কালীগঞ্জে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হামলা
দুই পা হারানো বাবার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, ঘরে চাল নেই
ঘরে এক মুঠো চাল নেই। সকালে উননে জ্বলেনি আগুন। ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। কেনার টাকা নেই। আদালতের নির্দেশের পর আজও জোটেনি সরকারি সাহায্য। স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা প্রশাসনের কেউ দেখতে আসেনি। এগিয়ে আসেনি বিত্তবানদের কেউ। কেউ যখন কথা রাখেনি তখন বড় ভাই ছামাউল গত কয়েক দিন ধরে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু সেটা কতদিন? ‘দুই পা হারিয়েছি। হাত দুটো দিয়ে কিছুই করতে পারি না। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।’ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নিজ ঘরের বারান্দায় শুয়ে যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামের দুই পা হারানো সেই দিনমজুর বাবা শাহানুর বিশ্বাস। গ্রামের সাধারণ মানুষের চোখেমুখে ভয়-আতংক। মাঠঘাট জনশূন্য। শাহানুরের বাড়ির পাশে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র কাঁধে দাঁড়ানো দেখা গেল। থমথমে পরিস্থিতি গ্রামজুড়ে।
৫ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে ঢাকা থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন শাহানুর বিশ্বাস। ফের ডাক্তার দেখাতে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে যেতে হবে ২১ ডিসেম্বর। ঢাকায় যাওয়ার বাস ভাড়াও নেই তার কাছে। এক ছেলে দুই মেয়ে। স্ত্রী পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে নানা চিন্তায় কুরে কুরে খাচ্ছে শুধু শাহানুর নয়, পরিবারের সব সদস্যকে। তাদের মাঝে এক অজানা আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু দিন হল বাড়িতে একজন এএসআইয়ের নেতৃত্বে পুলিশের পাঁচ সদস্য পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন। তাতে কী? একদিন পুলিশ ব্যারাকে ফিরে যাবে। তখন কী হবে? গ্রামের প্রতিপক্ষরাও থেমে নেই। মাঠঘাটে বের হতে পারছেন না পরিবারের কেউ। আসামিরা জেলখানায় থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। জামিনের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। এ অবস্থায় বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে শাহানুরের পরিবারের সদস্যদের।
কথা হয় শাহানুর বিশ্বাসের বড় মেয়ে শারমিন আক্তারের সঙ্গে। তাকে নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত। যশোর মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। প্রথম বিয়ে টেকেনি তার। দু’বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। স্বামীর বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার একতারপুর/কানাইভাঙ্গা গ্রামে। ওই গ্রামের ইসমাইল হোসেনের প্রবাসী ছেলে বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দ্বিতীয় ঘরেও আগুন ধরেছে। গ্রামের বখাটের দল নানা কথা বলে দ্বিতীয় স্বামীর সংসার ভেঙে দিয়েছে। মালয়েশিয়া প্রবাসী বিল্লাল স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। ছোট বোন শাহানাজ, ভাই মহিনুর, মা আরজিনা বেগমকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন শারমিন। নলভাঙ্গা ইউপি সদস্য যুবলীগ ক্যাডার কামাল, ইদুর ছেলে হাসান, সাবেক মেম্বার মাহবুবের ছেলে কলেজপড়ুয়া আজম মিলে তার জীবন-সংসার দুর্বিসহ করে তুলেছে। তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শারমিনের দিনমজুর বাবা শাহানুর বিশ্বাস।
শারমিনের ভাষায়, সরকার থেকে চিকিৎসার খরচ দেয়ার জন্য উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ আজও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য দেয়া হয়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র ঢাকা থেকে বাড়ি আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ও এক সপ্তাহের ওষুধ কিনে দিয়েছে। এ ছাড়া কেউ কোনো আর্থিক কিংবা ওষুধ সাহায্য দেয়নি বলে জানান শারমিন। পত্রিকায় ছবি ছাপানো হয়েছে, টেলিভিশনে ভিডিওচিত্র দেখানো হয়েছে। আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানববন্ধন, বক্তব্য-বিবৃতিতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হারানো দুই পা জোড়া লাগেনি। জোটেনি সামনের দিনগুলোর জন্য কোনো আশ্বাস। যুগান্তরকে অসহায় বাবার বড় সন্তান শারমিন আকুতি করে বলেন, ‘আমি লেখাপড়া জানি, সরকার একটা চাকরি দিলে বাবাকে নিয়ে পরিবারে ভাতের জোগাড় হতো।’
শাহানুর বিশ্বাস নিজের দু’হাত মেলে ধরেন। তার হাতের কড়াগুলো স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় কঠিন এক সংগ্রামী মানুষ তিনি। ঘটনার দিনও তিনি ২০০ টাকা উপার্জন করে বাড়ি ফিরছিলেন। কোনো কাজে আপত্তি ছিল না তার। রাজমিস্ত্রি, মাঠে গরু-ছাগল চরাণোর, দিনমজুরি- সবকিছু করতে পারতেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের পেটে দু’বেলা আহার জোগান দিতে ব্যস্ত সেই মানুষটির বেঁচে থাকার স্বপ্ন গ্রামের দুষ্টচক্রের রোষানলে পড়ে শেষ হয়ে গেছে। ঘটনটি ঘটে ১৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। এদিন সন্ত্রাসীরা রড দিয়ে পিটিয়ে তার দুই পা ভেঙে দেয়। তার ভাষায় বড় মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার বিচার দাবি করেছিলেন তিনি- এটাই তার অপরাধ।
এদিকে ২৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত একটি নির্দেশ দেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুই পা হারানো বাবা শাহানুর বিশ্বাসের চিকিৎসার সব খরচ বহন করতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তার পরিবারের সবাইকে নিরাপত্তা দিতে বলা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে ২৭ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে ২৯ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই দিন প্রতিবেদন দাখিলের পর আদেশ দেন আদালত। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয় হাইকোর্টের ওই আদেশে। এর আগে ২২ নভেম্বর সব আসামিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মামলার প্রধান আসামি নলভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ও কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি মেম্বার কামালসহ ১৫ আসামি কারাগারে রয়েছে। একজন আগেই জামিনে আছে।
আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে আসামিরা। এ বিষয়ে কালীগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মারামারির মামলা করা হয়েছে। নারী উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ বলেছে, ঘটনাটি গ্রাম্য দলাদলি। যৌন হয়রানির কোনো ঘটনা সেদিন ঘটেনি- এমন দাবি সংশ্লিষ্ট থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের।
একটি সূত্র জানায়, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সদর দফতরে যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে তাতে আহত শাহানুর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেছেন, নলভাঙ্গা গ্রামে সামাজিক বিরোধের জের ধরে ১৬ অক্টোবর শাহানুর বিশ্বাসকে প্রতিপক্ষরা মারধর করে। এ ঘটনায় ৬ নভেম্বর থানায় মামলা গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, শাহানুরের মেয়ে শারমিনকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনা সঠিক নয়।
কালীগঞ্জ থানার ওসি আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শাহানুরকে আহত করার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অগ্রগতি হয়েছে। শিগগির আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। ঢাকা থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
টসে জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে টসে জিতে স্বাগতিক ওয়েস্টবিস্তারিত পড়ুন
রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ
যমুনা ফিউচার পার্কে মোবাইলের দোকানে চুরির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভবিস্তারিত পড়ুন
যে ৫ দেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশিদের জন্য সতর্কতা
থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশি নাগরিকদেরবিস্তারিত পড়ুন