কাটার মাস্টার মুস্তাফিজের ‘কূটনৈতিক’ সাফল্য
বিশ্বের শীর্ষ অলরাউন্ডার হয়েও সাকিব আল হাসান যা পারেননি, বোলার হিসেবে শীর্ষস্থানে (আনুষ্ঠানিকভাবে) না পৌঁছেও মুস্তাফিজুর রহমান যেন সেই কাজটি অবলীলায় করে ফেলেছেন। ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা দূর করে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। দুই দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে সৌহার্দ্যের সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রতি ভালবাসা জন্ম দিয়েছেন ভারতীয়দের মনেও। এই এক ইস্যুতে রেষারেষি ভুলে একই সুরে কথা বলছেন দুই দেশের ক্রিকেট ভক্তরা। সেই সুরে ভাসছে সৌহার্দ্যের গান।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নবম আসর শেষ হওয়ার বেশ ক’দিন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের তরুণ পেসার মুস্তাফিজ এখন নিজে দেশে; সাতক্ষীরার তেতুলিয়া গ্রামে। তবে এখনও মুস্তাফিজ বন্দনায় সরব ভারতীয় মিডিয়াগুলো। মুস্তাফিজকে নিয়ে নানান খবর প্রতিদিনই জায়গা করে নিচ্ছে সেখানকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরাও মুস্তাফিজ প্রেমে ডুবে রয়েছেন এখনও। কেউ কেউ তো ফেসবুকে বলেই ফেলেছেন, ‘আইপিএলের পরবর্তী আসরটির যেন তর সইছে না। মুস্তাফিজের বোলিং মিস করছি।’
অথচ এই আইপিএল শুরুর আগেও বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে তুমুল বাকযুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ফেসবুকে প্রতিনিয়তই দেখা যেত একে অন্যকে আঘাত করে কড়া ভাষায় (কখনো কখনো অশ্লীল গালিপূর্ণ) স্ট্যাটাস। কিন্তু আইপিএলে মুস্তাফিজ বীরত্বের পর এখন যেন উধাও বললেই চলে। বরং দুই দেশের ভক্তদের মধ্যে বর্তমানে একে অন্যকে সন্মান জানিয়ে কথার বলার হিড়িক লক্ষণীয়। কেউ কাউকে আর যেন আঘাত করে কথা বলতে চান না। মুস্তাফিজ যেন জাদুর ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছেন দুই দেশের ক্রিকেটীয় রেষারেষি, ঘৃণার কাহিনীকে।
গত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদাপর্ণ মুস্তাফিজুর রহমানের। তার আগমনের আগে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এক ম্যাচ নিয়ে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেটীয় যুদ্ধ! বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ওই বিতর্কিত ম্যাচ ঘিরে কত কিছুই না হয়ে গেছে। এমনকি এর রেশ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। এরপর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেটীয় সম্পর্ক মানেই রক্তক্ষীয় এক লড়াই! টানা উত্তেজনা-স্নায়ুর চাপে ভোগা-দুই দেশের ক্রিকেট ভক্তদের একে অন্যকে তীব্র শ্লেষমাখা ভাষায় আক্রমণ। মুস্তাফিজ তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরের মানুষ।
বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজের দুটি টুয়েন্টি২০ ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন লিকলিকে গড়নের এক তরুণ বাংলাদেশি পেসার। তখন মুস্তাফিজুর রহমান নামটি অতটা মনে দাগ কাটেনি কারোরই। তবে ওই সিরিজের পরপরই ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজের ওয়ানডে ম্যাচে মুস্তাফিজুর রহমান নামটি হয়ে উঠল বিশ্ব ক্রিকেটের বিস্ময়। অফ কাটারের জাদু মাখা বোলিংয়ে ভারতের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানদের ধরাশায়ী করে মুস্তাফিজ ব্যক্তিগতভাবে যেমন ক্রিকেটের রেকর্ড বই পাল্টে ফেললেন, তেমনি বাংলাদেশকে এনে দিলেন ভারতের বিপক্ষে গৌরবজনক এক অধ্যায়; ক্রিকেটের পরাশক্তি প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জয়ের ইতিহাস। মুস্তাফিজ হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের নতুন নায়ক। ভারতীয়দের কাছে তিনি হয়ে রইলেন এক গভীর হতাশার প্রতিমূর্তি। মুস্তাফিজের অমঙ্গল কামনাই তখন থেকে যেন ভারতীয়দের অন্তরের একমাত্র ভাষা হয়ে রইল! অথচ আইপিএলের নৈপুণ্যে সেই অন্তরগুলোকেই পাল্টে দিয়েছেন মুস্তাফিজ।
আইপিএল শুরুর আগে চলতি বছর টি২০ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেটীয় যুদ্ধের উত্তাপ দেখা গেছে। এক দেশের ভক্তরা অন্য দেশের ভক্তদের হেয় করার জন্য সব কিছুই করেছেন। এমনকি দুই দেশের ক্রিকেটার ও মিডিয়াগুলোতেও এর প্রভাব ছিল লক্ষ্যণীয়। ভক্তদের আচরণের প্রতিচ্ছবিই যেন মিলছিল সেখানে। তাই তো বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদের হাতে মহেন্দ্র সিং ধোনির খন্ডিত মস্তকের ছবি দেখে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ভারত। আবার বিশ্বকাপে সেই তাসিকনই অবৈধ বোলিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তাসকিন নিষিদ্ধ পর এটাকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল বাংলাদেশি ভক্তরা; এমনকি ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
দুই দেশ একে অন্যের প্রতি সন্মান হারিয়েছিল। একে অন্যের প্রতি প্রশংসা করার বিষয়টি সেখানে ছিল অকল্পনীয়ই। কিন্ত কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ যেন আমূল পাল্টে দিয়েছেন সেই চিত্র। মুস্তাফিজের বদৌলতে এখন দুই প্রতিবেশি দেশের ভক্তরা একে অন্যকে সন্মান জানাচ্ছেন অবলীলায়। এক দেশের ক্রিকেটারের প্রশংসা করতে কিংবা শুভ কামনা জানাতে অন্য দেশের ভক্তরা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছেন না। তাই ভারতীয়রা যখন মুস্তাফিজকে সেরা বোলার বলে মেনে নিচ্ছেন, তখন বাংলাদেশিরা আবার ভারতের বিরাট কোহলিকে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করছেন না।
মুস্তাফিজের জাদুতে এই অবস্থা যে পুরোপুরি পাল্টেছে এখনই তেমন দাবি হয়তো করা যাবে না। তবে রাতারাতি অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে এ কথা নিশ্চিত। দুই দেশের ক্রিকেটীয় বৈরি সম্পর্ক কতটা পাল্টেছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে তা টম জাভিয়ার নামক এক ভারতীয়র বক্তব্যে। সৌদি প্রবাসী এই ভারতীয় বলেছেন, ‘আমি একজন ভারতীয়। কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে বলছি যে মুস্তাফিজ আমার কাছে এক বাংলাদেশি সেনসেশন। ভাই (মুস্তাফিজকে উদ্দেশ্য করে) অনুশীলন চালিয়ে যাও। বিশ্বের এক নম্বর বোলার হও।’
আইপিএল বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ নতুন নয়। মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল, আব্দুর রাজ্জাকরাও এই আসরের অংশ হয়েছেন। সাকিব তো এখনও কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলে চলেছেন। কলকাতাবাসীর মনও জয় করেছেন তিনি। তবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যান্য অংশের ভক্ত-সমর্থকদের হিংসা-বিদ্বেষ দূর করতে পারেননি তিনি। অথচ মুস্তাফিজ তার প্রথম আইপিএল মিশনেই (দেশের বাইরে তার প্রথম কোনো টুর্নামেন্টও) সফল; সৌহার্দ্য গড়ে তুলেছেন দুই দেশের মধ্যে। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজের ‘কূটনৈতিক’ সাফল্য কি হেলাফেলা করার মতো?
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া, দ্রুত সমাধানের আশ্বাস
টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেবিস্তারিত পড়ুন
প্রোটিয়াদের রানের পাহাড়, টাইগাররা নামতেই বদলে গেল পিচের ধরন!
চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ৫ সেশনেরও বেশি সময় ব্যাটিং করেছে দক্ষিণবিস্তারিত পড়ুন
নেপালকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে সাফবিস্তারিত পড়ুন