এ কেমন নিষ্টুরতা শিশুর ওপর ?
নয় বছর বয়সী এক শিশু গৃহকর্মীর ওপর মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে এক দম্পতির বিরুদ্ধে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শিশুটিকে ১৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার হতদরিদ্র পরিবারের হতভাগ্য শিশু গৃহকর্মীর নাম জান্নাতুল ফেরদাউস। হাইমচর উপজেলার নয়ানী এলাকার হতদরিদ্র মন্টু মাতব্বর ও ফিরোজা বেগমের আদরের ছোট্ট মেয়ে। অভাবের তাড়নায় এক বছর আগে শিশুটিকে স্থানীয় মোস্তফা সরদারের (৫০) মাধ্যমে তার ভায়রা ওমর ফারুক ও শ্যালিকা মনি বেগমের গাজীপুরের জয়দেবপুরের বাসায় কাজের জন্য দেন। যে বয়সে শিশুটির স্কুলে যাওয়ার কথা, অন্য শিশুদের মতো খেলে বেড়ানোর কথা, সেই বয়সেই শিশুটিকে কাজে দিতে বাধ্য হন তার বাবা-মা।
নির্যাতিত শিশু জান্নাতের মা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘অভাবের কারণে বড় লোকের বাসায় মেয়েকে দিয়েছিলাম কাজ করার জন্য। কথা ছিল মেয়ে কাজ করবে, থাকবে, খাবে, পড়ালেখা করবে আর আমাকেও মাসে কিছু টাকা দেবে। কিন্তু তারা কোনো কথাই রাখে নাই বরং পশুর মতো নির্যাতন করেছে মেয়েটির ওপর।’
নির্যাতিত শিশুটির পরিবারের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, শিশু জান্নাতের গৃহকর্তা ওমর ফারুক বিমানবন্দরে চাকরি করেন এবং গৃহকর্ত্রী মনি বেগম একজন স্কুলশিক্ষিকা। বোঝা যায়, তারা অন্তত শিক্ষিত! কিন্তু শিশুটি ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেওয়ার পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় নির্যাতন। বাসার কাজে সামান্য ত্রুটিও তারা মেনে নিতেন না। স্কুলশিক্ষিকার বাসায় থেকে গৃহকর্ম, কথা অনুযায়ী তার পড়ালেখার ব্যবস্থাও তাদের করার কথা। কিন্তু তা তো হয়ইনি, বরং কাজে একটু এদিক-সেদিক হলেই নির্যাতন মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন স্কুলশিক্ষিকা মনি বেগম। স্বামীও কম যান না! তিনিও নাকি শিশুটির ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতেন!
মানুষের পাশবিকতা কোন পর্যায়ে গেলে এমন ছোট্ট শিশুকে যে কিনা তার বাসায় গায়ে-গতরে খাটে তাকে এমন নির্যাতন করতে পারে?
শিশুটি হাসপাতালে জানায়, ইলেকট্রিক তার দিয়ে পিটিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গরম ইস্ত্রিতে সেঁকা দেওয়া হয়েছে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। দিনে তাকে একবার খাবার দেওয়া হতো আর ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল হয়তো বাথরুম নয়তো রান্নাঘরের মেঝে।
সর্বশেষ গত ৫ ও ৯ সেপ্টেম্বর জান্নাতুলকে বেদম মারধর করে রক্তাক্ত জখম করা হয়। ঈদুল আজহার পরদিন ১৪ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে জান্নাতকে রক্তাক্ত অবস্থায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন প্রতিবেশী মোস্তফা সরদার, যিনি কিনা তাকে তার ভায়রা আর শ্যালিকার বাসায় কাজে দিতে মধ্যস্থতা করেছেন। এলাকার লোকজন শিশুটির নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মোস্তফা সরদারকে আটক করে হাইমচর থানায় সোপর্দ করেন। আর নির্যাতিত শিশুটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাইমচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
হাইমচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. সফিকুর রহমান জানান, জান্নাতের মাথা ও পুরো শরীরে মারাত্মক জখম রয়েছে। তিনি আরো জানান, আমরা তাকে সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়েছি। কিন্তু শিশুটির জখম খুব মারাত্মক। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য চাঁদপুর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এ ঘটনায় স্থানীয় শাহজান ভুইয়া বাদী হয়ে নির্যাতিতদের বিরুদ্ধে হাইমচর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। নির্যাতিত শিশুটিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার। তিনি শিশুটির ওপর নির্মম নির্যাতন দেখে আঁৎকে ওঠেন। পরে তিনি জানান, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে নির্যাতক গৃহকর্তা ও তার ভায়রাকে আটক করা হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে নির্যাতিত শিশুটির যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে, সে ছবির দিকে তাকানো যায় না। দগদগে ঘা আর জখমে ভরা শরীর দেখেই মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রশ্ন জাগে, কীভাবে একটা ছোট্ট শিশুকে এভাবে বর্বর নির্যাতন করা যায়? এরা মানুষ, না মানুষরূপী কোনো বন্যপশু? বন্যপশুরাও বোধকরি তাদের সন্তানদের এভাবে নির্যাতন করে না।
চোখ বন্ধ করে যে কেউ একটু কল্পনা করুন, আপনি অভাবের তাড়নায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার কোনো শিশুকে কোথাও কাজে দিয়েছেন- একটু ভালো খাবারের আশায়, একটু ভালো পরার আশায়, একটু ভালো পরিবেশে মানুষ হওয়ার আশায়। কিন্তু পরিণামে দেখলেন কী, শিশুটি ওসবের কিছুই পায়নি। বরং না-খেয়ে, না ঘুমিয়ে, দিনের পর পর দিন নির্যাতনে শিশুটি এখন হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী। মারাও তো যেতে পারত। অমানুষিক নির্যাতনে গৃহকর্মীর মৃত্যুর খবরও তো হরহামেশা পাই। এমন পরিস্থিতি আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? আপনি ওই নির্যাতকের কী শাস্তি দাবি করবেন? আমার তো ওই শিশুর ক্ষত-বিক্ষত শরীর দেখে মনের ভেতর রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। ওই ছবি দেখে কোনো সুস্থ মানুষ কি মুখে খাবার দিতে পারে? অথচ ওই মানুষরূপী ‘পশু দম্পতি’ কী নিদারুণভাবেই না শিশুটিকে প্রহার করেছে!
সংবাদে জানা যায়নি তাদের কোনো শিশুসন্তান আছে কিনা। যদি নাও থাকে, তবু কি ওভাবে প্রহার করা যায়? এমন অনেক প্রশ্নই মনকে আজ বিদীর্ণ করছে। নিজেকে একজন বাবা হিসেবে বেশ পীড়া দিচ্ছে।
অথচ দেখুন, অনেক পরিবারকেই আজকাল বাসায় কাজের জন্য গৃহকর্মী না পাওয়ার জন্য হাহুতাশ করতে দেখি। এমনিতেই শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর ওপর আইনগত নিষেধাজ্ঞা আছে। যে শিশু হাসবে, খেলবে, খেলনার জন্য, কোনো ভালো খাবারের জন্য, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না ধরবে, কান্নাকাটি করবে, তেমন শিশুকে গৃহকের্মে লাগিয়ে একটু কাজে উনিশ-বিশ হলেই প্রহার করা যায়? কবে আমাদের এমন পশুত্ব দূর হবে? কবে আমরা শিশুর প্রতি আরো অধিক যত্নশীল হব? এরূপ হাজারো প্রশ্নই আজ শুধু করতে ইচ্ছে করছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মতো ভদ্ররূপী শহুরেরা কি আর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে গ্রামের অসহায় নিরীহ মানুষদের গৃহকর্মে নিযুক্ত করতে পারব? তারা আমাদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবে?
শিশুটির অভিভাবকদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। এমন নির্মম বিষয় নিয়ে হয়তো অনেক লেখালেখি হবে, আলোচনা হবে, চাইকি মানববন্ধনও হতে পারে। রাষ্ট্রও হয়তো একটু নড়ন-চড়ন দেবে বিষয়টি নিয়ে। তারপর আবার আগের মতোই দেখব কোনো না কোনোভাবে শিশুরাই শিরোনাম। তারপরও বলব, শিশুদের সর্বোচ্চ সুরক্ষায় রাষ্ট্র তার যথযথ দায়িত্ব পালন করবে। আমরা অভিভাবকরা শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল হব। যাতে আর কোনো শিশু কোনোভাবেই নির্যাতিত না হয়, ওরা মুক্ত আবহাওয়ায় প্রস্ফুটিত হয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর পদ হারালেন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রদলেরবিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল গ্রেপ্তার
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে রাজধানীরবিস্তারিত পড়ুন