চিরায়ত লোক উৎসব জামাই ষষ্ঠী
বাঙালির উৎসব আর ঐতিহ্যের যেন শেষ নেই। হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতি অথবা কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া আচার এক সময় একটি উৎসবে পরিণত হয়। এসব উৎসবে পরিবার পরিজন নিয়ে মেতে ওঠে সকলেই।
এরকমই একটি আচার-অনুষ্ঠানের নাম জামাই ষষ্ঠী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের। একটি উৎসবের আমেজ তৈরি হয় জামাই ষষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিক লৌকিক আচার। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই আচার পালন করা হয়।
এই মাস আবার বাঙালির ফলের রসনা তৃপ্তির মাস। বাজারে থাকে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু সহ আরও অনেক ধরনের দেশি ফল। জামাই যেমন এসব ফল আর দুধ নিয়ে শশুড় বাড়িতে উপস্থিত হন জামাই ষষ্ঠী নিতে ঠিক সেভাবেই জামাইকে বরণ করতেও প্রস্তুত থাকে শশুড় বাড়িও। বাড়িতে জামাইয়ের আগমনের পর থেকে পুরো বাড়িতে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
মূলত জামাইকে বছরের এই দিনে শশুড়বাড়িতে ঘটা করে নিমন্ত্রণ করা ও এই উপলক্ষ্যে দেবী ষষ্ঠীর কাছে জামাই-মেয়ের জন্য প্রার্থনা করাই মূল উদ্দেশ্য। এই দিনে বিবাহিত মেয়ে ও জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করা হয়। জামাইষষ্ঠী মূলত লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকেই এই প্রথার উদ্ভব।
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হত। ষষ্ঠীদেবী মাতৃত্বের প্রতীক। তাঁর বাহন বিড়াল। তাই মেয়ের মুখ দেখতে এবং মেয়ের দ্রুত সন্তান লাভের কামনায় মেয়ে জামাই আদরের পরিকল্পনা করা হলে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে পালিত হয়ে আসছে জামাইষষ্ঠী উৎসব।
জামাইষষ্ঠীর দিন জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো বেঁধে দেওয়া হয় মা ষষ্ঠীর আর্শীবাদ রূপে। এরপর দীর্ঘায়ু কামনায় তেল-হলুদের ফোঁটা কপালে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। জামাই ষষ্ঠী পালিত হওয়ার পেছনে যে প্রচলিত কাহিনী পাওয়া যায় সেটি হলো- মা ষষ্ঠী সম্পর্কে একটি খুব জনপ্রিয় লোককাহিনী আছে। সচ্ছল পরিবারের সাত পুত্রবধূর মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ ছিলেন একজন ভোজন রসিক। সে গোপনে খাবার ও পানীয় চুরি করত এবং বাড়িতে থাকা বিড়ালের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিত।
বেচারা বিড়ালটিকে এর ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছিল এবং প্রচুর মারধর করা হয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্রবধূর এই অপকর্মে বিড়ালটি খুবই দুঃখিত হয়ে পড়ে এবং সে ষষ্ঠী দেবীর কাছে অভিযোগ জানায় এবং কনিষ্ঠ পুত্রবধূর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করে। কয়েক মাস পর ছোট পুত্রবধূ সন্তান প্রসব করলে রাতে বিড়ালটি শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে যায়।
যতবারই ছোট পুত্রবধূর সন্তান হতো, বিড়ালটি তার সন্তানদের চুরি করে দেবীকে দিয়ে দিত। বারবার এমন হওয়ার কারণে ছোট মেয়ের জামাই মন খারাপ করতে থাকে। আশেপাশের লোকজন তাকে ডাইনি বলতে শুরু করে। তারপর কয়েক মাস পরে ছোট পুত্রবধূ একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় এবং তাকে রক্ষা করার জন্য সারা রাত জেগে বসে থাকে। গভীর রাতে তিনি দেখলেন বিড়ালটি তার বাচ্চা মেয়েকে নিতে এসেছে। মা তো মা। কিভাবে বিড়ালটি তার সন্তানকে কেড়ে নিতে পারে, সে বিড়ালের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বিড়ালটি ছোট পুত্রবধূর ব্রেসলেটে আঘাত পেয়ে পালিয়ে যায়। বিড়ালের রক্তের চিহ্ন দেখে ছোট পুত্রবধূও তাকে অনুসরণ করে মা ষষ্ঠীর দ্বারস্থ হলেন। সেখানে তিনি তার সব সন্তানকে জীবিত ও খেলা করছে দেখতে পেলেন। দেবীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলে দেবী তাকে তার অপকর্মের কথা মনে করিয়ে দেন এবং বিড়ালের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। ছোট পুত্রবধূ বিড়ালের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনিও দেবীর পূজা করবেন। এই নিয়ে তিনি তার সমস্ত সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন এবং মা ষষ্ঠীর পূজা করেন। সেই সঙ্গে শুরু হয় জামাইষষ্ঠীর প্রথা।
এটি একটি প্রচলিত গল্প তবে এর সাথে রয়েছে আরও কিছু বিশ্বাস বা উদ্দেশ্য। যেমন- আগের সময় যখন অনেক দূর-দুরান্তে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার রীতি ছিল তখন বছরে একবার-দুইবার মেয়ের বাপের বাড়িতে আসা হতো কি হতো না তার ঠিক নেই। সে কারণে বছরের এই দিনে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসকে বেছে নেয়া হয় জামাইকে আমন্ত্রণ জানাতে। কারণ আর কিছুই না, বাজারের ফলের বৈচিত্র্য। আর এসব ফল চিরকালই বাঙালির প্রিয় খাবার। আর মা ষষ্ঠীর পূজা যোগ হওয়ার কারণ হলো সনাতন ধর্মে ষষ্ঠীদেবী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক। পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি ও সন্তানের কল্যাণের জন্য এই পুজোর উদ্দেশ্য। ফলে কন্যা ও কন্যার স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়। জামাই দীর্ঘ জীবন লাভ করলে কন্যাকেও আর কষ্ট পেতে হয় না। ফলে এটি এখন সনাতন ধর্মের অন্যতম লোকাচারে দাঁড়িয়েছে। আগামী ১২ জুন পালিত হবে জামাই ষষ্ঠী। এখনই শুরু হয়েছে জামাইদের শশুড়বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা।
অলোক আচার্য
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
টসে জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে টসে জিতে স্বাগতিক ওয়েস্টবিস্তারিত পড়ুন
রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ
যমুনা ফিউচার পার্কে মোবাইলের দোকানে চুরির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভবিস্তারিত পড়ুন
যে ৫ দেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশিদের জন্য সতর্কতা
থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশি নাগরিকদেরবিস্তারিত পড়ুন