তৃণমূলেও কেন্দ্রের হানা, ফখরুল একাই পাঁচ পদে!
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান “এক নেতা-এক পদ” নীতিতে বিশ্বাস করলেও তার দলে এখন আর সেই নিয়ম চলে না। বর্তমানে দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত অনেক নেতার দখলে আছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ। অনেক নেতা উপজেলার পদও আঁকড়ে ধরে আছেন। শীর্ষ নেতাদের এমন প্রতিযোগিতায় তৃণমূলের পদপ্রত্যাশীরা ক্ষুব্ধ।
এ নিয়ে আলাপকালে বিএনপির এক নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, ভাই আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য যেসব কারণকে দায়ি করা হচ্ছে তাদের মধ্যে এটি অন্যতম।
অবশ্য একাধিক পদধারী নেতা গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বলছেন, দল থেকে একাধিক পদে না থাকার নির্দেশনা আসলে ছেড়ে দেয়া হবে অতিরিক্ত পদ। অন্যদিকে তৃণমূলের নেতারা বলছেন, “এরা গাছেরটাও খাবেন, আবার তলারটাও কুড়াবেন। কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত সব পদ তাদের দরকার।”
অনেকদিন ধরে বিএনপিতে এমন রীতি চললেও সবাই যেন নির্বিকার। প্রতিবাদের ভাষা নেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। বিষয়গুলো সম্পর্কে দলের শীর্ষ মহল অবগত থাকলেও এর সমাধানে নেই কোনো উদ্যোগ।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে এক নেতার একাধিক পদে থাকার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকলেও গঠনতন্ত্রে একই ব্যক্তিকে দলের একাধিক স্তরে সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হতে নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। আর দলের পক্ষ থেকে একাধিকবার মৌখিক নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও একে থোরাই কেয়ার করছেন না পদ আক্রে থাকা নেতারা। এসব নিয়ে চেয়ারপারসনের দপ্তরে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়লেও নেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। ফলে বারবারই তৃণমূলের যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা থেকে যাচ্ছেন পেছনের সারিতে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই একাধিক পদ আক্রে থাকার অভিযোগ আছে। রাজনীতিতে সজ্জন বলে পরিচিত মির্জা ফখরুলেরই দখলে আছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। যদিও তার তৎপরতা দেখা যায় দুটি পদকে ঘিরে।
কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকানুযায়ী ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে আছেন। অন্যদিকে দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর ২০১১ সাল থেকে পালন করছেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব। পদাধিকার বলে তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্যও। শুধু তাই নয়, প্রায় নয় বছর ধরে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও তিনি। আবার নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও বিএনপির সভাপতির দায়িত্বেও আছেন মির্জা ফখরুল।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বেলাও তাই। খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এই নেতা একবছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক। নেতাকর্মীদের ভাষ্য-অনেক আশা নিয়ে মহানগরের দায়িত্ব দিলেও প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন মির্জা আব্বাস।
স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মহানগর আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা পদে আছেন আ স ম হান্নান শাহ, রফিকুল ইসলাম মিয়া। এদের মধ্যে হান্নান শাহর দেখা মিললেও দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে আছেন রফিকুল ইসলাম। একই দায়িত্বে আছেন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। যিনি অনেক দিন ধরে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে। আর স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আছেন সদস্য হিসেবে।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী একই সঙ্গে পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে খুব বেশি তৎপরতা না থাকলেও এই নেতা তৃণমূলের চেয়ে ঢাকায় বেশিরভাগ সময় অবস্থান করে বলে জানা গেছে।
একই পদের রাবেয়া চৌধুরীর দখলে আছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ। বয়সের কারণে তার কোথাও খুব বেশি সময় দেয়ার সুযোগ হয় না বলে জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সভাপতি। তবে সম্প্রতি তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। রাজনীতির ফাঁকে আইন পেশায় ব্যস্ততা আছে এই খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর দখলে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ। আবদুল মান্নান খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার পাশাপাশি ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতির পদে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। উপদেষ্টাদের মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতিও বটে।
আর আইনজীবী রাজনীতিক অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খানও উপদেষ্টার বাইরে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতির আসনে আছেন।
বেশ কয়েক মাস কারাগারে থাকা সাবেক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদু একদিকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন।
এছাড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে আবদুল আউয়াল মিন্টু, এম এ কাইয়ুম ঢাকা মহানগর বিএনপির শীর্ষ পদে আছেন।
আমান উল্লাহ আমান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্যও। আন্দোলন সংগ্রামে তো দূরের কথা দীর্ঘদিন ধরে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। একই পদের অন্য নেতা মো. শাহজাহান নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি। জেলায় না গেলেও ঢাকায় ব্যস্ত আছেন দল পুনর্গঠন মনিটরিংয়ের কাজে। আর মিজানুর রহমান মিনুর দখলে আছে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ। বিএনপির দপ্তর সম্পাদকও একই পদের অধিকারি দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি রুহুল কবির রিজভী। আর আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমদের দখলে আছে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতির পদ। আর বরকত উল্লাহ বুলু আছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য পদে।
এদিকে মজিবর রহমান সরোয়ার একাই তিনটি পদ সামাল দিচ্ছেন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, শ্রমিক দলের উপদেষ্টা, অন্যদিকে বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সম্প্রতি জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সাংগঠনিক নেতা হিসেবে সুনাম থাকলেও গত দুই দফার আন্দোলনে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা ছিল না সরোয়ারের।
আরেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি। রংপুর বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু একই সঙ্গে দলের গ্রাম সরকার সম্পাদক। লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতিও তিনি।
শীর্ষ নেতাদের মতো এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বিএনপির সম্পাদক পর্যায়ের নেতারাও। সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূঁইয়া লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। আবার ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা। সাবেক চিফ হুইপ ও দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক সম্প্রতি সভাপতি হয়েছেন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা বিএনপির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “দল থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। এলে আমরা সিদ্ধান্ত মেনে নেব। কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই আমি সভাপতি হয়েছি। যদি কেন্দ্র সিদ্ধান্ত পাল্টায় আমরাও সিদ্ধান্ত পাল্টাবো।”
রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি নাদিম মোস্তফা কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সম্পাদক পদে রয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক কবির মুরাদ মাগুরা জেলা বিএনপির সভাপতি। তিনি জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সভাপতি। সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক। তিনি কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি। ফরিদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাদা মিয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শিল্প সম্পাদক। আন্তর্জাতিক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী একই সঙ্গে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু কেন্দ্রীয় কমিটির স্ব-নির্ভর সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি। দলের যুব বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুবদলের সভাপতি। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য। কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন। নব্বইয়ের গণভ্যুত্থানের সাবেক ডাকসু নেতা। তিনি নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতিও। গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ তার দখলে।
অন্যদিকে তার সহধর্মিণী শিরিন সুলতানা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক সহ-সম্পাদক। তাকে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে চিনেন দলের নেতাকর্মীরা।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল কেন্দ্রীয় কমিটির স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বিএনপির সদস্য সচিবও তিনি। দলের সহ-আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি। সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নুরে আরা সাফা মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি।
এসব নেতার কারণেই অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে নেতৃত্বের জট সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি নেতাকর্মীদের। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, একাধিক পদ ছেড়ে দিলে বাকিদের পদে থেকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।
এজন্য তারা একাধিক পদধারী নেতারা দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন কিনা সেই জবাবদিহিতা না থাকাকে দায়ি করছেন। ঠিকমতো কাউন্সিল না হওয়াকেও অন্যতম কারণ বলছেন অনেকে।
যুবদলের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “একাধিক পদ দখলে আছে এমন নেতারা বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকছেন। নির্বাচনে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে এলাকার পদও দখলে রাখেন। ঠিকমতো কাউন্সিল হলে এমনটা হতো না।”
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে দল পুনর্গঠনের ঘোষণার পর একাধিক পদধারী নেতারা পদ ধরে রাখতে তৎপর হয়ে উঠছেন। তরুণদের মধ্যে অনেকে অঙ্গ সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ারও চেষ্টা করছেন বলে গুঞ্জন আছে। যদিও খালেদা জিয়া আন্দোলনে ভূমিকা বিবেচনা করে পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, “একাধিক পদে থাকা নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করে এটা ঠিক। গঠনতন্ত্রে না থাকলেও বিষয়টি এড়ানোর জন্য মৌখিক নির্দেশনা আছে। তবে কোথাও কোথাও নেতাকর্মীদের আগ্রহে একাধিক পদে থাকতে হচ্ছে।”
আর সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “পদবিন্যাসের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই বাধা। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে ঠিকমত কাউন্সিল না হওয়ায় এমনটা হয়েছে। কাউন্সিলকে সামনে রেখে কাজ চলছে। আশা করি কাউন্সিলে সমস্যাটা অনেকাংশে দূর হবে।” ঢাকটাইমস
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ফের ২ দিন রিমান্ডে আনিসুল হক
রাজধানীর বাড্ডা থানার স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা আল-আমিন হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
জামিন পেলেন সাবেক বিচারপতি মানিক
অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকেবিস্তারিত পড়ুন