কেউ বলে আনন্দনগরী, কারো চোখে প্রযুক্তি বিষ্ময়
আমি এবং হুমায়ুন কবির বাবলু ভাই ক’দিন কাটিয়ে এলাম আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাস শহরে। উদ্দেশ্য National Association of Broadcasters Conference (NAB)-এ অংশ নেয়া ও Broadcast Equipment Fair-এ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়া।
বেশ ব্যস্ততায় কাটে সময়।সম্মেলনের অবসরে লাস ভেগাস শহর ঘুরে ঘুরে দেখছি। চোখ ধাঁধানো প্রাচুর্য্যের এই লাস ভেগাসকে কেউ বলে ‘আনন্দনগরী’। আবার কারো চোখে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ক্ষেত্র।
বাবলু ভাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটিয়েছেন আমেরিকায়। এই মহাদেশের কোথায় কী দর্শনীয় স্থান আছে তা মোটামুটি তাঁর নখদর্পণে। আমারও দর্শনীয় স্থান দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট লাইফ থেকে। আমাদের দু’জনের মধ্যে একটা ‘ট্যুরিস্ট মেন্টালিটি’ রয়েছে। বাবলু ভাই একদিন প্রস্তাব করলেন, চলুন, লাস ভেগাসের কাছেই কলোরোডা নদীর ওপর বিশ্বখ্যাত ‘হুবার ড্যাম’ দেখে আসি। ‘হুবার ড্যাম’ সম্পর্কে আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা, সেটা ফিল্ম দেখে। মনে পড়লো দুটো ফিল্ম-San Andreas ও Universal Soldier -যেগুলো দেখেছিলাম HBO- তে। বাবলু ভাই কথা প্রসঙ্গে বললেন, এই হুবার ড্যামের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়েই আজ লাস ভেগাসসহ আমেরিকার এ অঞ্চলের চোখ ধাঁধানো আলোর সাজ। পরদিন সকালে NAB Conference শেষে বাবলু ভাই আর আমি একটা ছাদ খোলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম World Great Attraction ‘হুবার ড্যাম’ দেখতে। ড্রাইভিং সিটে বসলেন বাবলু ভাই। আমি পাশের সিটে।
হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে আমাদের সাদা রাজহাঁসের মত ছোট্ট গাড়িটি। কিছুক্ষণ চলার পর একসময় লাস ভেগাস শহরকে পেছনে ফেলে প্রশস্ত মসৃণ হাইওয়ের ওপর নিজেদের আবিষ্কার করলাম। গাড়ির স্পিড বাড়লো। কালো পিচের হাইওয়ের ওপর আমাদের গাড়ি যেন উড়ে চলেছে। স্পিড মিটারের কাঁটা ১৪০-১৫০ এ। কখনো কখনো শুধু বাঁক নেবার সময় নেমে আসে ১২০-এ। দু’পাশে যতদূর চোখ যায় ঊষর মরুভূমি। মনে হলো, আমরা যেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে এসে পড়েছি। মাঝে মাঝে কিছু লোকালয়ের দেখা মেলে। গাছের পাতায় লালচে বালুর আস্তরণ পড়ায় সেটির সবুজ রঙ ধুসর হয়ে আছে। ঘণ্টাখানেক চলার পর দেখা মেলে সারি সারি খাড়া পাথুরে পাহাড়ের। পাহাড়ঘেঁষা আঁকাবাঁকা হাইওয়ে। দু’পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি। দূরের রুক্ষ পাহাড়ে সূর্যের আলো পড়ে মোহনীয় এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। ধ্যানরত মৌন পাহাড় দেখে মনে পড়লো কবি নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ গানটি।
নদীর ওপর বাঁধ বা ড্যাম তৈরির ইতিহাস সুপ্রাচীন। জানা যায়, পৃথিবীতে প্রথম বাঁধ তৈরি হয়েছিল খ্রিষ্ট জন্মের ৩০০০ বছর আগে, মধ্যপ্রাচ্যের মেসোপটেমিয়াতে। পাথরের এই বাঁধটি তৈরি হয়েছিল মূলতঃ টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানির স্তর নিয়ন্ত্রণের জন্য। ওই স্থানটি বর্তমানে পরিচিত ‘জাওয়া বাঁধ’ নামে যা জর্দানের রাজধানী আম্মান থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। আমার ধারণা, যেদিন থেকে মানুষ নদী শাসন করে বাঁধ তৈরির কৌশল আয়ত্ত করেছে, সেদিন থেকেই মানব সভ্যতা প্রগতির মহাসড়কে পা রেখেছে।
আমরা যতই হুবার ড্যামের দিকে এগুচ্ছি চওড়া হাইওয়ে ততই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে রাস্তা।মিনিট বিশেক চলার পর কলোরোডা নদীর দেখা পেলাম। একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়লো কলোরোডা নদীর ওপর হুবার ড্যামের ধনুক টাইপ বিশাল আর্চ। অনেক ওপর থেকে কলোরোডা নদীর শান্ত প্রবাহ চোখে পড়ে। যেন আকাশের সবটুকু নীল বুকে ধারণ করে শান্ত কলোরোডার পানি হয়ে আছে নীলাভ। নদীর এপার-ওপার দু’ধারেই বাদামী ও ধুসর রঙ পাথুরে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কোন গাছপালা নেই। কত কোটি বছর এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে!
গাড়ি পার্কিংয়ে এসে পড়েছি। বিশাল বিশাল ট্যুরিস্ট বাসে, প্রাইভেট গাড়িতে চেপে অনেকে এসেছেন ড্যাম চত্বরে। ড্যামটি নাভেদা ও আরিজোনা অঞ্চলের একটি বড় Tourist Attraction। শুনেছি সারাবছর এখানে ট্যুরিস্ট ভিড় লেগেই থাকে। আবার বিশেষ বিশেষ রাতে ফায়ার ওয়ার্কের ব্যবস্থা থাকে টুরিস্টদের জন্য।
পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে আমরা দু’জন এসে দাঁড়াই Most Iconic স্থাপনা হুবার ড্যামের কাছে। কলোরাডো নদীর মধ্যে কংক্রিটের তৈরি আর্ধাবৃত্তাকার বাঁধ। এ এক বিষ্ময়কর স্থাপনা! বাঁধের নান্দনিক সৌন্দর্য্য, বিশালত্ব এবং প্রকৌশল জ্ঞানের চিহ্ন দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। উঁচু থেকে পাখির দৃষ্টিতে দেখছিলাম নিচের হুবার ড্যামের বিষ্ময়কর সৌন্দর্য্য।
আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। কলোরোডার ঠান্ডা হাওয়া রোদের তীব্রতাকে আমাদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। এরইমধ্যে বিভিন্ন বয়সী অনেক টুরিস্ট এসে গেছে। সবার মধ্যে ছবি তোলার ধুম! যেদিকে ক্যামেরার ফ্রেম ধরা যায় সেদিকেই অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য। আমরা কলোরোডা নদী ও হুবার ড্যামকে সঙ্গে নিয়ে অনেক ছবি তুললাম।
হুবার ড্যাম আমেরিকার এক অনন্যসাধারণ স্থাপনা। ড্যামটির এপারে নেভাদা অঙ্গরাজ্য, ওপারে আরিজোনা।মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে আমেরিকার অন্যতম প্রধান নদী কলোরাডো। এই নদীর দৈর্ঘ্য কয়েকশ’ মাইল। নেভাদা এবং আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের মানুষ কলোরাডো নদীকে Most powerful & unpredictable river হিসেবে সমীহ করে। সারাবছর নদীটি শান্ত মেয়ের মতো ঘুমিয়ে থাকে। সে ফসলের মাঠে সেচের পানি যুগিয়ে উর্বর করে, অঙ্গরাজ্যগুলোর শাখা নদীর নাব্য বাঁচিয়ে রাখে। তবে বছরে একবারই ঘুম ভাঙে এ নদীর। তখন হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী। দু’পাড়ের জনপদের অনেক ক্ষতি করে দিয়ে যায় সে।
কলোরাডো নদী শত যুগ ধরে আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দীর্ঘ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে। আমেরিকানরা দুরন্ত খরস্রোতা কলোরোডা নদীকে আজ বশে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সংগ্রহ এবং পর্যটকদের বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে। এই ড্যাম নেভাদা আর আরিজোনার বিশাল মরু অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে। প্রকৌশল জগতে হুবার ড্যাম একটি বিস্ময়। ৭০০ ফুট দীর্ঘ কংক্রিটের প্রাচীরটি কলোরাডো নদীকে রুখে দিয়েছে।
আমেরিকার লোকেরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, হুবার ড্যাম তৈরি হয়েছে বলেই আজকের অন্যতম বিখ্যাত শহর লস অ্যাঞ্জেলেস আর লাস ভেগাসের জন্ম হয়েছে। কথাটি কেবল এ দু’টি শহরের জন্য না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় এ হুবার ড্যাম থেকে।ড্যামটি এ অঞ্চলের প্রাণ বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
আমেরিকানরা হুবার ড্যাম তৈরির মহাপরিকল্পনা করে ১৯২২ সালে। পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ হয় ১৯২৮ সালে। এরপর ১৯৩১ সালে ড্যাম তৈরির কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৩৬ সালে। প্রকল্প খরচ হয়েছিল ৪৯ মিলিয়ন ডলার।
হুবার ড্যামে ১৭টি টারবাইন আছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২,০৮০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। তবে এ ড্যামে ১৭টি টারবাইন কিন্তু একবারে স্থাপন করা হয়নি। বিদ্যুৎ চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন টারবাইন স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের দেশে কাপ্তাইয়েও একটা জলবিদ্যুৎ বাঁধ আছে। শুনেছি এর ৫টি টারবাইনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০ মেগাওয়াট। আমরা ভেবে দেখতে পারি, কাপ্তাইয়ে আরও ক’টা উচ্চশক্তির টারবাইন বসানো যায় কি না !
১৯২২ সালে পরিকল্পনার সময় এই ড্যামের নাম ছিল ‘বোল্ডার ড্যাম’। ১৯২৯ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ‘হারবার্ট ক্লার্ক হুবার’ (Herbert Clark Hoover) এর নামানুসারে বোল্ডার ড্যামের নাম বদলে রাখা হয় ‘হুবার ড্যাম’। এরপর ১৯৩১ সালে ড্যাম তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ততদিনে ড্যামের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১৯৩৫ সালে মহাসমারোহে ড্যামটির উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একবারের জন্যও হুবার সাহেবের নাম উচ্চারিত হয়নি, এমনকি তাকে অনুষ্ঠানে দাওয়াত পর্যন্ত করা হয়নি। উপরন্তু আমেরিকান পোস্টাল বিভাগ ড্যামের ওপর যে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে তাতে হুবার ড্যামের নাম দেয়া হয় বোল্ডার ড্যাম। এই স্মারক ডাকটিকেট চলে ১৯৩৩-৪৭ সাল পর্যন্ত।
এতদিন ভাবতাম রাজনৈতিক নোংরামি শুধু আমাদের দেশেই। হুবার ড্যামের ইতিহাস জেনে স্বস্তি পেলাম এটা ভেবে, আমাদের চে’ অনেক বছর আগে এই নোংরামির চর্চা হয়েছে আমেরিকায়। হুবার ড্যাম দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছি, সঙ্গে বর্ণিত ইতিহাস জেনে কষ্টও পেয়েছি।
শেষে আমাদের চোখ পড়ে একটি স্মৃতিফলকের ওপর। এটা হুবার ড্যাম মেমোরিয়াল। জানলাম হুবার ড্যাম বানাতে গিয়ে ১১২ জন মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিলালিপি করা হয়-‘They died to make the desert bloom’ (মরুভূমিতে ফুল ফোটাতে জীবন দিয়েছেন তাঁরা)। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো। আসলে মহৎ যে কোনো সৃষ্টির পেছনে অনেক নিবেদিতপ্রাণ মানুষের আত্মত্যাগের করুণ কাহিনি থাকে।
এরমধ্যে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। সূর্য বিশ্রাম নিতে ঢলে পড়েছে পাহাড়ের পেছনে। আর পাহাড় যেন বিছিয়ে দিয়েছে ছায়ার চাদর হুবার ড্যামের সারা শরীরে। আলো জ্বলে উঠেছে চারিদিকে। আলোকোজ্জ্বল হুবার ড্যামের প্রতিবিম্ব হেসে উঠেছে কলোরোডা নদীর গাঢ় নীল পানিতে। হুবার ড্যামের এ আরেক মনোমুগ্ধকর রূপ!
এবার ফেরার পালা। চমৎকার এক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছি লাস ভেগাসের দিকে। সুনসান হাইওয়েতে চলেছি আমরা দু’জন। কিছুক্ষণ পর আকাশে উদ্ভাসিত বিশাল পূর্ণিমা চাঁদ। এ আলোর বন্যায় ভাসছে দু’পাশের ঊষর মরুভূমি। মনে মনে গুনগুন করছি ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’। গাইছি আর ভাবছি, এমন জাদুকরি আলোয় হুবার ড্যামের রূপ না জানি কেমন!
অনুলিখন : সৈয়দ সাবাব আলী আরজু
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
মানবদেহে আদার অনেক উপকার
আমাদের দিনে কয়েকবার রঙিন খাবার খাওয়া উচিত, কিন্তু আপনি কিবিস্তারিত পড়ুন
হোটেল ঘরে বিছানার চাদর সাদা হয় কেন ?
বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকে প্রথম যে বিষয়টি নজরে আসে,বিস্তারিত পড়ুন
ধনিয়া পাতার উপকারি গুণ
চিকিৎসকদের মতে, ধনে বা ধনিয়া একটি ভেষজ উদ্ভিদ যার অনেকবিস্তারিত পড়ুন