দ্বিকক্ষের সংসদ প্রতিষ্ঠা
খালেদার বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাংলাদেশে নতুন নয়। এই ধারণা দেশের বিভিন্ন মহল থেকে এর আগেও বেশ কয়েকবার আলোচিত হয়েছে। তবে বিএনপির এই আগ্রহকে রাজনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্টজনরা।
আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা খালেদা জিয়ার ঘোষণাকে ‘চটকদার’ বলে বর্ণনা করছেন। তারা বলছেন, জাসদের মাধ্যমে এ ফর্মুলা দেশে আলোচিত হলেও জনগণ তা গ্রহণ করেনি।
শনিবার বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া দেশে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা উল্লেখ করে বলেন, রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানী-গুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদে একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।”
দলটির জাতীয় সম্মেলনে খালেদা জিয়ার এ ঘোষণা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা। এই আলোচনায় আসছে আরো কয়েকটি দলের দুই কক্ষের আইনসভা ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার চালুর দাবির কথা।
আশির দশকে বাংলাদেশে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ফর্মুলাটি প্রথম আলোচনায় আনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। পরে ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির কথিত ‘রহস্যপুরুষ’ সিরাজুল আলম খান খোলা চিঠি আকারে রাজনৈতিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এরপর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ ধারণাটি বেশ কয়েকবার আলোচনায় আনলেও তা বেশি দিন চলেনি। এরপর ২০১৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের কর্মসূচি চলাকালে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নাগরিক সমাজ দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব নিয়ে বড় দুই দলের প্রধানের কাছে চিঠি পাঠায়।
দ্বিকক্ষের সংসদ নিয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান একাধিক সেমিনারের আয়োজন করেন বিগত দিনে।
এরপর শনিবার নতুন করে তত্ত্বটি আবার সামনে এনেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
এদিকে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে প্রদেশভিত্তিক শাসনব্যবস্থারন কথা বলছে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংসদ ও শাসন কাঠামোয় কিছু পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিচারে এখানে নিম্নকক্ষে ৫০০ এবং উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্য থাকতে পারে।
এ বিষয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, “আমরা তো গত তিন বছর ধরে এ বিষয়টি নিয়ে দেশে কাজ করে যাচ্ছি। দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ ছাড়া বাংলাদেশ চলবে না। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেরিতে হলেও বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাব এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার জন্য।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাসদের একজন নেতা বলেন, “বেগম জিয়ার বক্তব্য আমরা দেখেছি। এটা তাদের কাছ থেকে নতুন বক্তব্য। এ নিয়ে তারা উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের সদস্য কারা কীভাবে নির্বাচিত হবেন এবং দুই কক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে সেটা নিয়ে কিছু বলেননি। তারা পরিষ্কার করে বললে এ বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হবে।”
জাতীয় পার্টির প্রদেশ ধারণার সঙ্গে খালেদা জিয়ার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের মিল নেই উল্লেখ করে দলটির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে যেকোনো রাজনৈতিক দলই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে তাদের এ নতুন ধারণা জনগণ গ্রহণ করবে কি করবে না সেটা প্রমাণ হবে নির্বাচনের মাধ্যমেই।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বলেন, “দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ এটা আমাদের দেশের পুরানো তত্ত্ব। খালেদা জিয়া মনে হয় সিরাজুল আলম খানের কাছ থেকে তত্ত্ব নিচ্ছেন।”
খালেদা জিয়ার এই ঘোষণাকে ‘চটকদার’ হিসেবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, “বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এখানে এ বিষয়টি সম্ভব নয়। জনগণের কাছ থেকেও এমন দাবি ওঠেনি। দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ তৈরি করার মতো সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশে এখনো হয়নি। তাই খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্য চটকদার। দেশের বিশিষ্টজনদের তার রাজনীতিতে টানার জন্যই তিনি এমন বক্তব্য দিয়েছেন।”
লেনিন আরও বলেন, “খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ভারসাম্যের কথা বলছেন। এ বক্তব্য দেয়ার আগে তিনি দলের মধ্যে নিজের ক্ষমতা কমালেন না। উনি তো দলের মধ্যে নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা রেখেছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, “দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ নিয়ে আলোচনা আমাদের দেশে প্রথম নয়। এর আগেও জাসদের (আ স ম আবদুর রব) এবং জাতীয় পার্টি আলোচনা করেছে। আমার কাছে এ বক্তব্যকে রাজনৈতিক বলে মনে হয়। তার আগে আমাদের বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা দরকার।”
দ্বিকক্ষের পক্ষে আসায় বিএনপির চেয়ারপারসনকে সাধুবাদ জানিয়ে এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, “তবে এটা নির্ভর করছে উনি যদি ক্ষমতায় যান। এ ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করতে সংবিধানে বড় রকমের সংশোধন করতে হবে। তাই সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতৈক্য হতে হবে।”
গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, “খালেদা জিয়া বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার জন্য এ নিয়ম তিনি করবেন। কিন্তু আমাদের দেশে তো সবকিছুই রাজনৈতিকীকরণ করা হয়। সেখানে দেখা যাবে ওই জায়গায় দলীয় লোকদের স্থান দেয়া হবে। যাতে করে প্রধানমন্ত্রী আরও বেশি স্বৈরাচার হবেন। ”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলি বলেন, দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ নিয়ে দেশে বহুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। এই ব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে এ ধরনের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করা প্রয়োজন। তাহলে সংসদ ও শাসনক্ষমতায় ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ তৈরি হবে। এ বিষয়টি যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করা যায় তাহলে ভালোই হবে।”
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, বৃটেনসহ বেশির ভাগ সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান।
শেলি বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিষয়ে যা বলেছেন, তা ভালো কথা। যদিও বেগম জিয়া অতীতে এ সুবিধা ভোগ করেছেন। ক্ষমতাসীন দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকে, তখন আইন পরিষদ দলের পক্ষে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী শুধু জাতীয় সংসদের প্রধান নন, তিনি আবার নির্বাহী পরিষদের প্রধানও। এতে সরকারের সব প্রশাসন এমনকি আইন-আদালতও নির্বাহী প্রধানের আওতায় থাকে। তাই এতে ভারসাম্য আনা দরকার।”ঢাকাটাইমস
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ফের ২ দিন রিমান্ডে আনিসুল হক
রাজধানীর বাড্ডা থানার স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা আল-আমিন হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
জামিন পেলেন সাবেক বিচারপতি মানিক
অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকেবিস্তারিত পড়ুন