ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টি স্পট এখন মাদকসেবীদের দখলে!
গৌরব, ঐতিহ্য আর অর্জনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতির ইতিহাসের অনেক গৌরবোজ্জল অধ্যায়গুলো রচিত হয়েছে এই ক্যাম্পাসে। তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৮টি স্পট এখন ছিন্নমূল মাদকসেবীদের দখলে। দিনের বিভিন্ন সময় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞা করে সেস্থানগুলোতে বসছে মাদকসেবীদের আড্ডা। মাঝে মধ্যে পুলিশি অভিযান চালানো হলেও থামছে না মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তার ফুটপাতে বসে দিনের বেলা গাঁজা, ড্যান্ডিসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক নিচ্ছে বেশ কিছু ছিন্নমূল মাদকসেবী। এছাড়া শহিদুল্লাহ হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলের গেট বরাবর আসন পেতে বসে ইঞ্জেকশন নিতে দেখা যায় কিছু লোককে। শহিদুল্লাহ হলের দক্ষিণপাশের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা অমর একুশে হলে যাবার রাস্তায় ছিন্নমূলরা তাদের ‘স্থায়ী আবাস’ বানিয়ে নিয়েছে। আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে একুশে হলের ছাত্রসহ অন্যান্য সাধারণ পথচারীদের।
এছাড়া নবনির্মিত কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে নীর্মিত ফুট ওভারব্রিজটিও এখন ছিন্নমূলদের দখলে। এরকম অন্তত ২৭/২৮ টি স্পট এখন ছিন্নমূল মাদকসেবীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
এতে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের চলাফেরার স্বাভাবিক পরিবেশ, অপরদিকে মাদকের প্রতি তাদের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।
কবি সুফিয়া কামাল হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানা মীম বলেন, ‘হলের ছাত্রীদের কার্জন হলে প্রবেশের সুবিধার্থে ফুট ওভারব্রিজ বানানো হয়েছিল। কিন্তু ওভারব্রিজের উপর দিয়ে গেলে মাঝে মাঝে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ওখানে কিছু লোক শরীরের এমন স্থানে ইঞ্জেকশন নেয়, যা একজন মেয়ের পক্ষে দেখা খুবই বিব্রতকর। যার কারণে ওভারব্রিজের উপর দিয়ে মেয়েরা কম যায়। সবাই নিচ দিয়েই যায়, নিচ দিয়ে যাবার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে।’
অমর একুশে হলের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান জানান, ‘একুশে হলের রাস্তায় ছিন্নমূল মাদকসেবীদের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের। কেননা ক্যাম্পাস থেকে হলে আসার এই একটিমাত্র রাস্তা। রাস্তা দিয়ে আসতে যেতে নিয়মিত আমদের এ পরিস্থিতি দেখে যেতে হয়। ফুটপাতে বসে কেউ গাঁজা খায়, কেউ হেরোইন নেয় আবার কেউ বা ইঞ্জেকশন নেয়। এনিয়ে প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই।’
ক্যাম্পাসে মাদকের এমন চিত্র নিয়ে কথা হয় শহিদুল্লাহ হলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আবু হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি হলের বর্ধিত ভবনের তৃতীয় তলায় থাকি। আমার রুম থেকে প্রাচীর ঘেঁষা রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। ঐ রাস্তার দক্ষিণ পাশে রাতের বেলা তো বটেই দিনের বেলাতেও মাদক কেনাবেচা করতে দেখা যায়। আর ছিন্নমূল লোকজন তো আছেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ছাত্র যেকোনো কারণে হতাশ হতেই পারে। আর এরকম অবস্থায় যদি কেউ হাত বাড়ালেই মাদক পেয়ে যায়, তবে সে সেটা গ্রহণ করবেই।’
এছাড়া ছিন্নমূল মাদকসেবীদের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও। কবি জসীম উদ্দীন হলের ছাত্র হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাতে চানখারপুলে খেতে যাবার সময় মনে হয়, এটা আমার ক্যাম্পাস না, আমি বুঝি কাওরান বাজারের রেললাইন ধরে হাঁটছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক সেবন বিষয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, ‘মাদক হলো সমাজের ক্যান্সার। একবার যে মাদকের প্রতি ঝুঁকে যায় তার জন্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা খুবই কষ্টকর। কোনো মানুষের মাদকাসক্ত হবার প্রধান কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা।’
তিনি আরো জানান, ‘বিভন্ন সময় আমাদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা আসে মাদকাসক্তির সমস্যা নিয়ে, যাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মাদক নেওয়া শুরু করেছে। আমরা তাদেরকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফেরত নিয়ে আসার চেষ্টা করি। অনেকে ফিরে আসে আবার কেউ কেউ পুনরায় মাদক নেয়। যদি মাদকের সহজলভ্যতা কমানো না যায় তবে কোনো কিছুতেই লাভ হবে না।’
ফটকের সামনেই ছিন্নমূলদের বিষয়ে কথা হয় শহিদুল্লাহ হলের নিরাপত্তা প্রহরী নজরুল ইসলামের সাথে। তিনি দেখালেন ডান হাতে পাওয়া কয়েকবছর আগে পাওয়া আঘাতের ক্ষত। তিনি জানান, ‘ওদের আশেপাশে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা জিহবার তলে ব্লেড রাখে। কাছে খুরও থাকে। আর ওদের কাছে যে সিরিঞ্জ থাকে সেটাও ফুটিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। আবার বলে চানখারপুল, গুলিস্থানে যাবি না? তখন দেখে নিমু।’
হলগুলোর প্রাধ্যক্ষরাও যেন এক্ষেত্রে অনেকটা ‘নিরুপায়’। অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন ‘এ বিষয়ে প্রক্টর অফিসসহ সিন্ডিকেট মিটিংয়ে কথা বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। পুলিশ মাঝে মাঝে কিছু মাদক বিক্রেতাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এই ছিন্নমূলদের কিছুই বলে না। এতে লাভের লাভ কিছুই হয় না।’
এসব অভিযোগ নিয়ে প্রক্টরিয়াল বডিরও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তবে তা অস্বীকার করেছেন প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘চানখারপুল থেকে বঙ্গবাজার মোড় এবং হাইকোর্ট মোড় থেকে বঙ্গবাজার মোড়ে রাস্তার সার্বিক নিরাপত্তা দেখভাল করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও শাহবাগ থানা। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম এ রাস্তায় টহল দেয়। যখন যাদেরকে পায় তখন সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।’
স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ফরিদ আহমেদ রতনের অভিযোগ, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা পুলিশের কাছে দেওয়া হলেও তাদের ধরা হয় না।’ তবে সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশ।
শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘সন্ধ্যার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাদকসেবীদের আনাগোনা একটু বেড়ে গেছে। তবে আমরা চেষ্টা করে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে পেরেছি।’
কমিশনারের দেওয়া তালিকার বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘কেউ কারো নামে অভিযোগ করলেই তো আর আমরা তাকে গ্রেফতার করতে পারি না, আমাদের বিষয়টা আগে যাচাই-বাছাই করতে হয় তারপর ব্যবস্থা নিতে হয়।’
ছিন্নমুল মাদকসেবীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওদের আমরা ধরে এনে কোথায় রাখব? ওদের গা-হাত-পায়ের যে অবস্থা তাতে অন্যান্য বন্দিদের সাথে একই হাজতখানায় ওদের রাখা যায় না। আমরা আমাদের সামনে যাদের দেখি, তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিই।’
তিনি আরো বলেন, ‘একা পুলিশের পক্ষে সবকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব না। কোনো বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হলে সকলের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার আহবান জানান। প্রিয়.কম
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
কোকেনের সবচেয়ে বড় চালানে জড়িতদের নাম পেয়েছে ডিএনসি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান জব্দের ঘটনায়বিস্তারিত পড়ুন
শপথ করছি, মাদক ছোঁব না
মাইকে ঘোষণা হলো ‘এখন মাদকের বিরুদ্ধে আমরা শপথ নেবো’। শপথবিস্তারিত পড়ুন
ক্ষতি বছরে ১ লাখ কোটি ডলারঃ ধুমপানের পিছনে
ধুমপানে প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয় এক ট্রিলিয়ন বাবিস্তারিত পড়ুন