‘ওকে ঘুষি দিতে চাইছিলাম, পুলিশের কারণে পারি নাই’
সৌদি আরব থেকে দেশে আসা কুমিল্লার মুরাদনগরের শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিমানে আমার সিটের সামনের সারিতেই কামরুল বসে ছিল। ওকে দেখার পর বিমানের যাত্রীরা নানা ভাষায় কটূক্তি করতে থাকে; কেউ কেউ রাগ সামাল দিতে না পেরে কামরুলকে মারতে তেড়ে যায়। কিন্তু পুলিশ থাকায় কেউ কাছে ভিড়তে পারেনি।’ আরেক সৌদিপ্রবাসী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কামরুলকে বিমানে দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ওকে ঘুষি দিতে চাইছিলাম; কিন্তু পুলিশের কারণে পারি নাই।’ সৌদিপ্রবাসী আল আমিনকে নিতে এসেছেন আত্মীয় নাহিদ আরমান ও খায়রুজ্জামান। নাহিদ আরমান বলেন, ‘শুনলাম, ঘাতক কামরুলকে পুলিশ এখান দিয়ে নিয়ে যাবে। তাকে একনজর দেখা এবং ধিক্কার জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি।’ বিমানবন্দরের কর্মী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজন হত্যার ভিডিও দেখে আমি তিন রাত ঘুমাতে পারি নাই। এমন পশুটাকে সামনে থেকে দেখে ওর মুখে থুতু দিতে চাই।’
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২-এ শিশু রাজনকে পৈশাচিকভাবে হত্যার হোতা কামরুলকে ঘিরে এমনই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়া কামরুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনসহ প্রায় সব মিডিয়ার শতাধিক সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মীসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা এবং সৌদি আরব থেকে আসা প্রবাসী যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ভিআইপিকে দেখতে নয়, একজন বর্বর খুনিকে দেখতে। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় সৌদি আরব থেকে ধরে আনা হয় তাকে।
বিকেল ৪টায় কড়া পাহারায় ঘাতক কামরুলকে টার্মিনাল-২-এ আনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ফটো সাংবাদিকদের ছবি তোলার আর গণমানুষের ধিক্কার জানানোর। মাথায় হেলমেট, গায়ে পুলিশের লাইফ জ্যাকেট, জ্যাকেটের ওপর সাদা তোয়ালে জড়ানো, প্রায় অর্ধশত পুলিশ কর্মকর্তা বেষ্টিত হয়ে কামরুলকে এপিবিএন কার্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয়। কামরুল কোনো কথা বলছে না, মাথা নিচু করে পুলিশের সঙ্গে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। এক সহযাত্রীর কাছে জানা গেল, বিমানে যখন অন্য যাত্রীরা মারমুখী হয়ে ওঠে তখন কামরুল কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। একবার তাকে কাঁদতেও দেখা গেছে।
সৌদি আরবে পুলিশের হেফাজতে থাকা কামরুলকে আনতে গত সোমবার ভোরে সৌদির রিয়াদে যান তিন পুলিশ কর্মকর্তা- পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত সুপার মাহাবুবুল করিম, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার এ এফ এফ নেজাম উদ্দিন। শিশু শেখ মো. সামিউল আলম ওরফে রাজন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কামরুলকে নিয়ে ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তার ঢাকায় আসা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের ওই ফ্লাইটটি শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছায়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব থেকে বিমানে করে দেশে ফেরত আনা পর্যন্ত খুবই শান্ত ছিল কামরুল। বারবার শুধু বলছিল, ‘স্যার, আমি জীবনেও ভাবতে পারিনি এমন ঘটনা ঘটে যাবে।’ বলেই সে কাঁদতে থাকে। আরো বলে, ‘আমাদের গ্রামে কত চোর পেটায়। আমিও রাজনকে চোর ভেবেই পিটিয়েছি, কিন্তু মরে যাবে, এটা ভাবিনি।’
আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করতে পারায় নিজের কাছেই ভালো লাগছে। এমন জঘন্য কাজের হোতা কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে পারব- এটা অনেকেই ভাবতে পারেনি। সরকার এবং আমাদের পুলিশ আন্তরিক ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে।’
সৌদিপ্রবাসী ছেলে মিনহাজ উদ্দিন জীবনকে নিতে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে এসেছেন আবুল কালাম। সরকার এবং পুলিশকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশু রাজন হত্যার পর যখন শুনলাম যে আসামি কামরুল পালিয়ে সৌদি আরব চলে গেছে তখন ভাবছিলাম তাকে বিচারের মুখোমুখি আর করতে পারবে না কেউ। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতায় কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনায় ভালো লাগছে।’ পাশে দাঁড়ানো প্রবাসী মঞ্জুর আহামেদ বলেন, ‘শুধু কামরুলকেই নয়, অন্য দুই আসামিকেও গ্রেপ্তার করতে হবে। পাশাপাশি আরেক শিশু হত্যাচেষ্টাকারী গাইবান্ধার এমপি লিটনকেও যেন সরকার ছাড় না দেয়। তাঁর কঠোর বিচার হলে সরকারের ভাবমূর্তি আরো ভালো হবে।’
কামরুল ইসলামকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার পর এপিবিএনের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের এআইজি (গণমাধ্যম) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের কোনো বন্দিবিনিময় চুক্তি ছিল না। তার পরও আমরা তাকে আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছি। সৌদি আরব থেকে শিশু রাজন হত্যা মামলার আসামি কামরুলসহ গত পাঁচ বছরে ১০ জনকে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় দেশে ফেরত আনা হয়েছে।’ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঠিক তিন মাস আগে কামরুলকে ঘিরে একটা সংশয়, সন্দেহ ছিল যে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে কি না। তার আদৌ বিচার হবে কি না। কিন্তু সব সংশয়-শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে কামরুলকে ফেরত আনা হয়েছে। শিশু রাজনের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের ১৩ আসামির মধ্যে ১১ জনকেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। সেই হত্যার এখন বিচার চলছে। ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।’
ঢাকা থেকে গত রাতেই কামরুলকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমরা কামরুলকে সিলেটে নিয়ে যাব। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে। আদালতই নির্ধারণ করবেন বিচারিক প্রক্রিয়া কী ধরনের হবে।’ তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে কামরুলকে ধরার পর প্রথমে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। পরে থানা থেকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই আমরা ইন্টারপোলের সহযোগিতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’
কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়েই কামরুলের সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ তদন্ত করছে, গাফিলতির অভিযোগে কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুরোধ করলে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মত হয়। যে সময় কামরুল সৌদি আরবে পালায় সে সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সেখানেই ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ইন্টারনেট থেকে কামরুলের ছবি নামিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং একপর্যায়ে সে ধরা পড়ে। প্রতিমন্ত্রী সৌদি কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে কামরুল দেশে বড় ধরনের অপরাধ করে এসেছে। তাই তাকে ফেরত পাঠানো উচিত। গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে খুঁটিতে বেঁধে ১৩ বছরের রাজনকে পিটিয়ে হত্যার পর বিদেশে পালিয়ে যায় কামরুল। রাজনকে নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তখন প্রবাসীদের সহায়তায় কামরুলকে আটক করে সৌদি পুলিশের হাতে তুলে দেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। এরপর কামরুলকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ, জারি করা হয় রেড নোটিশ। ওই দিন রাজনকে পেটানোর কাজে কামরুলই বেশি সক্রিয় ছিল বলে ভিডিওতে দেখা যায়। রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়েছে সিলেটের আদালতে। ঘটনার দেড় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে গত ১৬ আগস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। কামরুলকে নিয়ে এ মামলার আসামিদের মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। পলাতকদের মধ্যে কামরুলের ভাই সদর উপজেলার শেখপাড়ার বাসিন্দা শামীম আহমদের সঙ্গে পাভেল আহমদ নামে আরেকজন রয়েছে। কামরুলের আরেক ভাই মুহিত আলম এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে।- কালের কণ্ঠ।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সিলেটে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
দ্বিতীয় দফার বন্যায় সিলেট অঞ্চলে সাত লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি।বিস্তারিত পড়ুন
সিলেটে ৯ ঘণ্টা পর রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক
চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ফেঞ্চুগঞ্জে দুটি বগি লাইনচ্যুতবিস্তারিত পড়ুন
সিলেট বিভাগের বন্যা ভয়ঙ্কর রুপ নিচ্ছে
গত কয়েকদিনের অবিরত হালকা ও ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি এবং ভারতবিস্তারিত পড়ুন