ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ও কিছু উৎকণ্ঠা
সৈয়দ মাহবুবুল আলম:
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুসারে আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ থেকে সব তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট-মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী আসার কথা। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের এ সিদ্ধান্ত তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের মধ্যে উৎকণ্ঠাও তৈরি হয়েছে।
২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালের আইনের বিধিমালা অনুসারে আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ থেকে বাংলাদেশের সব তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী দিতে হবে। আইন পাসের প্রায় ৩ বছর পর এ ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বিধান আসার পেছনে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। আর এ অবস্থায় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের উৎকণ্ঠা যৌক্তিক।
তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানকে বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তামাকের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানকে কেন জোর দিয়ে থাকে, এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা জরুরি। গবেষণায় দেখা যায়, একজন ধূমপায়ী বছরের প্রায় ৭০০০ বার সিগারেটের প্যাকেটে দেখেন। ছবিসহ সতর্কবাণী থাকলে একজন নিরক্ষর মানুষও সহজে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। এ ব্যবস্থা ধূমপায়ীদের ধূমপান ত্যাগে উৎসাহী করে এবং কিশোর-তরুণদের ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত করে।
আন্তর্জাতিকভাবে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ব্রাজিলের এক গবেষণায় দেখা যায়, সিগারেটের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী এক-তৃতীয়াংশ ধূমপায়ীকে ধূমপান ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছে। সিঙ্গাপুরে ৭১ শতাংশ ধূমপায়ী বলেছেন, ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করায় ধূমপানের ভয়াবহ ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছে। বাংলাদেশ এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৯৫.৪ শতাংশ মানুষকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রভাবিত করবে।
বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা হয়েছে। এসব দেশের মাঝে প্রায় ৬০টি দেশে ৫০ শতাংশজুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে নেপাল ৯০ শতাংশজুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করেছে। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বে প্রথম প্লেইন প্যাকেজিং ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থায় তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে কোম্পানি ব্র্যান্ড ছবি, লোগো, ট্রেডমার্ক কোনো কিছুই প্রদান করা যায় না। প্যাকেটে একটি নির্দিষ্ট রঙ থাকে এবং কোম্পানি নির্ধারিত স্থানে এবং ফ্রন্টে শুধু ব্র্যান্ড নাম লিখতে পারে।
বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আইনিভাবে নিশ্চিত করা হয় ১৯৮৮ সালে তামাকজাত সামগ্রী বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের মাধ্যমে। ১৯৮৮-২০০৬ পর্যন্ত ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’- ছোট অক্ষরে লিখিত এ সতর্কবাণীই বিদ্যমান ছিল। ২০০৬ সাল থেকে নতুন স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নিশ্চিত করা হয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ অনুসারে। ২০১৩ ও ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) আলোকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর বিধান যুক্ত করা হয়।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট-মোড়কের মূল প্রদর্শনী তলের ৫০ শতাংশজুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করতে হবে। প্যাকেটে শুধু বাংলাদেশে বিক্রির জন্য অনুমোদিত লিখতে হবে। জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ও ঝুঁকি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরির উদ্দেশ্যে, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, কার্টন, কৌটা বা মোড়কে ব্র্যান্ড এলিমেন্ট (যেমন- লাইট, মাইল্ড, লোটার, এক্সট্রা, আল্ট্রা শব্দ) ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া প্রতি তিন মাস পরপর পরিবর্তিত সতর্কবাণী মুদ্রণ করতে হবে। সরকার দুই বছর পর নতুন সতর্কবাণী প্রদান করতে পারবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত অন্যতম আইন। এ আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ, সচেতনতা, সম্পৃক্ততা ও প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ, এ আইন প্রণয়নে আইনি দিকের পাশাপাশি দেশি সংস্কৃতি, মানুষের অভ্যাস, অবকাঠামো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, তামাক কোম্পানির তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় করা হয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আইন বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতামত গ্রহণ করেছে। প্রতিটি ধারার ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্লেষণ ও যুক্তিতর্ক করেছেন। আইনটির বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনায় প্রত্যেকেই আইনটি আরও কঠিন করার মতো জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তবে আইন প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ‘বাস্তবতার আলোকে’ সুপারিশ প্রণয়ন করেন। যে কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অর্জন অনেক হলেও মানুষের প্রত্যাশা এখনও পূরণ করতে পারেনি।
আইনটি প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে জনমত সংগ্রহসহ প্রচলিত সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। তারপরও এ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে বিরোধিতাসহ নানা তৎপরতা চালিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আইন প্রণয়ন এবং সংশোধন গঠিত কমিটির সদস্য হয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, প্রতিবারই তামাক কোম্পানি প্রবলভাবে শুধু প্যাকেটে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বিরোধিতা করেছে।
২০০৫ সালের আইন ও বিধিমালা প্রণয়নে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত থাকলেও ২০১৩ সালে এফসিটিসি অনুসারে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। তবে কোম্পানিগুলো সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাদের বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে, যা গণমাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই তাদের বক্তব্য প্রায় একই থাকে। যেমন প্যাকেটে এ ধরনের ছবি ছাপাতে তাদের মেশিন নেই, তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এত স্বল্প সময়ে তারা ছাপাতে পারবে না। এভাবেই তারা সময়ক্ষেপণ করেছে।
অধিকাংশ মানুষ তামাক কোম্পানিগুলোর বিরোধী থাকলেও কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তিকে তাদের পক্ষে কথা বলতে শোনা যায়। কিন্তু একটি কথা পরিষ্কারভাবে করা প্রয়োজন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তামাকজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনাসহ কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং আইনের পরিপ্রেক্ষিতে তামাক কোম্পানির বাণিজ্য যত কমে আসবে, জনগণের স্বাস্থ্য তত ভালো হবে। তামাকজনিত রোগ, মৃত্যু তত কমে আসবে।
আমরা দেখেছি, বিধিমালা প্রণয়নের পর প্রায় এক বছরের সময় দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সময় যখন শেষ হয়ে আসছে, তামাক কোম্পানিগুলো মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রে আবার টালবাহানা করছে। এখন তারা বলছে, প্যাকেটের উপরের অংশে তারা সতর্কবাণী দিতে পারবে না, নিচে দিতে চায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ বিষয়ে তারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেছে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটের উপরি অংশে সতর্কবাণী প্রদানের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করলে তিনি আইন অনুসারে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। গত জানুয়ারি মাসে সার্ক স্পিকার সামিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আগামী ১৯ মার্চ ২০১৬ থেকে বাংলাদেশ ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এই প্রেক্ষাপটে এমন প্রত্যাশা খুব বেশি চাওয়া হবে না যে সব অপতৎপরতা অগ্রাহ্য করেই ১৯ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সব তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী চালু হবে। – সমকাল
আইনজীবী ও নীতিবিশ্লেষক
[email protected]
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
কোকেনের সবচেয়ে বড় চালানে জড়িতদের নাম পেয়েছে ডিএনসি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান জব্দের ঘটনায়বিস্তারিত পড়ুন
শপথ করছি, মাদক ছোঁব না
মাইকে ঘোষণা হলো ‘এখন মাদকের বিরুদ্ধে আমরা শপথ নেবো’। শপথবিস্তারিত পড়ুন
ক্ষতি বছরে ১ লাখ কোটি ডলারঃ ধুমপানের পিছনে
ধুমপানে প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয় এক ট্রিলিয়ন বাবিস্তারিত পড়ুন