানা, এক মাসের বেশি সময় ধরে একটানা জ্বর বা জ্বরভাব-এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্তের প্রাথমিক লক্ষণ। একমাত্র রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই এইচআইভি নির্ণয় করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, রেড ক্রিসেন্ট রক্ত দান কেন্দ্র, দেশের সকল মেডিকেল কলেজসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সকল প্রতিষ্ঠানে এইচআইভির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নারীরাই এইডস এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ক্ষমতা ও সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, পরনির্ভরশীলতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে নারীরাই এক্ষেত্রে সংবেদনশীল অবস্থায় রয়েছেন। শিশুরাও এই ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে ৩০৯ জন শিশু যাদের বয়স ০-১৪ বছর মূলত জন্মগতভাবেই এইডস আক্রান্ত। এদের মধ্যে ২০১৪ সালে ৬৩ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত শিশুদের ২০৮ জনকে এন্টি রেট্রোভাইরাল ট্রিটমেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও মাত্র ৭৯ জনকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০১৪ সালে এইডস আক্রান্তদের মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী। এইডস মুক্ত সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৩৮ গর্ভবর্তী মায়ের চিকিৎসার প্রয়োজন থাকলেও পেয়েছেন মাত্র ২৫ জন।
টঝঅওউ এর মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৩-১৮ হাজার এইচআইভি পজিটিভ মানুষের মধ্যে তিন হাজার ১০০ জনই নারী। প্রতি বছর বাংলাদেশে এক হাজার ১০০ জন এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বয়স ১৪-২৫ এর মধ্যে।
জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক শাখার এক তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি ৭ লাখ মানুষ এইডস আক্রান্ত। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ২০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু এইডস আক্রান্ত হয়েছে। সচেতনতার কারণে ২০০০ সালের তুলনায় সারাবিশ্বে এইডস আক্রান্তের হার ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেলেও রোগটি এখনো প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে এইডস এর প্রাদুর্ভাব বিষয়ক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ৩৭০ জন নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ৮২ জন মৃত্যুবরণ করেছে। ২০১৪ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭২৬ জন। এর মধ্যে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩৩ আর মৃত্যুবরণ করে ৯১ জন। ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশে তিন হাজার ৬৭৪ জন এইচআইভি আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এইডস রোগে মারা যায় ৫৬৩ জন। বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী সনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে।
এইডস এমন একটি প্রাণঘাতি সংক্রামক রোগ যার কোনো পূর্ণ চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যন্ত্রণাদায়ক অকালমৃত্যুই হচ্ছে এ ঘাতক রোগে আক্রান্তদের শেষ পরিণতি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলেও এইডস রোগের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিষেধক এখনো উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। সারা বিশ্বেই আজ এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে এই ভয়াবহ রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এইডস রোগীর দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। আমাদের দেশেও এই ঘাতক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে অতি দ্রুত।
সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, সিরিঞ্জের মাধ্যমে যারা মাদক সেবন করেন তাদের এইডস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ২৮ শতাংশ বেড়ে যায়। যৌনকর্মীদের মাধ্যমে এই রোগের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বাড়ে। সমকামিতার মাধ্যমে ১৯ শতাংশ আর হিজড়াদের (তৃতীয় লিঙ্গ) মাধ্যমে ৪৯ শতাংশ এইডস ঝুঁকি বাড়ে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো অবাধ যৌনাচার। অবাধ যৌনাচারের কারণে সিফিলিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সিফিলিস হলো এইচআইভি সংক্রমনের প্রধান সহায়ক। এইডস আক্রান্ত রোগীর সাথে কনডম ছাড়া যৌনমিলন, সুস্থ ব্যক্তির দেহে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত সঞ্চালন, আক্রান্ত ব্যক্তির কিডনী, বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জা শরীরে সংযোজন, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা সুঁই, সিরিঞ্জ, টুথব্রাশ ও ক্ষত সৃষ্টিকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে এ রোগ সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের সন্তানও এইডস আক্রান্ত হয়।
তবে এইডস আক্রান্ত মা ও নবজাতকদের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য প্রিভেনশন অব মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন অব এইচআইভির (পিএমটিসিটি) প্রকল্প সম্প্রতি আরো ১ বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিএসএমএমইউ জানিয়েছে, সরকারি পর্যায়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে গত ২০১৩ সালের ১৬ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনী বিভাগ এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের সেবা প্রদান শুরু করে। এ পর্যন্ত ৩৫ জন এইচআইভি সংক্রান্ত গর্ভবতী মাকে পিএমটিসিটি কার্যক্রমের আওতায় সেবা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৬ জন মা সুস্থ সন্তান প্রসব করেছেন। ২৫ জন মা তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাইয়েছেন। এ পর্যন্ত ২২ শিশু পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভিমুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এদিকে মাইগ্রেশনের মাধ্যমেও বাংলাদেশে এইডস ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানা যায়।
সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। এসময় জানানো হয়, ২০১৪ সালে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নতুন করে এইডস আক্রান্ত হয়। ২০০০-১৪ সাল পর্যন্ত নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার অনুপাতে যা ৩১ শতাংশ কম।
তবে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে স্বাভাবিক মেলামেশা, শারীরিক স্পর্শ এমনকি এক পাত্রে খাওয়া দাওয়া করলেও এ রোগ বিস্তারের কোনো সম্ভাবনা থাকেনা। তাই এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার কোনো প্রয়োজন নেই। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে এমন আচরণ করলে ব্যক্তিটি নিজের রোগ গোপন রাখবে যা ভবিষ্যতে আরও হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।
রোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক সব পার্যায়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মানব জীবনে নৈতিকতার দৃঢ় বন্ধন, নৈতিক বিধি-বিধান মেনে চলা ও অসংযত জীবনাচরণ হতে মুক্ত থাকলে এইডস এর ছোবল হতে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ।
শুধু অসচেতনতার কারণে আমাদের দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু এইডস প্রতিকারের ব্যবস্থা এখনো অজ্ঞাত সেহেতু প্রতিরোধই হবে এইডস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ। এইডস সংক্রমণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে খোলামেলা কথা বললে রোগটির প্রতিরোধ করা সহজ হবে। এজন্য ব্যাপক গণসচেতনতা প্রয়োজন। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এইডস সম্পর্কে জানা এবং বলা খুব জরুরি। এইডস রুখতে চাই সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
মানবদেহে আদার অনেক উপকার
আমাদের দিনে কয়েকবার রঙিন খাবার খাওয়া উচিত, কিন্তু আপনি কিবিস্তারিত পড়ুন
রেড মিট খাওয়ার আগে কিছু পরামর্শ জেনে নিন
কোরবানি ঈদে বেশ কয়েকদিন টানা খাওয়া হয় গরু বা খাসিরবিস্তারিত পড়ুন
জাপান ও ইউরোপে বিরল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
জাপানে, একটি বিরল “মাংস খাওয়া ব্যাকটেরিয়া” এর কারণে এক রোগবিস্তারিত পড়ুন