আপনি নিছক ক্রিকেটপ্রেমী হন, রাশভারি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হন কিংবা আবেগহীন ক্রিকেট সাংবাদিক হন। এই ম্যাচ মনে করলে চোখে জল এসে যাবে।

চিন্নাস্বামী প্রেসবক্সের বাঁ দিকে অঝোরে কেঁদে চলেছেন এক তরুণী, পাশের অশীতিপর মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন পরম স্নেহে। ছেলেটা আসছে, আসছে মাঠ ঘুরে, আসছে গোটা টিম নিয়ে।

ছটফটে ছেলেটা অস্বাভাবিক শান্ত আজ। বড়-বড় চোখ দু’টোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ছেলেটাও পারছে না আর কোনো দিকে তাকাতে।

চোখে বৃষ্টি নিয়েও মধ্যরাতে ‘কো-হা-লি’, ‘কো-হা-লি’ গর্জনে ফেটে পড়তে চাইছে চিন্নাস্বামী। দাঁড়িয়ে উঠে দিতে চাইছে আবেগের সম্রাটকে শেষ অভিবাদন। কিন্তু সম্রাটের কর্ণগহ্বরে ঢুকল কিছু? কে জানে।

মাঠ ঘুরে ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে ছেলেটা তো টুপি পুরো নামিয়ে দিল এক টানে। দমবন্ধ একটা কষ্ট এতক্ষণ গলার কাছে চেপে বসেছিল নিশ্চয়ই।

সর্বাধিক ছক্কার পুরস্কার নিতে গিয়ে নইলে অত বড় দীর্ঘশ্বাসটা আর পড়বে কেন? ফটোগ্রাফারদের একটা গ্রুপ দাঁড়াতে বলল। কিন্তু ছবিটা ভাল হল কি? মাথা নিচু, হাতে কোনও রকমে ধরা পুরস্কার— ম্যাজিক মোমেন্টের জন্ম আর হল কোথায়?

হারের হাহাকারের মধ্যে এত পুরস্কারের স্রোত, সত্যি যন্ত্রণাবিশেষ। বারবার উঠতে হচ্ছে, বারবার মাইকের সামনে বলতে হচ্ছে। ছেলেটার ভাল যে লাগছে না, জিজ্ঞেস না করেও বলে দেওয়া যায়।

কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে বেঙ্গালুরুর এত দিনের অকুণ্ঠ সমর্থন। অস্ফুট গোঙানির মতো বেরিয়ে আসছে, ‘ব্যাঙ্গালুরু আমাদের এত কিছু দিল। খারাপ সময়ে পাশে থাকল। কিন্তু শহরটাকেই কিছু ফিরিয়ে দেওয়া হল না!’

বিরাট কোহালি এবং ব্যাঙ্গালুরু রবিবার রাতে শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে যেন একাকার হয়ে গেল। ম্যাচে কী ঘটছে, কে হারছে কে জিতছে, বুঝতে বাইশ গজের দিকে তাকাতে হল না।

বরং বিরাট রাজার বারবার বদলাতে থাকা অভিব্যক্তি, বেঙ্গালুরু জনতার প্রায় পুরোটা সরব থেকে শেষ আধ ঘণ্টায় নীরব, ভাষাহীন হয়ে পড়া নিতান্ত অবোধকেও সব বুঝিয়ে দেবে।

শেন ওয়াটসন আউট হলেন যখন, কোহালিকে দেখা গেল চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন হতাশায়। স্টুয়ার্ট বিনির রান আউটের সময় মাথা এলিয়ে দিলেন চেয়ারের পিছন দিকে, চোখ সেই বন্ধ।

আবার বেঙ্গালুরু দর্শককে দেখুন। শেষ ওভারে ১৮ রান চাই, এ তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেই উঠতে দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব।

কোনও এক কার্লোস ব্রেথওয়েটকে তো তুলতে দেখেছে। কিন্তু ব্যাঙ্গালুরু জনতা নিজ-ভাষায়, বহিঃপ্রকাশে ক্রমাগত বুঝিয়ে গেল যে, আজ আর হবে না। নিস্পন্দ থেকে। নিশ্চুপ হয়ে গিয়ে।

বাস্তবকে মেনে নিয়ে যে, রূপকথা আইপিএল ফাইনাল ভাগ্যে নেই। রূপকথার অপমৃত্যুর দিন আজ। চোখের জল ফেলতে হবে, ফেলে বরণ করে নিতে হবে ডেভিড ওয়ার্নার নামক এক অস্ট্রেলীয় যোদ্ধাকে। দেখতে হবে ট্রফি নিয়ে তাঁদের উল্লাস।

ব্যাঙ্গালুরু করলও তাই। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের গোলিয়াথ-সম ডেভিড যখন একের পর এক ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ছেন, যুবরাজ সিংহকে যখন দেখা যাচ্ছে মধ্যরাতের চিন্নাস্বামীতে পাগলের মতো ভাঙড়া নাচতে, চিন্নাস্বামী দর্শক আশ্চর্যজনক ভাবে দাঁড়িয়ে সে সব দেখল। অতীব কষ্টে ডুবে গিয়েও হাততালি দিল, প্রাপ্য সম্মান প্রত্যার্পণ করল জয়ীকে।

আর কিই বা করতে পারত কোহালিরা? বিকেল পাঁচটা থেকে সমর্থনের একের পর এক তীব্র ঢেউয়ে প্রিয় টিমকে সমুদ্রস্নান করিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে ক্ষণিকের সুখ ছাড়া কিছু পায়নি।

ক্রিস গেইল ছক্কাগুলো যখন মারছিলেন, কোহালি যখন আরও একটা হাফসেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ততক্ষণ।

আরসিবি যখন ২০৯ তাড়া করতে নেমে পনেরো ওভারে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার অবিশ্বাস্যকে ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্যতার মরূদ্যানে নামিয়ে আনছিল। যখন ডেভিড ওয়ার্নারের দুঁদে বোলারদের তীব্র অবহেলায় গ্যালারিতে ছুড়ে-ছুড়ে ফেলছিলেন গেইল-কোহালি। কিন্তু মাত্র ৩৪ রানের একটা কালান্তক সময়ে তিন-তিনটে উইকেট চলে গেল। গেইল-কোহালি-এবি, সব শেষ হয়ে গেল তখন।

বিরাট কোহালির আজকের চুরচুর করে দেওয়া যন্ত্রণা সামলে উঠতে কত দিন লাগবে, কে জানে। দেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

ক্রিকেট-অদৃষ্ট তাঁকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দিয়েছিল। কাপ পেলেন না, আকাঙ্খার আইপিএল ট্রফির পিছনে দৌড় শুরু করলেন। হাতে সেলাই নিয়েও পরপর সেঞ্চুরি-হাফসেঞ্চুরি করে টিমকে ফাইনালে তুললেন।

টিমমেটরা বলতে লাগল, তারা মস্তিষ্কে কাপটা জিতেই ফেলছে। কিন্তু ক্রিকেট-দেবতা আবার তাকে রিক্ত করে ছেড়ে দিলেন। ঘরের মাঠে তাকে ফাইনাল জিততে দিলেন না।

ব্যাঙ্গালুরু তারাও বা কত দিনে এই শোক সামলে উঠবে, কে জানে। ব্যাঙ্গালুরু বা বলি কেন? গোটা ভারতই তো। গোটা ভারতবর্ষ আজ বিরাটের হাতে ট্রফিটা দেখতে চেয়েছিল।

চেয়েছিলেন তারা, যারা এই টুর্নামেন্টে বিরাটের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সোমবার থেকে দেশ আবার ফিরে যাবে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধে।

সোমবার থেকে ভারতবর্ষ ফিরে যাবে বাস্তবের অলিগলিতে। বিশ্বাস করতে চাইবে, স্বপ্ন চিরস্থায়ী হয় না। রোম্যান্স চিরকালীন হয় না।