’এই লেখার মাধ্যমে আমি পৃথিবী জুড়ে সব অটিস্টিক শিশুর মায়েদের বলছি’
অটিস্টিক শিশুর মায়েরা কি সারাজীবন ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে? তারা কি অন্যদের মতো সভা, সমিতি, সাংস্কৃতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না? এই প্রশ্নটা আমাকে বিদ্ধ করে প্রায়ই। আজও যেমন করল। ঘটনাটা খুলেই বলি।
নিউইয়র্কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। কদিন পরেই এখানে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান প্রার্থী নির্ধারণের জন্য প্রাথমিক নির্বাচন হবে। নিউইয়র্ককে সবাই হিলারি ক্লিনটনের শহর বলেই জানে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ইস্যুতে তাঁর অবস্থান সবাইকে উদ্ধুদ্ধ করেছে বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষ নিতে। প্যালেস্টাইনিদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ও ইরাক যুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী বার্নির প্রথম ও প্রধান সমর্থক ছিল এদেশের তরুণ সমাজ। এবার তাতে যোগ দিয়েছে এশিয়ান আমেরিকান ও মুসলিম আমেরিকানরা। বার্নির পক্ষে কাজ করার জন্য ভলান্টিয়ারদের একটা সভা ডাকা হয়েছিল জ্যাকসন হাইটসের জুই্যশ সেন্টারে। বাসার একদম পাশে বলেই জীবনে প্রথম বারের মতো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কোন প্রচারণা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলাম আজ।
সৃজনও গেল মায়ের সঙ্গে। এদেশে শিশুদের বাসায় কারো কাছে রেখে যাবার উপায় নেই। সব সময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয়। অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে সৃজন বেশ চুপচাপ ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ও ওর অভ্যাসমতো মুখে কিছু আওয়াজ করছিল। আমার পাশে বসে ছিল আমার বন্ধু ভায়লা সালিনা লিজা। ও বলল, ‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না তো! আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না।’ আমি তবু কিছুক্ষণ পরে সৃজনকে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। পরে ও খানিকটা শান্ত হলে আবার পিছনের সারিতে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বসার পরে সৃজন আবার মুখে সেই অদ্ভুত আওয়াজ করতে লাগলো। তখন আমার পাশে বসা এক তরুন খুব বিরক্তভরে বলল, ‘আপনার ছেলের আওয়াজে আমার বক্তৃতা শুনতে সমস্যা হচ্ছে।’ ইংরেজি যে শব্দটা সে ব্যবহার করল, সেটা হল-ডিজরাপ্টিং!
আমি আবার বের হয়ে এলাম। অনুষ্ঠান শেষ হবার পরে এক বয়স্ক মহিলা এসে আমার হাত ধরে বললেন, ‘জানো, আমি ত্রিশ বছর যাবত একটা স্পেশাল স্কুলের শিক্ষক। তুমি চলে এসে ঠিক করনি। স্পেশাল শিশুদের সঙ্গে কেউ এরকম করতে পারে না।’ একটু পরে বেশ সুন্দর এক মহিলা এসে বললেন, ‘আমি জানি এভাবে চলে এসে আপনার খুব মন খারাপ হয়েছে। আপনার ছেলের আওয়াজে আমার কোন সমস্যা হয়নি। আপনি মনে কোন কষ্ট নেবেন না।’ সুন্দর এই মহিলা ওই তরুণের পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন।
সাধারণত আমার ছেলেকে নিয়ে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করলে আমি কাউকে কিছু বলি না। চুপচাপ চলে আসি। বাসে-ট্রেনে চলার সময় খুব সংকুচিত হয়ে থাকি। কোন বাসায় গেলে, অনুষ্ঠানে গেলে সব সময়ই মরমে মরি, কেউ বিরক্ত হল কিনা সেই ভয়ে! তবে বেশিরভাগ মানুষ খুব সহানুভূতির চোখেই দেখে সৃজনকে। আমার সংগঠনপিপাসু মন ঘরে আটকে থাকতে পারে না। সব সময়ই সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে যুক্ত হতে চায়। তাই সবার শেষে, সবার পিছনে হলেও সৃজনকে নিয়ে বসে থাকি সব অনুষ্ঠানে।
আজও সেরকম ছিলাম। তবু ওই তরুণের সহ্য হল না। সে পরোক্ষভাবে আমাকে বলল, বাইরে চলে যেতে। আমি হয়ত জীবনের আর দশটা কষ্টের মতো এই অপমানকে ভুলে যেতাম, কিন্তু ওই দুই মহিলার কথা শুনে জীবনে প্রথম বারের মতো কিছু বলতে ইচ্ছা হল। জুই্যশ সেন্টার থেকে বের হবার সময় দেখি সেই তরুণ, কুইন্সের একজন প্রভাবশালী পাকিস্তানী কমিউনিটি লিডারের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলছে। আমি সেখানে গিয়ে কথা বলার অনুমতি চেয়ে বললাম, মাই সন ইজ স্পেশাল বেবি। এভরিবডি শুড রেসপেক্ট সামবডি হু ইজ ডিজাবেল।
পাকিস্তানী ছেলেটি তার আচরণের জন্য ক্ষমা তো চাইলোই না, উল্টো বলল, ইউ শুড রেসপেক্ট আদার অপিনিওন। আমি চলে আসার সময় শুধু বলে এলাম, ইউ শুড ডু ইট ফার্স্ট।
কথা বলার সময় পাশে আমার বন্ধু লিজা দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনের বাসাই জ্যাকসন হাইটসে। আমি আমার ছেলেদের নিয়ে বাসায় চলে এলাম। একটু পরে লিজা ওর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে রজনী আর ওর এক সহপাঠির সঙ্গে বাসায় রওনা দিল। রজনী ওর মাকে চিন্তিত দেখে পথিমধ্যে জিজ্ঞাসা করল, মা তোমার কি হয়েছে? লিজা তখন একটু আগের আলাপচারিতা খুলে বলল মেয়েকে। বার্নির কট্টর ভক্ত মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরল জুই্যশ সেন্টারে। গিয়েই ওই পাকিস্তানী ছেলের ওপর চড়াও হল। রজনী ওই ছেলেকে বলল, ‘একজন মা যদি ২৪ ঘণ্টা তার অটিস্টিক সন্তানকে সহ্য করতে পারে! তবে এই সমাজের একজন মানুষ হিসেবে আপনি কিছুক্ষণের জন্যও কি একটা শিশুর মুখের আওয়াজ শুনতে পারবেন না!’ তবু ওই তরুণ নিজের ভুল স্বীকার করল না। অনুষ্ঠানের সমস্ত মানুষ এসে ভিড় করল ওখানে। সবাই রজনীর পক্ষ নিল। উদ্ধত ওই তরুণকে শেষ পর্যন্ত রজনী বলতে বাধ্য হল, ‘যদি আল্লাহ আপনাকে একটা অটিস্টিক শিশু দেয়, তবে আপনি কি করবেন?
এই লেখার মাধ্যমে আমি পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব অটিস্টিক শিশুর মায়েদের বলছি, সন্তানের জন্য নিজেদের গন্ডির মধ্যে বন্দী করে রাখবেন না। সমাজের আর সব মানুষের মতো আপনারও অধিকার আছে সব জায়গায় যাবার, সব জায়গায় উপস্থিত থাকার। আমরা সভা-সমিতিতে মানবতার কথা বলি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলি, অত্যাচারিতের জন্য দু:খপ্রকাশ করি, ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের ইসলামফোবিয়া, হিলারীর ইসরাঈলপ্রীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করি, আর একজন অটিস্টিক শিশুকে কিছুক্ষণের জন্য সহ্য করতে পারি না! রজনীর কথাই ঠিক, একজন মা যদি ২৪ ঘণ্টা তার সন্তানকে নিয়ে চলতে পারে, তবে অন্যরা কি কিছুক্ষণের জন্যও পারবে না!
রজনী, তোমাকে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে ধন্যবাদ। তুমি সত্যি কথা বলতে পার। এই সত্যি বলার ক্ষমতা তোমাকে অনেকদূর নিয়ে যাবে। ধন্যবাদ সহৃদয় বন্ধু লিজা আর সেই দরদী দুই অচেনা অজানা নারী, একজন মায়ের মলিন মুখ থেকে যারা ছুটে গিয়েছিলেন স্বান্ত্বনা দিতে।
মনিজা রহমান, নিউইয়র্ক
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন
কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারণায় বাজবে এ আর রহমানের গান
আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসেরবিস্তারিত পড়ুন
উপদেষ্টা আদিলুর: পূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেবিস্তারিত পড়ুন