জন্মদাত্রী নয়, মা
সকাল থেকে কেমন যেন অস্থিরতা ঘিরে রেখেছে। রাতভর বার বার একই দুঃস্বপ্নের কারণে ভালমতো ঘুম হয়নি। বেশ ক’দিন যাবৎ প্রেসারের সমস্যার জন্য এমনটাই হচ্ছে। কিন্তু আজকের মতো অস্থিরতাটা কখনো এতটা স্থায়ী হয় না। সকালে স্কুলে গিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় ফিরেই কড়া এক কাপ চা খেয়ে মূর্তির মতো অসাড় হয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে রইলাম সারা ঘর অন্ধকার করে। গোসল সেরেফের এক কাপ চা হাতে নিয়ে পেছনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই।
গত ক’দিন যাবৎ সাবুর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। সাবুর মা আমার বাসায় প্রথম কাজ করতে এসেছিল ২০০১ সালে। তখন সবেমাত্র স্কুলের চাকরিটাতে ঢুকেছি। সারাদিন বাচ্চাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করার পর ক্লান্ত শরীরে সংসারের টুকিটাকি কাজগুলোকেও পাহাড়সম মনে হতো। একই সময়ে রফিকের সঙ্গেও সম্পর্কটা ছেদ হয়ে যায়। এর পর থেকেই অদ্ভুত এক মানসিক জগতে বসবাস করতে শুরু করলাম। কারো সঙ্গেই তেমন যোগাযোগ নেই, কারো সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে না।। স্কুল শেষে সোজা বাসায় এসে অন্ধকার গর্তের মাঝে পার হয়ে যাচ্ছিল একেকটা দিন। একদিন স্কুল সেরে বাসায় এসে সবেমাত্র চা নিয়ে বসেছি।ঠিক সেই মুহূর্তে কলিংবেলের আওয়াজ। অসময়ের কলিংবেলের শব্দে কিছুটা বিরক্তই হলাম। দরজা খুলে দেখি বয়সে প্রায় অর্ধেক একটা মেয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কী চাই প্রশ্ন করার আগেই উত্তর বেরিয়ে এলো হুড়মুড় করে- ‘আফনের বাসায় নাকি কামের মানুষ লাগব? সুচিখালা পাডাইছে।’ সুচি আমার দুই বাড়ি পরে থাকে। আমার স্কুলেই চাকরি করে। ওকে বলেছিলাম একটা কাজের মানুষ জোগাড় করে দিতে। সেই দিনের লম্বা ইন্টারভিউয়ের পর থেকে সাবুর মা ওরফে মিলি আমার বাসায় কাজ শুরু করে। আমার একলা নিস্তব্ধ জীবনে পাখির কিচিরমিচিরের মতো স্বস্তির জায়গা হয়ে ওঠে ১৫ বছরের মেয়েটা।
দিনগুলো রুটিনমাফিক একই রকম চলছিল। মিলি নিয়ম করে আসে। প্রতিদিনের প্রাত্যহিক কাজ সেরে ওর নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল বিশ্রামরত আমাকে তার জীবনের গল্প বলা। আর সেই গল্পের বিষয়বস্তুর ৯০ ভাগ জুড়ে থাকত তার বুড়ো মাতাল স্বামী, কবে কিভাবে তাদের বিয়ে হল, এর পর সংসার হল, কিভাবে তাকে অত্যাচার করা হতো ইত্যাদি, ইত্যাদি। একটা সময়ে তার প্রায় সবটাই আমার মুখস্ত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ও গল্পের কোনো একটা অংশ ভুলে গেলে আমিই তাকে ধরিয়ে দিতাম। ও লাজুক হেসে বলত- ‘আফা আফনেরে খুব বিরক্ত করতাছি তাই না!’ আমি কিছুটা প্রশ্রয়মাখা হাসি দিয়ে বলতাম- ‘তা আর বলতে!’ ও মুখখানা বেজার করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার কোনো এক উছিলায় শুরু করত। আমি শুনতাম চুপচাপ। কিছুদিন বাদে ওকে আমি পড়ানো শুরু করি। দ্রুত শেখার অদ্ভুত এক শক্তি ছিল মেয়েটির মধ্যে। কয়েক মাসেই অনেককিছু শিখেছিল।
সেই ছোট্ট মিলির বছর ঘুরতে পেটে বাচ্চা এলো। ফুলে ওঠা বেঢপ পেটটা নিয়ে কষ্ট করে যাতে কাজ না করতে হয় সেজন্য ওকে তিন মাসের অগ্রিম বেতনসমেত ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু তিন দিনের মাথায় সে এসে হাজির! ‘আফনেরে ছাড়া ভাল লাগে না। আমার কুনু কষ্ট অইব না’ বলেই কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে তার কাজে লেগে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপট রাগে ওকে দেখতে থাকি। আমার নিজেরও যে তিনটা দিন একা একা লাগছিল সেটা আর মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠে না। পরে মেয়েটার কাছে শুনেছিলাম মাতাল স্বামীটা হঠাৎ আরেকটা বিয়ে করে ভেগে গেছে। মেয়েটির একা একা থাকতে ভয় করত। তাই এই শরীরে ও আমার কাছে চলে এসেছিল। রাতে ও নিয়ম করে আমার এখানেই থাকতে শুরু করল। মিলি প্রায়ই একটা স্বপ্নের কথা আমাকে বলত- ওকে আর ওর বাচ্চাটাকে কে যেন গলা টিপে মেরে ফেলছে। আমি ওকে বোঝাতাম যে, এটা ওর মনের ভুল ধারণা। অনাগত বাচ্চাটাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করছে বলেই এই রকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে। বাচ্চা হওয়ার আগে আগে দুই মাসের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেল।
যেদিন মিলির বাচ্চা হল সেদিন দুপুরেই আবার সে নবজাতকসমেত আমার বাসায় এসে হাজির! ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখমুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে অদ্ভুত সরল এক মাতৃত্বের হাসি আর আমাকে তার নতুন আবিষ্কার দেখানোর এক অসীম উৎসাহ। ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আমি ভয়ে আঁতকে ওঠার ভান করি- ‘কিরে মিলি! তোর বাচ্চা তো বড় হয়ে সাবু হবে!’ নবজাতক বাচ্চাটিকে দেখে যে কেউ আট মাস এদিক ওদিক গুলিয়ে ফেলবে। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে সেও ভয়ে আঁতকে ওঠে- ‘কি কন!’ চাচাচৌধুরী সিরিজের সাবু চরিত্র সম্পর্কে মিলির জানবার কথা ছিলো না। ভীতু মেয়েটাকে আমি হাসিমুখে বুঝিয়ে বলি সবকিছু। মোটাসোটা ফুটফুটে বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিয়ে সে সরল হাসিতে জানতে চায়- ‘তাইলে নাম সাবুই রাইখ্যা দেই কি কন?’ ঘাড়ত্যাড়া এই নারীকে আর কোনোকিছু দিয়েই একচুল নড়ানো সম্ভব হবে না। চুপ করে বাচ্চাটার দিকে ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকি। এর ঠিক এক বছরের মাথায় মিলি একটা দুরারোগ্য রোগে মারা যায়। মেয়েটির বাবার মুখে শুনেছিলাম ওর মারা যাওয়ার শেষ দিনগুলির কথা। ও শুধু বার বার আমাকে দেখতে চাইত। সেই সময় একটা ট্রেনিংয়ে ঢাকার বাইরে থাকায় আমার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। ট্রেনিং শেষে এসে শুনি মেয়েটা মাটির নিচে চাপা পড়া অজানা দেশে চলে গেছে আজীবনের জন্য। যাওয়ার আগে কাঁচা হাতে লিখে গিয়েছিল একটা বিদায়ী চিঠি।
পুরনো স্মৃতি রোমন্থনের মাঝেপথে হঠাৎ বাধা পড়ে। কলিংবেল বেজে চলেছে একটানা। একটানা এতবার কলিংবেল বাজানোর দুঃসাহস কার হতে পারে? মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ইচ্ছে করে একটু দেরিতে দরজা খুলি। খুলতেই ঝড়ের গতিতে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিলয়। ‘মা, কাল কিন্তু আমি কলেজে যাচ্ছি না। আর তোমারও কোনোভাবেই স্কুলে যাওয়া হবে না। কাল আমরা পুরো ঢাকা শহর ঘুরব। আর খাওয়ার পরই তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে বসবে।’ আগামীকাল নিলয়ের ১৮তম জন্মদিন। যদিও এ পর্যন্ত ওর একটা জন্মদিনও আমার নিজের মনে করতে হয়নি। বিশেষ এই দিনটা নিয়ে ওর নিজের যত পরিকল্পনা থাকে। সেগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য কম হলেও এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করতে হয়। কখন আমাকে সময় দেবে। কখন তার বন্ধুদের সময় দেবে। সব লিষ্ট নিয়ে বাধ্য হয়ে ওর সঙ্গে আমারই বসতে হয়। কিন্তু আজ আমার কেন যেন কিছুই ভালো লাগছেনা। গত সপ্তাহে মিলির মৃত্যুবার্ষিকী গেল। প্রতিটা মৃত্যুবার্ষিকী নিজের মতো করে পালন করেছি। মেয়েটাকে শেষবিদায় দিতে পারিনি। এই অপরাধ ভোলার জন্যই কিনা জানি না। এ বছরের মৃত্যুবার্ষিকীর পর থেকে মেয়েটির অশরীরী আত্মা প্রতিটা মুহূর্তে আমার উপর ভর করে রয়েছে। ঘুরেফিরে ওর একটা প্রতিচ্ছবি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। কিছুতেই বুকের ভেতর থেকে আসা কান্নাটা আটকে রাখতে পারি না। অস্থিরভাবে পায়চারী করতে করতে বেডরুমে প্রবেশ করি। ওয়্যারড্রবের ভেতরে হাত দিয়ে নিলয়ের জন্মদিনের উপহারটায় আলতো হাত বুলাই। মনে যেন একটু প্রশান্তি ফিরে পাই।
কাপড়ের ভাঁজ থেকে বের করে আনি মিলির চিঠিটা- ‘আপা, আপনেকে অনেক মনে পড়তেছে। কই আছেন জানলে এক্ষণি এক দৌড়ে চইলা আসতাম। মনে আছে আপা আমার স্বপ্নের কথাটা বললে আপনে খুব রাগ করতেন? আমি সেই স্বপ্নটা আবার দেখা শুরু করছি। প্রত্যেক দিন শেষরাতে আমি এই স্বপ্নটা দেখি। আমি মনে হয় আর বাঁচব না আপা। শরীরের ভেতরে সারাক্ষণ কুথায় যেন জ্বলে। আপা, আপনে যদি আমার এই চিঠিটা পান তাইলে আমার জীবনের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ কইরা দিয়েন। আমার সাবুরে আপনে ভালো কুথাও পড়াশুনা করাইয়েন। ওরে মানুষ বানাইয়েন। আমার আর কিছু চাওয়ার নাই…।’
চিঠির বাকি অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসে। আমাদের প্রত্যেকেরই চোখের ভেতরে বোধ হয় কোথাও অথৈ জলের একটা সাগর আছে। সুযোগ পেলেই সেখান থেকে জোয়ারের তীব্রতা বেরিয়ে আসে হুড়মুড় করে। নিলয় কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। কাঁধে আলতো হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করে- ‘মা, আজ যেন কী হয়েছে তোমার? তুমি কি অসুস্থ?’ কান্নাটাকে চেপে রেখে বলি- ‘কই! কিছু হয়নি। তুই খেয়েছিস?’ নিলয় পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘অবশ্যই তোমার কিছু হয়েছে মা! আজ সারাদিনে তুমি একবারও আমাকে সাবু ডেকে রাগাবার চেষ্টা করোনি যে!’ জল গোপন করে আমি সন্তর্পণে চিঠিটা নিলয়ের জন্মদিনের উপহারগুলোর সঙ্গে রেখে দিই।
আমি জানি আজ রাতে নিলয় তার জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর উপহারটি পেতে যাচ্ছে। আর আমি, একজন মা হয়ে অপেক্ষায় আছি বহুদিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া একজন জন্মদাত্রীর সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আহা চিকুনগুনিয়া !
ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে আমিবিস্তারিত পড়ুন
‘দৃষ্টিশক্তি থাকা, কিন্তু জীবনে লক্ষ্য না থাকা অন্ধত্বের চেয়েও খারাপ’
চক্ষু, কর্ন, জিহবা, নাসিকা, ত্বক – মানুষের এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়েরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষিতা মেয়েটির গল্প
পারিনি সেদিন নিজেকে শোষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে, পারিনি সেদিনবিস্তারিত পড়ুন