সকালে পত্রিকা পড়তে চেয়ে জানলাম হকার আজ পত্রিকা দেয়নি। মুঠোফোনে নিলাম হকার ছেলেটিকে। কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘স্যার গলির মুখে ঢোকার আগেই পত্রিকা হাইজ্যাক হয়ে গেছে।’ অবাক হলাম। পত্রিকাও আবার হাইজ্যাক হয় নাকি! জানতে চাইলাম, ‘হাইজ্যাক হয়েছে মানে?’

‘কেড়ে নিয়ে গেছে, স্যার।’ অসহায়ের মতো উত্তর দিল ছেলেটি। ‘তবে ডাবল দাম দিয়েছে।’
‘বাসায় পত্রিকা না দিয়ে দ্বিগুণ দামে বেচে দিলে! কাজটা কি ঠিক হয়েছে?’

মনে হলো ছেলেটি ওপাশ থেকে হেসে কথা বলছে, ‘আমার কী দোষ বলেন? শাকিব খানের খবর পড়ার জন্য কাড়াকাড়ি লেগে গেছে।’

গতকাল বিকেল থেকেই শহরের আলোচিত বিষয় শাকিব খানÑঅপু বিশ্বাসের বিয়ে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অপু বিশ্বাসের একান্ত সাক্ষাৎকারে জানাজানি হয় বড়পর্দার এই তারকা দম্পতির বিয়ের খবর। সাত মাসের ফুটফুটে শিশু আব্রাহম খান জয়কে টিভি পর্দায় দেখে অনেকেই বলছিলেন, ‘্আহা! কী ফুটফুটে শিশু! এমন ছেলে রেখে শাকিব খান দূরে থাকেন কীভাবে?’

কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন অপু। খেদ, ক্ষোভÑ তাও ছিল। চোখের পানিতে অপু বলছিলেন, ‘আমি এখন ভাবছি আমার ছেলের কথা। আমি এখন যদি এই প্রতিবাদটা না করতাম, এই কথাটা না বলতাম তাহলে ইন ফিউচার ওকে নিয়ে যখন কথা হবে তখন আমি হাস্যকর হয়ে যেতাম। এই কথাটি আমি শাকিবকে বারবার বলেছি, এমন কোনো ঘটনা ঘটিয়ো না যাতে আমাকে ছোট হতে হয়। কারণ এটাই তো সংসার। সংসার তো দুজনকেই ঘিরে হয়। সংসার তো একা হয় না।’

জীবন আর সিনেমা দুটো আলাদা। কিন্তু অপু বিশ্বাসের মুখে তার সঙ্গে শাকিবের বিয়ের সংবাদ সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। এর আগে কোনো সেলিব্রেটি এভাবে টিভি পর্দায় এসে দাম্পত্য জীবন নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, এমন নজির নেই। হ্যাঁ, পত্রিকায় এসেছে। সেখান থেকে মানুষ জেনেছে।

গোপন বিয়ের খবর জানিয়ে দেয়ার পর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়ার অন্ত নেই। কেউ বলছেন, শাকিব অন্যায় করেছেন। এটা করা তার ঠিক হয়নি। এভাবে ফুলের মতো শিশুর জনকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ মেনে নেয়ার মতো না। আবার কেউ কেউ আঙুল তুলেছেন অপুর দিকে। তার অপরাধ কেন তিনি গোপনে বিয়ে করতে গেলেন। তাও নয় বছর আগে? তবে এই ধরনের মন্তব্যকারীদের সংখ্যা হাতে গোনা। বেশির ভাগই তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের হোক এই কামনা করেছেন।

অপু-শাকিবের ঘটনা আবার প্রমাণ করল এই সমাজে যা-ই ঘটুক, দোষটা নারীকেই বেশি দেয়া হয়। কেন অপু গোপনে বিয়ে করতে গেলেনÑ এই প্রশ্ন যারা তুলছে, কই তারা তো বলছেন না, কেন গোপনে বিয়ে করার প্রয়োজন হলো শাকিব খানের? ক্যারিয়ার? ঠিক আছে নয় বছর গোপন রেখেছেন ক্যারিয়ারের কথা ভেবে। ফুলের মতো শিশুটি যখন অপুর কোল আলো করল তখন প্রকাশ্যে আসতে সমস্যা কোথায় ছিল? অপুকে স্ত্রীর মর্যাদা দিলে ক্যারিয়ারের কী এমন ক্ষতি হতো? শাকিব খান কি কখনো এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন? হিরো-হিরোইনদের বিয়ে তো নতুন কিছু নয়! বাংলা চলচ্চিত্রের যারা পথ দেখিয়েছেন তারা কি বিয়ে করেননি? তাদের কি পারিবারিক জীবন, দাম্পত্যের বন্ধন বলে কিছু ছিল না? নাকি তাদের গ্লামার কমে গিয়েছিল? এমনও অনেক নায়ক-নায়িকা আছেন যারা সিনেমায় জনপ্রিয় হওয়ার পর বিয়ে করেছেন। তাদের কি অভিনয় ছেড়ে দিতে হয়েছে? হয়নি। বরং তাদের পেশাগত মর্যাদার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পারিবারিক বন্ধনে থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন, কাটাচ্ছেন।

আপসোস, সিনেমার হিরো শাকিব খান ব্যক্তিজীবনে হিরো হতে পারেননি। গোপনে বিয়ে করা তো দোষের নয়। একটা দীর্ঘ সময় না হয় গোপন ছিল। কিন্তু আব্রাহাম খান জয়ের আগমনের খবর দিয়ে চমকে দিতে পারতেন সবাইকে। এতে ‘ক্যারিয়ার হুমকির’ মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকত না।

বলতে গেলে বাংলা চলচ্চিত্রে শাকিব খানের এখন একক রাজত্ব। বাকি যারা আছেন তারা কম না হলেও শাকিবের চাহিদা একটু বেশিই। অপুর টিভি সাক্ষাৎকারকে শাকিব দেখছেন ষড়যন্ত্র হিসেবে। তিনি বলেছেন, তার জনপ্রিয়তায় ধস নামতে এটা চক্রান্ত। আচ্ছা, ধরেই নিলাম এটা চক্রান্ত। কিন্তু এই চক্রান্ত করার সুযোগ তো শাকিব নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। তাদের জীবনটাকে যদি সিনেমা ধরে নেই, তবে নায়কের সুখের সংসারে ভিলেনের অনুপ্রবেশের রাস্তা তৈরি তো নায়ক নিজেই করেছেন। কী, করেননি? তিনি যদি আগে থেকেই প্রকাশ্যে স্ত্রী-সন্তানের স্বীকৃতি দিতেন, তবে কি আর এই চক্রান্ত কিংবা ষড়যন্ত্রের পথ থাকত?

তবে অপুর টিভি সাক্ষাৎকারের পর সামাজিকভাবে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের একটা ছবি ফুটে উঠেছে সহজেই। নারীদের অগ্রযাত্রার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে খুব। নারীদের মুখ বন্ধ করে ঘরের কোনায় ফেলে রাখার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তারা এখন সবাক। বলতে শিখেছে। অপুর পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছেন চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ। নারী জাগরণ, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দিন দিন বদলে যাচ্ছে। নারীকে নারী নয় মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন শুরু হয়েছে অনেক আগেই। দর্শকের সামনে এসে অপু তার প্রমাণ দিয়েছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন নারী হিসেবে তার আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর অধিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। চাইলেই কেউ তাকে ছোট করে কিছু বলতে পারে না। অপু বলেছেন ‘আমি অনেক সহ্য করেছি, আমার কথা শুনে আর দশটা মেয়ের সাথে মিলায়ে দেখেন, আমি আর কত সহ্য করব? ওর বোন আছে, ওর বোনও বিবাহিত, ওর বোন করবে? একবার ওর বোনের কাছে উত্তর নিয়ে এসে আমাকে বলুক। ওর বোন করবে? বিন্দু পরিমাণ করবে? আমি তো মানুষ, আমি মেয়ে মানুষ। আমার ভিতরেও ভালো-মন্দ আছে। আমি কত সহ্য করব? আমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করিনি। আমি চেয়েছি ও ভালো থাকলে আমি ভালো থাকব। কিন্তু যে মানুষ আমি তার ভালো চাচ্ছি, সে আমাকে ছোট করে দিয়েছে। আমাকে কেন ছোট করা হবে, আমাকেও তো জানে, আমি কেন ছোট হব? এ কথাটা আমাকে (শাকিব) উত্তর দিক।’

এই লেখা যখন শেষ পর্যায়ে তখন একটি অনলাইন সংবাদপত্রের খবরে পড়লাম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারজীবন শুরুর কথা বলেছেন শাকিব খান। বাহ্! বেশ তো। অপুসহ সবার চাওয়া তো এটাই ছিল। বাংলার কিং খান খ্যাত শাকিবপুত্র আব্রাহাম খান জয় বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখে বড় হবেÑ এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে!

মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) ওই অনলাইন সংবাদপত্রকে শাকিব বলেছেন, ‘গতকাল যখন অপুকে টিভিতে লাইভে দেখলাম আমার ছেলেসহ তখন রেগে গিয়েছিলাম। নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। অনেক কথাই বলে ফেলেছি। তবে এখন উপলব্ধি করছি অপু আমারই স্ত্রী, আব্রাহাম আমারই সন্তান। ওদের নিয়েই আমাকে থাকতে হবে।’ অপুকে জানিয়েছেন বিষয়টি? জানতে চাইলে শাকিব বলে, ‘না। এখনো জানাইনি। তবে শিগগিরই ফোন দেব ওকে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ছেলেকে নিয়ে যেন সুখী হতে পারি।’

আমরাও কামনা করি, জয়কে নিয়ে সংসারের ভাঙা হাট আবার জমে উঠুক।