জীবন পাল্টে দেওয়া ২০ টি বই
জীবন পাল্টে দেয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়া বইয়ের তালিকা করতে বললে এখন আমি যেটা করবো আগামী একছর বা দশবছর পর অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে, অনেক যোগ-বিয়োগ হবে। তেমনি আজ থেকে বছর দুয়েক আগে বললেও যে তালিকা হতো সেটা এখনকার সাথে পুরোপুরি মিলবে না। তবে কিছু কিছু বই সারাজীবন তালিকাতে থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
আমার তালিকা করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মহাগ্রন্থগুলোর রাখিনি।তবে ভূমিকাতে তাদের নাম নিয়ে রাখলাম। পবিত্র কুরআন, পবিত্র বাইবেল, পবিত্র গীতা আমার পড়া তিনটি অসাধারণ গ্রন্থ। প্রত্যেকটিই বহুবার পড়া। শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোও ঠিক এমন প্রভাবশালী হবে বলেই মনে করি। প্রত্যেকটি ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলো একে একে পড়ে শেষ করার আশা রাখি।
নিচে বিশটি বইয়ের তালিকা করার ক্ষেত্রে প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো নিয়ে আসা হয়নি। তবে অনেকেই লাও জু’র ‘তাও তে চিং’কে ধর্ম ও দর্শনের মাঝামাঝিই রাখে। আর মহাভারতেরই একটি অংশ যে গীতা। আগেভাগে একটু ফুটনোট দিয়ে রাখলাম!
সে যাই হউক এখন আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে যে বিশটি বইয়ের নাম মাথায় আসবে সেগুলোর নাম নেওয়ার চেষ্টা করি:
১. এপলজি অব সক্রেতিস বা সক্রেতিসের জবানবন্দি-প্লাতো
সক্রেতিসের বাবা ভাস্কর আর মা ধাত্রী। সক্রেতিস পরবর্তী জীবনে মা-বাবার পেশাকে ধরে রেখেছেন বলে মনে করতেন। ধাত্রী যেমন কোন মানবশিশুকে পৃথিবীতে আসতে, জন্ম নিতে সহায়তা করতেন সক্রেতিসও তেমনি একজন জ্ঞানপিপাসুর জন্মের ক্ষেত্রে ধাত্রীর মতো ভূমিকা পালন করতেন। আবার একজন ভাস্কর যেমন কঠিন পাথরকে কেটেকুটে সুন্দর মূর্তির রূপ দেন তেমনি দার্শনিক ও মানবতার শিক্ষক সক্রেতিস ও একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে নিপুণ ভাস্করের ভূমিকা পালন করেছেন। বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে তার পরিচয়। এখন সক্রেতিস কেমন শিক্ষক ছিলেন তার প্রমাণ প্লাতো, অ্যারিস্তোতলদের মতো ওস্তাদদের পরম্পরা তৈরি করার মধ্যেই রয়েছে। তার প্রিয় এবং যোগ্যতম শিষ্য প্লাতোকে নিয়ে বলা হয়-‘পুরো পাশ্চাত্য দর্শন প্লাতোর ফুটনোট মাত্র’। প্লাতোর প্রত্যেকটি লেখাতে প্রধান চরিত্র হিসেবে থেকেছেন সক্রেতিস। মনে হচ্ছে যেন সক্রেতিস কথা বলছেন আর প্লাতো নোট লিখছেন। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বয়স ত্রিশের দিকে গুরু সক্রেতিসের করুণ বিয়োগের ঘটনাটি এমনভাবেই তাড়িত করেছিল তরুণ প্লাতোকে যে সে তার পুরো জ্ঞানচর্চাকেই সক্রেতিসের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার প্লাতো প্রথমদিকে হয়তো সক্রেতিসের দর্শনই সক্রেতিসের মুখ দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার সেরা লেখাগুলোতে বা শেষদিকের লেখাগুলোতে নিজের দর্শন সক্রেতিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। সক্রেতিসের প্রতি তার একাত্ম আনুগত্য ও ভালোবাসার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের লেষমাত্র নেই।
সক্রেতিসকে খুব কাছ থেকে বুজতে হলে তার জবানবন্দি পড়তে পারেন। এর একাধিক বাংলা তর্জমা আছে। ইংরেজিতেও অনেকগুলো সংস্করণ আছে। যেকোন একটা পড়ে ফেলতে পারেন।
২. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ- সেনেকা
আমরা পৃথিবীতে এমনভাবে জীবনধারণ করি যেন আমরা অমর, মৃত্যু মনে হয় আসবেই না। অথচ যে মুহূর্তটা একবার চলে গেল সেটা আর ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব না। এবং মৃত্যু ও চলে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্রাজিক সত্য। এটা ট্রাজিক সত্য কারণ এই সত্যটা সবাই জানলেও ভুলে থাকে বা ভুলে যায়।
সেনেকার মতে-‘তুমি এমনভাবে সময় অপচয় করো যেনো তোমার অফুরান যোগান আছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো কোনদিন কাউকে যে সময়টা দিলে বা যে জন্য দিলে সেটা হয়তো তোমার শেষ সময়। মরণশীল প্রাণীর সব ভয় তোমাদের মধ্যে কিন্তু তোমাদের আকাঙ্খা এত যেন তোমরা মরবে না।’
যারা বিভিন্ন আকামে ব্যস্ত থাকে অথচ ভবিষ্যতে কোন একসময় ভালো কাজ করবে বা ৫০/৬০ বছরের পর অবসরে গিয়ে সকল ভালো কাজ করার পরিকল্পনা করে রাখে তাদেরকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন কিভাবে তারা নিশ্চিত যে ৫০ বছর বা ৬০ বছর বেঁচে থাকবে? সেনেকার মতে এমন মানুষদের লজ্জা পাওয়া উচিত। যে তার জীবনের সেরা সময়টাতে ভালো কাজ করতে পারে নাই সে শেষ জীবনে গিয়ে করে ফেলবে এটা ভাবা অহেতুক কল্পনাবিলাস নয় কি? সেনেকার কথা হচ্ছে যা কিছু করার আজই শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখার দরকার নেই।
জীবনের অর্থ খুজে পাওয়া বা কিভাবে বাঁচতে হয় এটা শিখতে অনেক কষ্ট হয়, এমনকি জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অনুধাবন হয় যে আসলে সেরকম বাঁচতেই পারলাম না। অনেকে বেশি মানুষের উপর ক্ষমতাবান হওয়াকে জীবনের সফলতা মনে করে। এর একটা বড় গোলকধাঁধা হচ্ছে এই যে অনেকের কাছে পরিচিত হলেও দেখা যায় সে নিজের কাছে সবচেয়ে অপরিচিত। এজন্য অনেক খ্যাতিমান লোক দিন শেষে দেখে তার নিজের জন্য সময় বরাদ্ধ কত কম!
অন্যকে সুখি করতে, অন্যের সামনে সুখি হিসেবে নিজেকে সবসময় তুলে ধরে রাখতে কত মানুষের জীবনের বড় অংশ চলে যায়। জীবনের যোগ বিয়োগ শেষে দেখা যায় আর সবাইকে সুখি করতে পারলেও যাকে সুখি করা হয়নি সেটা হলো নিজেকে! পাবলিক লাইফের প্যাড়া এমনই! এজন্যই আমরা কত রাজা-বাদশা, ধনরাজ, জ্ঞানী-মুনী-ঋষীকে দেখি অর্থ, সম্পদ, প্রাসাদ ছেড়ে জীবনের অর্থ খুঁজতে বের হয়ে পড়েন। তাদের মধ্য থেকেই বের হয়ে আসে গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, সক্রেতিস, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেকার্ত বা লুডবিগ ভিৎগেনস্টেইন প্রমুখ মহামানব।
বেশিরভাগ মানুষের দিন কাটে অতীতের অনুশোচনা আর ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা নিয়ে। কয়জন পারে আজকের দিনটাকেই শেষদিন মনে করে পূর্ণ করে বাঁচতে? আর অনেকের দিন কাটে ভবিষ্যতের ভালো সময়ের অপেক্ষা করে। সেনেকার প্রশ্ন ভবিষ্যতের কাছে দাবি-দাওয়া বা ভবিষ্যতের ভয় ছাড়া বর্তমানে বাঁচতে পারে কয়জন?
সময়ের অপচয় সেনেকা মেনে নিতে পারেন না। অন্য তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বেশ সতর্ক হলেও এ ব্যাপারটাতে বেহিসাবী। সময়কে তুচ্ছ করে যারা অপচয় করে, অহেতুক কাজ করে বেড়ায় তারাই আবার যখন গভীর অসুস্থতায় পড়ে বা মৃত্যুমুখে পতিত হয় তারা ডাক্তার কবিরাজদের হাঁটুর নিচে পড়ে থাকে যেন আর কয়টা দিন বাঁচা যায়। বা কাউকে যখন মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় তখন উকিল-মোক্তারদের পেছনে ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের দৌড়ানো দেখলেই বুঝা যায় একটি দিন বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ, একটি দিন কত বড়! আবার এ লোকটিই হয়তো দিনের পর দিন দিন ক্ষয় করে গেছে, অন্যের জীবন যাপন করে গেছে আর নিজের কাছে অচেনা থেকে কাটিয়েছে।
অনেক বছর বাঁচলেই কেবল বড় মানুষ হওয়া যায় না। সেনেকা বলেন- কারো ধূসর চুল আর কুচকে যাওয়া চামড়া দেখে ভেবো না সে অনেকদিন বেঁচেছে। সে আসলে অনেকদিন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার। সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়। তাই আমার মতে বই মানুষের জন্য সেরা সফটওয়ার। আর একেকটা সেরা বই পড়া হচ্ছে একেকটা সফটওয়ার ইন্সটল করা; তার মানে জগতকে একেকবার একেকটি দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা অর্জন করা। সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ আমার কাছে তেমন একটি বই। যখন মনে হয় আমি অহেতুক সময় অপচয় করছি, যখন মনে হয় আমি আমার নিজের কাছে কমিটমেন্টের সাথে প্রতারণা করছি, আমার মনের গহীন কোণে হতাশার চাষবাস করছি তখনই এমন কিছু সফটওয়ারের সাহায্য নেই। এগুলো ইনস্টল করার মাধ্যমে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি।
৩. দ্য আর্ট অব ওয়ার- সান জু
দ্য আর্ট অব ওয়ার শুধু একটি রণনীতির বই-ই নয় ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধূলা থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এটা যেমন জেনারেলদের জন্য ম্যানুয়ালের মত কাজ করেছে তেমনি যেকোন সংকটময় পরিস্থিতিতে যে কেউ এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
আর্ট অব ওয়ার আসলে কি?- যুদ্ধ না করেও যুদ্ধ জয় করা ( ‘winning without fighting’.)
যে কোন ব্যক্তি, যে কোন পেশা থেকেই এ বইটি পড়তে পারে। আসলে এটা বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু, এটা ম্যানুয়াল বা গাইডলাইন। যারই জীবন পাল্টে দেয়ার উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে সেই-ই এটা পড়তে পারে। আবার এ ম্যানুয়ালটি এমন নয় যে একেবারে প্রথম থেকে পড়া শুরু করে শেষ করতে হবে। জীবনের যেকোন সমস্যায় বইটির যেকোন পৃষ্ঠা খুললেই হয়তো প্রয়োজনীয় সমাধানের দিক নির্দেশনা মিলতে পারে।
আধুনিক এই সময়ে আর্ট অব ওয়ারের গুরুত্ব কি কারণে?
আমরা একেকজন একেক যোদ্ধা, আমাদের জীবনের সংকট কম নয়। সেই ক্ষুদ্র ব্যক্তির জীবন ও সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য এই বইয়ের নীতি অনেক সহায়ক হবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজেকে যারা জীবন সংগ্রামের সৈনিক মনে করেন, যারা কিছু অর্জন করতে চান তাদেরকে অনেক রসদ দিবে সান জুর এই নীতিগ্রন্থটি।
৪. আলকেমিস্ট- পাওলো কোয়েলহো
আমাদের সময়ের ক্লাসিক। বিশ্বের প্রতিটি দেশে এখন এই বই পড়ুয়া কেউ না কেউ আছে। জীবন সংগ্রামে, নিজের মঞ্জিলে পৌছার সংগ্রামে থাকা ব্যক্তির জন্য এটা ম্যানুয়েল হিসেবে কাজে দেবে। স্বপ্নকে কিভাবে অনুসরণ করতে হয়, কিভাবে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে, কিভাবে মন থেকে কোন কিছু চাইলে পুরো বিশ্ব সেটা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে সেরকম অনুপ্রেরণার কথা পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।
৫. দি প্রফেট-কাহলিল জিবরান
যে বইটা কয়েক ডজনবার পড়া হয়েছে। যার প্রতিটি লাইন মনে ও হৃদয়ে গেথে রাখার মতো। আমার কাছে কেউ প্রশ্ন করলে কোন বই পড়বো প্রথম দিকে যে অল্প কয়েকটি বইয়ের নাম নেই এটি অন্যতম। এখানে কাজ, কথা, সন্তান-সন্ততি, বিচার-আচার, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন মানবীয় বিষয় নিয়ে প্রফেটিক ও দার্শনিক উপদেশ বইটির পরতে পরতে।ইংরেজি অত্যন্ত সহজ ও মধুময় হওয়ার কারণে যে কেউ এটা পড়া শুরু করে দিতে পারেন।
৬. কর্মযোগ-স্বামী বিবেকানন্দ
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কর্মযোগ পড়ে ব্যাপক নাড়া খেয়েছিলাম। এখনো সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এজন্য মাঝে মাঝে স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকি। কিভাবে একজন কর্মবীর হওয়া যায় আবার কাজের, পদের বা খ্যাতির মোহে আটকে পড়া থেকে দূরে থাকা যায়, কিভাবে পরমহংস হতে হয় তার পরামর্শ বইটিতে। গীতার শিক্ষা থেকে উৎসারিত বিবেকানন্দের কর্মযোগ আমার একটি প্রিয় বই।
৭. ভবঘুরে শাস্ত্র- রাহুল সাংকৃত্যায়ন
গত কয়েকবছরে এই ছোট্ট বইটি জীবনে বেশ বড় প্রভাব রাখছে। জীবনের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে তার পরামর্শ নিতে হলে ভবঘুরে শাস্ত্র একটি সহজ চয়েস হতে পারে। কিভাবে ভবঘুরেরাই পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছেন, ওলট-পালট করে দিয়েছেন তার উদাহরণ অহরহ মিলবে বইটিতে। একটি কর্মময় মহাজীবনের পথিক হতে হলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের এই বইটি অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।
৮. কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো- কার্ল মার্কস, ফ্রিডরিক এঙ্গেলস
নিয়মিত পড়া বইয়ের একটি। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিক এঙ্গেলস রচিত এই বইটি বিশ্বজুড়ে বহুল পঠিত বইয়ের একটি। কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটালে দাঁত বসাতে না পারলেও এ বইটি পড়ার মাধ্যমে কমিউনিজমের সাথে প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন করা যাবে। বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে বইটি অত্যন্ত সুন্দর ও কাব্যিক ভাষায় লেখা এবং মনে রাখার মতো অসংখ্য লাইন চলে আসবে কিছুক্ষণ পরপর।
৯. তাও তে চিং- লাও জু
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো শুধু একবার পড়ে নিস্তার নেই। বারবার পড়া উচিত। কিছু বই আছে একবার পড়লেই বুঝা হয়ে যায়। আবার কিছু বই আছে প্রত্যেক পাঠেই নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়। প্রথম পাঠে অর্থ স্পষ্ট হয় না, বা যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় তা অসম্পূর্ণ। এজন্য রিপিট করা আবশ্যক। আবার আপনার পছন্দের বই হিসেবে নিয়মিত হাতে চলে আসে সে বইটি।
লাও ৎস বা লাও জু’র ‘তাও তে চিং’এমন একটি বই। মাত্র ৫ হাজার চীনা শব্দের দ্বারা গঠিত এই নাতিদীর্ঘ বইটি দীর্ঘসময় ধরে চীন ও তার প্রতিবেশী দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী বই হিসেবে পঠিত হয়ে আসছে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে রচিত এই কাব্যটি তাওবাদের একটি মৌলিক কেতাব! কনফুসিয়াসের চিন্তার সাথে লাও ৎস বা লাও জু’র তাওবাদ চীনের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী চিন্তা বা জীবণপ্রণালী! এটা একটি সহজিয়া পথের সন্ধান দেয়।
চীন-জাপানের জেন দর্শন নিয়ে হালকা জানাশুনা না থাকলে তাদের জন্য এটা বুঝতে একটু কষ্ট হতে পারে। আর চীনা গুরুজন সবসময়ই অ্যালূসিভ ভাষায় কথা বলেন। কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে লাও জু, সান জু-সবার ভাষারই অনেকগুলো মিনিং থাকে।
ভাষার অর্থ বুঝতে হলে এর গভীরে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় নাই। এবং সারফেস মিনিং এর উপর জোর দিলেই চলবেনা। ডিপ কি মিনিং দিচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
১০. যদ্যপি আমার গুরু- আহমদ ছফা
বাংলাদেশের তরুনদের মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন হচ্ছেন আহমদ ছফা। আমি নিজেও তার লেখা দ্বারা বেশ প্রভাবিত।‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ সহ অন্যান্য প্রবন্ধগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই হলেও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। আহমদ ছফার লেখায় তার গুরু জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের চিত্রায়ন, সমকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গের উল্লেখ বইটিকে একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণায় পরিণত করেছে। আবদুর রাজ্জাকের প্রজ্ঞার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্জাক স্যার মিথ সৃষ্টিতে বেশ ভূমিকা রেখেছে। নবীন পাঠকদের জন্য একটি সহজ টার্গেট হতে পারে এই বইটি।
১১. দি হানড্রেড- মাইকেল এইচ হার্ট
আমার শিক্ষক উইল ডুরান্টের কথায় বলতে হয় ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’। বড় মানুষদের জীবন আমাবে বেশ টানে। এজন্য জীবনী, আত্মজীবনী, বড় মানুষদের কথা আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য বিষয়। মাইকেল এইচ হার্টের এই বিশ্বখ্যাত বইটিতে একসাথে একশো জন মহামানবের উপস্থিতে বইটিকে আমার কাছে অনেক আকর্ষনীয় করে তুলেছে। এজন্য মাঝে মাঝে এই বইটা থেকে কয়েকজন মহামানবের জীবনের উপর দিয়ে একটু ভ্রমণ করে আসি। মহামানবদের জীবনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ভদ্রলোক অসাধারণ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার সাথে দ্বিমত করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তার যুক্তির কাছে বশ মানা ছাড়া সুযোগ খুবই সীমিত।
১২. অন লিবার্টি- জন স্টুয়ার্ট
জন স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদ বইটি সবচেয়ে বিখ্যাত হলেও ‘অন লিবার্টি’ আমার প্রিয় বইয়ের একটি। প্রথমবারের মতো দর্শনের যে বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম এবং কয়েকমাস সাথে সাথে রাখতাম সেটি ছিল ‘অন লিবার্টি’। অনেকগুলো লাইন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং দর্শনের জগতে একেবারে টেনে হিচড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বইটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
১৩. মাই এক্সপেরিমেন্টস উইদ ট্রুথ- মহাত্মা গান্ধী
গান্ধীর বিভিন্ন পলিসির সাথে আমি একমত হতে পারি না, তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ভয়ানক মতবিরোধ হয়। কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা ব্যক্তিত্বদের একজন হিসেবে গান্ধীর কথা বাদ দিতে পারি না। তার অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়ার জন্যই এ বইটির দ্বারস্থ হয়েছি।কয়েকবার এ বইটি পড়ার মাধ্যমে গান্ধীর অন্দরমহলের সাথে পরিচিত হয়েছি।
১৪. নেপোলিয়ন ইমমোর্টাল-জেমস কেম্বেল, জন মারি
আমার প্রিয় নায়কদের একজন নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের জীবন ও কর্ম আমাকে ছোটবেলা থেকেই অনুপ্রাণিত করে আসছে। এজন্য নেপোলিয়ন নিয়ে যখনই কোন লেখা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। নেপোলিয়নকে নিয়ে পড়া সেরা বইটি হচ্ছে ‘নেপোলিয়ন ইমমোর্টাল’ বইটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে কয়েক সপ্তাহ লাগিয়ে এই বড় বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম। লেখক দুজন এত সুন্দরভাবে নেপোলিয়নের ছবি একেছেন যেন মনে হবে পাঠক নেপোলিয়নের যুগে, নেপোলিয়নের পাশে দাড়িয়েই সব কিছু দেখছেন। থমাস কার্লাইল আর এমারসনের সাথে সাথে এই বইটি হতে পারে নেপোলিয়ন ভক্ত, শত্রু বা আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই।
১৫. ফ্রিডম এট মিডনাইট- ডমিনিক লেপিয়ার ও ল্যারি কলিন্স
ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস নিয়ে সেরা বইয়ের একটি। ইতিহাস এত মধুর ও সুখপাঠ্য হতে পারে এ বইটি দেখিয়ে দেবে। ইতিহাসের চরিত্রগুলো যেন কোন উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র হিসেবে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় চলে আসবে। লেখকদ্বয়ের কলমের তুলি এতই শক্তিশালী যে একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের চরিত্রায়নও অনেক স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছে। গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, মাউন্টব্যাটেন সহ প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের শেষ পঁঞ্চাশ বছর এবং সে সময়ের সবগুলো রাজনৈতিক উল্লম্ফন বর্ণিত আছে বইটিতে। একটি বই পড়ে যারা ওই পিরিয়ডটাতে দাঁত বসাতে চান তাদের জন্য এ বইটি বিনা দ্বিধায় হাতে নিতে পারেন। বইয়ের পাতায় ভ্রমনটা অসাধারণ উপভোগ্য হবে আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি।
১৬. মহাভারত
‘যাহা নেই (মহা)ভারতে তাহা নেই ভারতে।’ প্রায় দুইমাস লাগিয়ে রমেশ মেননের ইংরেজি অনুবাদে মহাভারত পড়ার পর এই বহুল প্রচলিত কথাটির সত্যতার উপলব্ধি হচ্ছিল। পাশ্চাত্যের সবগুলো প্রধান মহাকাব্যকে একসাথে করলেও মহাভারত বিষয় ব্যাপকতা, বিষয় বৈচিত্র্য, জৌলুশ দিয়ে সবগুলোকে হার মানাবে। বিশেষ করে গীতা পর্ব ও ভীষ্ম পর্ব আমার সবচেয়ে প্রিয়। এবং কর্ন ও ভীষ্ম আমার প্রিয় বীরদের দুজন। ভীষ্মের প্রজ্ঞা ও বীরত্ব এবং কর্নের বীরত্ব ও মহত্ব আমাকে টেনেছে। পাণ্ডবদের পক্ষে থাকা স্বাভাবিক হলেও মহাভারত শেষ করে উঠে কৌরব বীরদের প্রতি আমার মত সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কয়েক হাজার বছর ধরে ভারত তথা বিশ্বে প্রভাববিস্তারী এই বইটি পড়ে ফেলার জন্য সময় নিয়ে নেমে পড়তে পারেন।
১৭. ইলিয়াদ
গ্রিক বীর একিলিসের বীরত্ব এবং হেক্টরের দেশপ্রেম আমার আকর্ষনের বিষয়। এই মহাকাব্যটি গ্রেকো-রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী বইয়ের একটি। ইউরোপের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে এর প্রভাব অবিস্মরণীয়।ইলিয়াদের ভাষা, ভাবভঙ্গি, সমকালীন গ্রীক রাজনীতি ও সংকটের চিত্রায়ন তথা এর বিষয়-বৈচিত্র্য সববসময়ই পাঠকদের টানবে। হোমারের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে তিনি অনেক বড় বড় ঘটনার সাথে সাথে অত্যন্ত ছোট্ট কোন ঘটনারও চিত্রায়ন করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। ইলিয়াদ পড়া শুরু করলেই পাঠক চলে যাবে সুদূর গ্রিসে, দেখা হবে-কথা হবে-তর্ক হবে-যুদ্ধ হবে গ্রিকদের সাথে!
১৮. হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-বাট্রার্ন্ড রাসেল
দর্শনের জগতে ঘুরে আসার জন্য একটি অসাধারণ বই। ইংরেজি ভাষার একজন অসাধারণ গদ্যশিল্পী যে নিজেও একজন শক্তিশালী দার্শনিক তার কাছ থেকে তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের গল্প শুনার জন্য এই বইটি অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। রাসেলের গদ্য যেমন পাঠককে টানবে এবং প্রত্যেক দার্শনিককে নিয়ে করা তার মন্তব্য আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে।
১৯. দ্য গ্রেটেস্ট মাইন্ড এন্ড আইডিয়াজ অব অল টাইম-উইল ডুরান্ট
উইল ডুরান্টকে আমি আমার একজন শিক্ষক মনে করি। বিশেষ করে দর্শন ও ইতিহাসের তিনি এক অসাধারণ শিক্ষক।তিনি নিজেকে ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’(শেইমলেস ওরশিপার অব গ্রেট মেন) হিসেবে উপাধি দেন। নিজের মধ্যেও এই গুণ ডুরান্টকে আমার শিক্ষক বানিয়ে দিয়েছে। আমিও মহামানবদের পথের ধূলি গুনতে যে ভালোবাসি! উইল ডুরান্টের কাছ থেকে বড় মানুষদের গল্প শুনা একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রায় দুইবছর আগে পড়া ‘দ্য গ্রেটেস্ট মাইন্ড এন্ড আইডিয়াজ অব অল টাইম’ বইটি এখনো মনের মণিকোঠায় জায়গা করে রেখেছে। এখন উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’ পড়তে গিয়েও একইভাবে নাড়া খাই।’ সারা জীবন জ্ঞান সাধনার পেছনে বিলিয়ে দেওয়া মহান সাধকদের একজন হিসেবে উইল ডুরান্টের কাছ থেকে মহামানবদের গল্প শুনা সবসময়ই অনেক অনুপ্রেরণার।
২০. অসমাপ্ত আত্মজীবনী-শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চরিত্রটিকে নিয়ে একটি অসাধারণ বই। অবশ্য এক্ষেত্রে লেখক নিজেই নিজের বেড়ে উঠা, রাজনীতির জগতে প্রবেশের আলেখ্য এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প তুলে এনেছেন। কিন্তু আফসোস থেকে যাবে এই কারণে যে মাত্র ৩৪ বছর অবধি (১৯৫৪ সাল) অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। যদি আরও সময় পাওয়া যেতো হয়তো ১৯৭১ এ পৌছতে পারতেন। সেটা হলে একটি অসাধারণ কাজ হতো। কিন্তু আফসোস থাকলেও সন্তুষ্টি এই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা কয়েক হাজার বইয়ের মধ্যে প্রথম সাড়িতে রাখার মতো বই পাওয়া গেল।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
মানবদেহে আদার অনেক উপকার
আমাদের দিনে কয়েকবার রঙিন খাবার খাওয়া উচিত, কিন্তু আপনি কিবিস্তারিত পড়ুন
হোটেল ঘরে বিছানার চাদর সাদা হয় কেন ?
বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকে প্রথম যে বিষয়টি নজরে আসে,বিস্তারিত পড়ুন
ধনিয়া পাতার উপকারি গুণ
চিকিৎসকদের মতে, ধনে বা ধনিয়া একটি ভেষজ উদ্ভিদ যার অনেকবিস্তারিত পড়ুন