ক্যানভাসে শীতের ছবি
সব ঋতু মোটামুটি একইভাবে কেটে যেত। খুব একটা পার্থক্য বুঝতে পারতাম না। কখনও সহনীয় গরম। কখনও অসহনীয় গরম। কখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে বৃষ্টি। কখনও রঙধনু আকাশ। কখনও মেঘলা আকাশ। প্রকৃতির শান্ত রূপ যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি মহা চোটপাটও। এটাকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হতো। মনে তেমন একটা ছাপ ফেলতো না। সেই বয়সে সৌন্দর্যবোধ এতটা ছিল না। রোমান্টিকতা ছিল না। বুদ্ধিমত্তাও শাণিত ছিল না। এমনিতেই আমার বুদ্ধি শার্প ছিল না। (এখনও আগের মতোই আছে।) মস্তিষ্কের অ্যান্টেনা কোনো কিছু সহজে ক্যাচ করতে পারতো না। সবাই যেটা চট করে বুঝতে পারে, আমি সেটা পারতাম না। কোনো কিছু বুঝতে বুঝতেই সময় পেরিয়ে যেত। যে কারণে প্রকৃতির রূপ বদলের মর্ম বুঝতে পারতাম না। এখনও খুব যে চালাক-চতুর হতে পেরেছি, সেটা বলা যাবে না। তবে প্রকৃতির বহিরঙ্গের পরিবর্তনটা অন্তত ধরতে পারি। শারীরিক ও মানসিক কারণেও টের পেয়ে যাই। তাছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি কি একটু খোলতাই হয়েছে? ঠিক জানি না।
তবে বোধহীন সেই বয়সে একমাত্র বুঝতে পারতাম শীতকালকে। না বুঝে উপায়ও ছিল না। এ ঋতুটি একদমই অন্যরকম। তার কুহক, তার মায়াময়তা, তার সৌন্দর্য আবিষ্ট করে দিয়েছে। তবে তার পাতাঝরার কান্না বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দিত বিষণ্নতা। প্রকৃতিকে যখন উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করতো, তখন ঠিকই টের পাওয়া যেত। আর হাড়কাঁপানো কনকনে শীত তো তার দাপট দিয়ে তার আবির্ভাব কাউকে না বুঝিয়ে ছাড়তো না। প্রত্যুষের কুয়াশা, ভোরের শিশির আর সকালের মিষ্টি নরম রোদের কোনো তুলনা ছিল না। থরে থরে সাজানো প্রকৃতির এ আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে কি পারা যায়? কুয়াশার কারণে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার সহজাত চুল্লি ছিল বেশ মজাদার। পায়ে পায়ে ঘাসের শিশির মাড়িয়ে যাওয়াটা ছিল পুলকজাগানিয়া। মুক্তোর মতো দেখতে টলমলে শবনম মুখে মাখালে মনে হতো ঔজ্জ্বল্য বুঝি অনেকখানি বেড়ে গেল। শরীরে মিষ্টি রোদের আদর খাওয়াটা আমার কাছে মনে হয়েছে স্বর্গীয় একটা ব্যাপার। এমন মুহুর্তের জন্য চিরকাল মুখিয়ে থাকা যায়।
শীতের রংচঙে পোশাকের কারণে শরীরটাও হয়ে ওঠে রংদার। মনটাও প্রজাপতির মতো রঙিন। চারপাশে যেন আনন্দের পসরা সাজানো থাকে। অনুভবটা হয় এমন : ‘ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো’। চলায় আনন্দ। ঘুরায় আনন্দ। খেলায় আনন্দ। এমনকি খুব বেশি দূরে না গেলেও মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠেছে। প্রিয়জনের সঙ্গে একই রিক্সায় একই চাদরের আড়ালে উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নেওয়াটা ছিল রোমাঞ্চকর। খাওয়াদাওয়া করতেও মজা লেগেছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, বরবটি, মুলা, লাউ, লাল শাক, পুঁই শাক, পাট শাক, কলমি শাক, ডাটা শাক, মুলা শাক, সরিষা শাক সহ টাটকা শাক-সব্জির কদরই ছিল আলাদা। স্বয়ংক্রিয় বাবুর্চির অদৃশ্য ছোঁয়ায় সব খাবারের সোয়াদও যেন বেড়ে যেত। অবশ্যই পরিবেশিত খাবার গরম গরম হতে হতো। ঠান্ডা হয়ে গেলে এরচেয়ে বিস্বাদ খাবার আর কিছু ছিল না।
রাতে ঘুমটাও হয়েছে গভীর। বিছানায় লেপ-তোশকের ওম যে কি আরামদায়ক! যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে জীবনের অনাবিল সুখ। তবে সকাল বেলা এই উষ্ণতা ছেড়ে ওঠে আসাটা জীবনের একটি কঠিনতম কাজ মনে হতো। যেন প্রিয়তমার নিবিড় আলিঙ্গন ছেড়ে অনিচ্ছা নিয়ে সরে যাওয়া। আর শীতল পানি দিয়ে হাত-মুখ ধোয়াও ছিল দণ্ড ভোগ করার মতো। শীতকালে রাতের বেলা আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার ধুম পড়ে যেত। পাড়ায় পাড়ায়। এমনকি বাড়ির আঙ্গিনায়ও।
গ্রামের বাড়িতে শীতকালটা ছিল আরো বেশি উপভোগ্যময়। যখন খুব ভোরে গ্রামের ঘুম ভেঙে যেত, তখন প্রকৃতির মাধুর্য বুকের মধ্যে সুখের কাঁপন ধরিয়ে দিত। শুনতে পাওয়া যেত শিশিরের শব্দ। উত্তরীয় দিয়ে শরীর মুড়িয়ে ঘরের বাইরে পা দিলে কুয়াশার মিহি রেশমি চাদরে ঢাকা প্রকৃতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠতো। উদীয়মান সূর্য আর কুয়াশার মিথস্ক্রিয়ায় যে দৃশ্যপট দৃশ্যমান হতো, এমন জীবন্ত ছবি কোনো শিল্পীর তুলিতে প্রস্ফুটিত হওয়া সম্ভব নয়। অপার্থিব এক মায়াবী জগত। কী যে নিষ্পাপ, কী যে পবিত্র, কী যে বিশুদ্ধ। মনটাকেও পরিশুদ্ধ করে দিত। কুয়াশাও এক ধরনের জাদুবাস্তবতা। তার ভেলকিতে অদৃশ্য হয়ে যেত ঘরবাড়ি-নদনদী-বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আবার তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে একটু একটু করে ম্যাজিকের মতো আড়াল থেকে দৃশ্যমান হতো। সরিষার ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে ওঠতো বিস্তৃত ভূমি। পাখিদের মনেও যেন রংয়ের ছোঁয়া লাগতো। ছড়িয়ে দিত চঞ্চলতা। ছড়িয়ে দিত সুরেলা আমেজ।
বেহেস্তি শরাব কি খেজুরের রসের মতো? ঘুম থেকে ওঠে চুমুক দেওয়ার পর মনে হয়েছে পান করছি শরাবন-তহুরা। তার মৌতাত যেন কাটতেই চাইতো না। আগুনের কুন্ডুলী জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়া কিংবা রান্নাঘরের চুলার আগুনে ভাঁপ নেওয়ার সময় সঞ্চালিত হয়েছে রক্তের প্রবাহ। ফসল কাটার পর জমিতে নাড়ার আগুনে কলুই পুড়িয়ে খাওয়া ছিল অন্যরকম আনন্দ। সের বা ডুলায় (বেতের তৈরি) করে পাটালি বা ঝোলা গুড় দিয়ে হুড়–ম বা মুড়ি খাওয়ার মজাও কম ছিল না। গরম ডিম সিদ্ধ, মোয়া, ভাঁপা, চিতই সহ রসের বা রকমারি পিঠাপুলি, পায়েসের ব্যঞ্জন ছিল যেন অমৃত। স্বল্প পানির খাল কিংবা বিলে সংঘবদ্ধ হয়ে পোলো দিয়ে একতালে মাছ ধরার ঐকতান বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। কই মাছ, শোল মাছ, টাকি মাছ, বাইন মাছ, শিং-এর মতো জিওল মাছ ধরতে পারার ধকল কিন্তু কম ছিল না।
শীতের বিপরীত চিত্রও ছিল। যা মোটেও রোমান্টিক নয়। গরীবদের অসহায়তা, দুর্ভোগ ও দুর্দশাও অবলোকন করতে হয়েছে। একটু উষ্ণতা, একটু আশ্রয়, একটি গরম কাপড়ের জন্য তাঁদের উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষার কত চিত্রই তো আমাদের চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি। আর সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়ও তা গুরুত্বসহকারে শোভা পেয়েছে। দেখা দিত ঠান্ডা জাতীয় রোগ। প্রকোপ বাড়তো সর্দি-কাশি-জ্বরের। তখন শীতকালটাকে অভিশাপের মতো মনে হয়েছে। তাছাড়া কখনও কখনও অকারণেই ছুঁয়ে যেত বিষণ্নতা। তারপরও সেই বয়সে শীতকালটা ছিল আনন্দের। উপভোগের। উল্লাসের।
অতীতের চিত্রপটে শীতকালের যুগপৎ এই ছবি হৃদয়পটে স্থায়ী হয়ে আছে। এখন তো আগের মতো সেই শীত নেই। সেই সবুজ নেই। সেই প্রকৃতিও নেই। শহরে এখন আর নিয়মিত তেমনভাবে তীব্র শীত নামে না। শিশিরের দেখা পাওয়া যায় না। শীতের পাখিও আসে না। তবে যা যা আসে তা হয়তো আমার চোখে ভাসে না। আমারও তো সেই শৈশব নেই। সেই কৈশোর নেই। সেই তারুণ্য নেই। যে কারণে এখনকার শীত হয়তো আমার মনে সেই উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে না। সেই আনন্দ পাই না। সেই ভালোবাসাও পাই না।
আর গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটাই অপস্রিয়মাণ। বলতে গেলে কোনো যোগাযোগই নেই। তবে দূর থেকে যেটুকু অনুভব করি, গ্রামও তো এখন শহর হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সেখানেও শীতের তীব্র কামড় নেই। পিঠাপুলির তেমন কদর নেই। মাছের সমাগমও নেই। নদী-নালা-খাল-বিলই তো হারিয়ে যাচ্ছে। তাহলে শীতইবা আসবে কীভাবে? বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বদলে যাচ্ছে শীতকালও। শীতকালটা তাই হয়ে আছে নস্টালজিয়ায় আঁকা ক্যানভাসের ছবি। ক্যাটালগ উল্টিয়ে উল্টিয়ে আপন মনে তাকে কখনও কখনও খুঁজি।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
মানবদেহে আদার অনেক উপকার
আমাদের দিনে কয়েকবার রঙিন খাবার খাওয়া উচিত, কিন্তু আপনি কিবিস্তারিত পড়ুন
হোটেল ঘরে বিছানার চাদর সাদা হয় কেন ?
বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকে প্রথম যে বিষয়টি নজরে আসে,বিস্তারিত পড়ুন
ধনিয়া পাতার উপকারি গুণ
চিকিৎসকদের মতে, ধনে বা ধনিয়া একটি ভেষজ উদ্ভিদ যার অনেকবিস্তারিত পড়ুন