দলের জন্য কখনই তিনি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি যিনি, তার নামই মাশরাফি
ইনজুরির সঙ্গে যুদ্ধ করে খেলা চালিয়ে গেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। দুই হাঁটুতে ছোট-বড় সাতবার অস্ত্রোপচার হওয়া বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। সার্জনের ছুরি-কাঁচি এতবার দুই হাঁটুর ওপর দিয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতে একই ধরনের চোটের পর অস্ত্রোপচার করার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও নাকি তার হাঁটু দুটিতে নেই! তারপরও কীভাবে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন মাশরাফি? বাংলাদেশের ‘সব ক্রিকেটারের কোচ’ নাজমুল আবেদিন ফাহিম শুরুর সময় থেকে মাশরাফিকে দেখে আসছেন। তার কাছেও নেই এ প্রশ্নের উত্তর। তিনি কেবল বললেন, ‘ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বোচ্চ নিংড়ে দিয়ে খেলার উৎসাহ কোথা থেকে মাশরাফি পায় আমি জানি না। হয়ত এটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত পাওয়া। ’
ক্যারিয়ারের সবশেষ আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন মাশরাফি। ওয়ানডে ফরম্যাট চালিয়ে যাবেন আরও কিছুদিন। তারপরও বিষাদের মেঘ কাটেনি। ৪ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টুয়েন্টি ম্যাচে টসের সময় মাশরাফির মুখ থেকে অবসরের ঘোষণা আসতেই বাংলাদেশের মানুষের মনের আকাশে মেঘ। ক্রিকেট ভক্তদের মানতে কষ্ট হচ্ছে টি-টুয়েন্টিতে দেখা যাবে না সবার প্রিয় এই ক্রিকেটারকে। তবে বারবার ইনজুরি হুমকির মুখেও মাশরাফি কিভাবে ক্রিকেট ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়েছেন, সে সম্পর্কে চ্যানেল আই অনলাইনকে নিজের ভাবনা জানালেন নাজমুল আবেদিন।
শত ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আসা মাশরাফি: একটা সময় ছিল, মাশরাফি আদৌ ক্রিকেট খেলতে পারবে কিনা সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। ভাল খেলবে কি খারাপ খেলবে এটা তো অনেক পরের ব্যাপার। ও যখন ইনজুরি থেকে ফিরে আসছে, প্রক্রিয়াটা অনেক লম্বা ছিল। শূন্য থেকে নয়, ওকে শূন্যেরও পেছন থেকে শুরু করতে হয়েছে। সামনে এমন কোন নিশ্চয়তা ছিল না মাশরাফি আদৌ মিনিমাম ফিটনেস ফিরে পাবে কিনা। আদৌ ক্রিকেট খেলতে পারবে কিনা। ওর যতগুলো অর্জন আছে তা সম্পর্কে সবাই জানে। ও অধিনায়ক হিসেবে ফেরার পর বাংলাদেশ কতটা বদলে গেছে সেটাও। পেছনের গল্পটা হচ্ছে, একটা মানুষ আদৌ জানে না খেলতে পারবে কিনা তারপরও তার যে চেষ্টা, পরিশ্রম, খেলার জন্য ভালোবাসা, সেটাই আসল।
ওই লেভেলে খেলার জন্য যে ভেতরের মোটিভেশনটা কই থেকে মাশরাফি পায়, আমি জানি না। ইনজুরির সময়টা পরিশ্রমের সময়, খুব কষ্টের সময়। এটা একটা মানুষ একদিন-দুইদিন পারে। মাসের পর মাস এটা করা সম্ভব না। অন্য যে কেউ হলে হাল ছেড়ে দিত। ও হাল ছাড়েনি। এ ধরণের সময় যখন একটা মানুষ পার করে আসে, তখন জীবনের হিসাব, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন আসে। আমরা যেমনভাবে অনেক কিছু চাই, পাই এবং এগুলো নিয়ে অনেক কিছু থাকে। মাশরাফি এসব থেকে একটু বাইরে। ওই সময়টায় যে ও খেলতে পারেনি তা কিন্তু নয়। ওকে চিন্তা করতে হয়েছে পরিবার কিভাবে চলবে। আজকের মাশরাফি অর্থনৈতিকভাবে হয়ত শক্তিশালী। কিন্তু ওই সময়ে আর্থিক চিন্তা করতে হয়েছে। এসবকিছু পার করে আসা একজন পরিশ্রমী মানুষ ও।
ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা: এসবকিছু পার করে আমরা মাশরাফির হাত ধরে যে সফলতা পেয়েছি, ওর নিজস্ব যেমন একটা অংশগ্রহণ আছে, তাতে সৃষ্টিকর্তারও একটা হাত আছে। হয়তো ও কিছু পেয়েছে। খেলা করে ও কী অর্জন করল তার চাইতে ওর যুদ্ধ করাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়। ওই সময়টায় পৃথিবীতে খুব কম মানুষই হাল ছাড়বে না। আমার চোখের সামনেই দেখা। এরপর ও যখন খেলল, আমি ওকে যখন দেখি, ইনজুরি নিয়ে খেলে আবার যেকোনো সময় ইনজুরি আক্রান্ত হতে পারে, তবুও সেসব জেনেই সবচেয়ে কঠিন বলটা ধরতেও এক বিন্দু পিছপা হয় না কখনো। মানুষের স্বভাবগত চেষ্টা থাকে নিজেকে একটুখানি বাঁচানোর। আমি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি ওর মধ্যে এই জিনিশটা একেবারেই নেই। সাধারণ একটা বল হয়তো ১ রান হবে, হয়তো হবে না। সেটা বাঁচাতে ওর যে চেষ্টা, সেটা ওর চরিত্রের বিশেষ গুন। ও যখন খেলে শতভাগ দিয়ে খেলে। অনেকবার এই জিনিশটা আমি দেখেছি।
পারফর্মার মাশরাফি: ইনজুরির পর মাশরাফি যখন খেলা শুরু করে.. আমার মনে হয় এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় প্রতি ম্যাচেই শতভাগ দেয়া। তিন-চারটা করে উইকেট পাওয়া। ব্যাটে রান করা। ওর যে ক্যারিয়ার রেট তা অন্য যেকোনো প্লেয়ারের চেয়ে বেটার। বিশেষ করে বোলিংয়ের ক্ষেত্রে প্রায় ম্যাচেই কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময়ই একটা ব্রেক থ্রু আনা, রান কম দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা।
প্লেয়ার মাশরাফি: দলের জন্য মাশরাফি কখনই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি। সে প্লেয়ার হিসেবে সবসময় আমাদের জন্য জরুরী ছিল এবং আছে। দলের জন্য সবসময় ভালো ভূমিকা রেখেছে। অধিনায়ক হিসেবে নয়, প্লেয়ার হিসেবে।
উদাহরণ তৈরি: আমরা তো সারাজীবন গল্প শুনেছি ওই দেশের অমুক, ওই দেশের অমুক প্লেয়ার। উদাহরণ হিসেবে বাইরের দেশের প্লেয়াররাই এসেছে। এটা একটা বিরাট জিনিস যে আমাদের এখন বাইরের দিকে তাকাতে হয় না। আমরা বলতে পারি দারুণ একজন ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, বলতে পারি দারুণ একজন বোলার সাকিব আল হাসান। বলতে পারি দারুণ একজন অধিনায়ক, দারুণ একজন মানুষ মাশরাফি বিন মর্তুজা। উদাহরণ দাঁড়িয়ে গেছে। মাশরাফি অবসরের সিদ্ধান্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মাশরাফির প্রভাব হয়তো তরুণ সমাজের মধ্যে আরও বেশি।
লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট: ড্রেসিরুমের ভেতরে আমি যাইনি। সেখানে মাশরাফি কিভাবে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে সেটা জানি না। তবে আমার মনে হয় পারস্পারিক সম্পর্কটা এমন রাখে সবাই নিজেকে এক্সপ্রেস করার জায়গা পায়। স্বাধীনতা দেয়, সবাইকে গুরুত্ব দেয়। এগুলো হয়তো খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করে। সবাই অনারশিপটা পায়। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্টগুলোতে কিন্তু মাশরাফি কিছু না কিছু করে। ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ যেটাকে বলে। প্রয়োজনের সময় কিন্তু ও কাজটা করে দেয়। কৃতিত্বটা ভাগ করতে পারে। ও নিজে নেয় না। সেটা দলের মাঝে ভালো পরিবেশ তৈরি করার কারণ।
টি-টুয়েন্টি থেকে অবসর কতটা সঠিক?: আমার ধারনা এখন মাশরাফি যে অবস্থায় আছে… টি-টুয়েন্টি খেলার ইনটেনসিটি কিন্তু অনেক বেশি। অনেক অনেক বেশি। এটা হয়তো একদিক থেকে ওর জন্য ভালো হলো। বয়সের একটা ব্যাপার আছে, ফিটনেসের একটা ব্যাপার আছে। টি-টুয়েন্টির যে ডিমান্ড সেটা ফুলফিল করতে গিয়ে হয়তো ইনজুর্ড হয়ে যেতে পারে। এমনটা হলে ওয়ানডেতে যে মাশরাফিকে পাওয়ার কথা সেটা নাও পেতে পারি। সেদিক থেকে আমি বলব এটা হয়ত ঠিক আছে। তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই, সম্মান জানাই। ওর সামনে যে ক্রিকেট বাকি আছে সেটা যেন লম্বা সময় ধরে থাকে। অনেক দিন ধরে সম্মানের সাথে বাংলাদেশ টিমের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে পারে এই দোয়াটা থাকল। আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশ ওর অধীনে আরও পরিণত একটা দল, ভালো একটা দল পাবে। যখন অবসর নেবে তার আগে কার্যকরী একটা ওয়ানডে দলের জায়গায় বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে।
‘মাশরাফি’ ইমেজ: ক্রিকেট ছাড়ার পরও হয়তো মাশরাফি ক্রিকেটের দারুণ একটা দায়িত্বে থাকবে। ওর যে ইমেজটা সেটা কাজে লাগাবে। আমাদেরও দায়িত্ব থাকবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে মাশরাফির চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার। মাশরাফি সবার রোল মডেল হিসেবে দাঁড়াচ্ছে শুধু ক্রিকেট খেলার জন্য না। একজন দায়িত্ববান মানুষ হওয়া, পরিশ্রমী মানুষ হওয়া, সৎ মানুষ হওয়া। সব কিছু মিলেই কিন্তু মাশরাফি, ইউনিক মাশরাফি।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া, দ্রুত সমাধানের আশ্বাস
টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেবিস্তারিত পড়ুন
প্রোটিয়াদের রানের পাহাড়, টাইগাররা নামতেই বদলে গেল পিচের ধরন!
চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ৫ সেশনেরও বেশি সময় ব্যাটিং করেছে দক্ষিণবিস্তারিত পড়ুন
নেপালকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে সাফবিস্তারিত পড়ুন