আদিত্য শাওনের প্রেমের উপন্যাস
দু’চোখের বৃষ্টি
ঢং ঢং শব্দে দোদুল্লমান ঘড়ির পেন্ডুমের কাটা বলছে সময় দুটো-দশ,ভর দুপুর। অথচ চারপাশটা কেমন বিদঘুটে অন্ধকার। ঠিক প্রচন্ড ঝড়ের আগে এক অদ্ভুত অন্ধকারের মতো। আমার ধারনা এমন সময় কেউ একা থাকলে তার মন খারাপ হয়। আর করো না হোক এই নিঝঞ্জাট অন্ধকার আমায় ভিষন টানে। আকাশের বিষণ্ণতাকে ধারন করে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। ওঘরে আমার স্ত্রী নিপা আপন মনে তার সংসার কর্মে ব্যস্ত। ও খুব চঞ্চাল তবে আমার বিষণ্ণতা আর নিঃচুপ মুহূর্তগুলো ছাড়া খুব একটা অভিযোগ তার নেই।
প্রতিদিন সকালে উঠে অফিসে যাই। সারাটা দিন কিভাবে যেন চলে যায় বোঝাই যায় না। কিন্তু রবিবার! সপ্তাহের এই একটা দিন বড় একঘেয়েমি লাগে। ছুটির দিনে রাজ্যের পত্রিকা, গল্প কবিতার বই আর টিভি রির্মোটের বোতাম টিপে সময় পার করতে চাইলেও সময় যেন মাছের পিঠে চড়ে বসে। ঘড়ির কাটা সরতেই চায় না। ছুটির সেদিন বসেছিলাম লেখার টেবিলের সামনে। সামান্য যেটুকু লিখি তার জন্য ছুটির দিনটাকেই বেছে নিই। এক কাপ ধুমায়িত কফি হাতে করে নিয়ে লেখার টেবিলের সামনে বসেছি। আমি লেখা শুরু করেছি কিন্তু বুকে একরাশ শুন্যতায় ভাবনাগুলো গরম কফির বাস্পের সাথে উড়ে যাচ্ছে। কোন উপায় না দেখে এক সময় বিরক্ত হয়ে সংগ্রীহিত নতুন পুরাতন কিছু ছবি থেকে শুরু করে মাঝে মাঝে নিজস্ব ভিডিও করা পুরোনো বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোও পূনপূণ দেখা বাদ যায় না। নিজের কোন গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ না থাকাতে বড় ভাইয়ার বিয়ের ভিডিওটাই ঘুরেফিরে দেখা হয়। সেটা দেখার একটা কারন অবশ্য আছে! কেননা সেখানে আমার শৈশবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জড়িয়ে আছে।
বিয়ের ভিডিওগুলোর নেপথ্যে সাধারনত হিন্দী গানই বেশি ভাগ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হিন্দী আমার কাছে খুব একটা বোধগম্য নয় হিজিবিজি চিৎকার মনে হয়। তাছাড়া যা ভাল বুঝিনা তাই ঘুরে ফিরে একই ভাবে শুনতে আমার ভালো লাগেনা। আমি কবিতার ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ, জীবনান্দ থেকে শুরু করে ওয়াল্টার হুইটম্যান, জন কিটস, রবাট ব্রাউনিংয়ের মতো বিখ্যাত সব কবিদের কবিতার বই আমার সংগ্রহে আছে। দেশি বিদেশী সব ধরনের কবিতার আবৃত্তি আমার খুব পছন্দ। মজার ব্যপার হলো সংগ্রহে রাখা বিয়ের এ ভিডিও ক্লিবটাতে ভারতীয় আধুনিক বাংলা গানের পাশাপাশি একেবারে শেষের দিকে জয়ীতাকে ঘিরে বিশেষ দৃশ্যে যেমন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘‘কেউ কথা রাখেনী’’ নির্মলেন্দু গুনের ‘‘দন্ডকারন্য’’ জীবনান্দের ‘‘বনলতা সেন’’ এর আবৃত্তি ইত্যাদি অত্যান্ত সুনিপুন ভাবে এডিটিং করে রেখেছি। যাতে করে পুরোনো দৃশ্যের সাথে সাথে দরাজ কন্ঠের কবিতাগুলোকে খুব চেনা এবং সজিব মনে হয়। ক্লিবগুলো এত বেশি দেখেছি যে আমার সাথে সাথে ছক বাধা প্রতিটা দৃশ্য নিপারও বেশ মখুস্থ্য হয়ে গেছে। একারনে ওর বিরক্তী যে নেই তা নয়, খুব মনোযোগ দিয়ে যখন কোন দৃশ্য আগ পিছ করে দেখি কাছাকাছি থাকলে মাঝে মাঝে নিপা তাই বিরক্ত হয়ে সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু সে তো জানে না এই স্যালুলয়েডের ফিতায় বন্ধী চলমান চিত্রগুলো আমার জীবনের বিরাট একটা অংশ দখল করে আছে। যা ক্ষনে ক্ষনে আমার চঞ্চল ভাবনাকে আলো আধারী মেঘ বৃষ্টির মতো সমান আর্কশন করে। মানুষ এতটাই দ্রুত বদলে যায় যে মেনে নিতে কষ্ট হয়! লোকনিন্দার সকল উদ্ধে সে আমার হঠাৎ করে বদলে যাওয়া এ টুকরো গল্পের নায়িকা। সে আমার ব্যর্থতার বিপরীতে সর্বজয়ী তাই আজ তার নাম দিলাম জয়ীতা।
ভিডিও ক্লিবের কিছুকিছু দৃশ্য আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেল, সেখানে আমর হঠাৎ ভাবনাগুলো এলোমেল হয়ে দুঃখে মন ভরে গেল, মনের চোখে দেখলাম অনেক অনেক স্থান; যেন আমি আমাতে নেই যেন অতিত হয়ে গেছি। বিগত দিনের অনেক চেনা জানা পথ পরিচিত, অপরিচিত, আপন জনের মুখ। একে একে ভেসে এল. . . . আমার অতিতের অনেক আশার দিনগুলো. . . . জয়ীতার কথা মনে পড়তেই বুকে চিনচিন করে একটা ব্যথা জেগে উঠল। ভাবি কত যুগ হয়ে গেল আর এমনী করে কত যুগ চলে যাবে। নতুন করে তার সাথে দেখা হওয়ার কোন সম্ভবনাও আজ আর নেই। কি উদ্যম আর আনন্দে ভরা ছিল আমাদের সে সোনাভরা জ্বলজ্বলে দিনগুলো।
সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা আকাশে ছিল হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টির আনাগোনা। নিয়ন আলোয় সাজানো বিয়ে বাড়ীটা নতুনত্বের চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখর হয়ে উঠেছে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলের বিয়েতে চেনা অচেনা সব আত্বীয় স্বজনের সমাগম। গায়ে হলুদ পর্ব আগেই শেষ হয়ে গেছে। কয়টা পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কয়েক দিন আগে আসতে পারিনি। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের সকল আয়োজন আজ শেষ হওয়ার পালা। বন্ধু বান্ধবের ছোটখাট একটা বিচ্ছু বাহিনী নিয়ে মজা করার নানা পরিকল্পনা থাকলেও সময়ের অভাবে তার সবটা করা হয়নী। তবুও ভিডিও ক্যামেরা ও ষ্টীল ক্যামেরা সহ বিচিত্র উপকরন সংগ্রহ করে সবাইকে মোটামুটি আনন্দ দেবার চেষ্টা। এখন যার প্রতিটা দৃশ্যই আমি বারবার খুটেখুটে দেখি।
ছোট বড় গাড়ীর বহরগুলো শো শো করে দ্রতু চলে যাওয়াতে রাস্তার দুধারে মানুষের উৎসুক দৃষ্টি। গ্রামের নেংটা ছেলে ছোকরার দল এই সুযোগে হৈ হুল্ল¬ড় চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করছে। মাঝে মাঝে ওরা এত নিকটে চলে আসছিল যে কিছুটা ভয় পেলেও চারপাশের বৃষ্টি ধোয়া সবুজ বন কলমিলতার কচি পতায় যেন ছিল আমাদের আমন্ত্রন বার্তা লেখা। তা দেখে কিছুটা হলেও মন ভালো হয়ে যায়। সাধারনত আমরা গ্রামের পরিবেশের সাথে পরিচিত না হওয়াতে কারো কারো কাছে বিষয়গুলো অতি পরিচিত হলেও মেঘলা আকাশের ইশারায় সেদিন পাখিরা যে গান গেয়েছিল এক কথায় তা ছিল অবর্ণনীয়, আমার কাছে অসাধারন। প্রায় বিশ কিলোমিটার যাত্রার পর কণের বাড়ীতে পৌঁছাতে না পৌছাতে আকাশ কাঁপিয়ে রীতিমত রিমঝিম শুরে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। বেশ ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। বর্ষায় অবশ্য সরুপথগুলোয় কাদা জমে গেছে। পাড়া প্রতিবেশিকে নিয়ে ওদের চারিদিকে একটা সাজসাজ রব পড়ে গেছে। বাড়ীর পশ্চিম দিকটায় বেশ কটা পাড় ভাঙ্গা সান বাঁধানো পুরোনো পুকুর। পুকুর পাড়ের ঐদিকটায় ছোট রাস্তার গলি মুখে আমাদের গাড়ীর বহরগুলো সারিবদ্ধ রাখা হয়েছে। আমাদের নিকটতম একজনের কাছ থেকে ছাতা চেয়ে নিয়ে ভিডিও ক্যামেরাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পরিকল্পনা মতো ততক্ষণে বাবুর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দারুন সব ব্যাঙ্গাত্বক কথা লেখা আঠালোযুক্ত ষ্টীকার। সে যাকে ইচ্ছা তার পিছে সেটে দিচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের পেলেই আর রক্ষা নেই, তাদের পিছু নিতে ভুল করছে না। বড় বড় অক্ষরে কারো পেছনে হয়তো ‘‘একা আছি, আমার একটা বর হবে কি?’’ আবার কারো পেছনে হয়তো, ‘‘প্রেম করতে চাই সিট খালী আছে কি?’’ ইত্যাদি ঝকঝকে উজ্জল কালির লেখাগুলো ফুটে উঠছে। ইমু বেশ দক্ষ ফটোগ্রাফার তাৎক্ষনিক সে লোক হাসাহাসির লজ্জাবনত সেই চিত্রগুলো ধারন করে রাখছে। এভাবে সবাই মিলে বিয়ের আনন্দটা বেশ উপভোগ্য করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
চারিদিকে লোকজন এবং কর্মব্যাস্ত মানুষের যাওয়া আসা দেখতে দেখতে আমরা অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। অপেক্ষারত বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যদের ভারি এক সমস্যাও দেখা দিল, যারা বরের সাথে আছে তাদেরকে নতুন অতিথিদেরকে কেউ কেউ অর্ভ্যথনা দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলও আমাদেরকে কেউ আর ডাকে না। আবার যে কেউ এসে ডাকবে ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো তারও কোন সম্ভবনা নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে কনে বাড়ীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে জিয়া তো বলেই বসল, কাছে ভিডিও থাকার কারনে তারা হয়তো আমাদের ক্যামেরাম্যান ভেবে বসেছে। অগত্য নিজেরাই গিয়ে আসন দখল করা ভালো। আমাদের চোখের সামনে যেখানে যদু মধু সহ অন্য সবাইকে ভিআইপি গেষ্টের মতো অর্ভ্যথনায় ধন্য করে ভিতরে নিয়ে গেল, সেখানে বিয়ে বাড়ীতে এসে বরের ভাই হয়ে নিজেই যেচে ভিতরে যাব সেটাও বেশ বেমানান লাগছে অন্তত আমার কাছে বেশ অবমাননাকর বটে। বিচ্ছু বাহিনীর অভিবিধানে এটা একটা আনকমান্ড বিষয় এবং আমাদের সবার জন্য চরম অপমানের। চারদিকে তাকাতাকি করছি কিছু করার নেই তবু লজ্জায় পা সরছে না। পরিকল্পনা মাফিক ক্ষুদে বাহিনী নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমরা যেদিকে তাকিয়ে আছি তার ঠিক বিপরীত দিকে পুকুর পাড়ে অনেক উৎসুক লোকের ভিড়। হৈ-চৈ ভিড় ঠেলে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে আসা কল্কা পেড়ে শাড়িপরা একটি মেয়েকে দেখে এক মুহুর্তে আমার ভিতরের পুঞ্জীভূত স্বপ্নগুলো ওলোট পালট হয়ে গেল। এমনীতে আমি এমন অপূর্ব শাড়ী সাজের মনমুগ্ধ দর্শক। আর নীল শাড়ীতে আকাশ নীলা হলে তো কথাই নেই। এমন অবস্থায় তাকে দেখা মাত্রই সারাক্ষন কবিতার পুংতিগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। এতকিছুর পরেও সে এত সুন্দর করে সেজেছে যে তা দেখে কার না মাথা খারাপ হয়। আমি কেঁপে উঠলাম, না সচকিত হলাম আজ আর মনে নেই। আমি অপলক ষ্টাচু অফ লির্বাটি হয়ে অবাক আশ্চর্য সে সুন্দর দেখছি। এককোষী শৈবালের মেতো চমৎকার সুন্দর। বয়স পনের কিংবা তার কম-বেশি হতে পারে! শাড়ী পরলে মেয়েদের বয়স অনুমান করা বেশ কঠিন। পাতলা গড়ন, হরিণীর মতো দুটি চোখ, টিকালো নাক। এক কথায় সব মিলিয়ে শ্রাবণের নরম আলোয় উদ্ভাসিত যেন অবিকল মাইকেল এ্যঞ্জেলার মোমের পুতুল। এমন স্নিগ্ধ সুন্দর কেউ কি হয়! কি করি আমার চোখ ফিরানোই যে দায়!
‘‘যেদিন সে প্রথম দেখিনু
সে তখন প্রথম যৌবন।
প্রথম জীবন পশে বাহিরিয়া এ জগতে
কেন যে বাঁধিয়া গেল নয়নে নয়ন।’’
সব কিছুর উদ্ধে ছিল তার শব্দহীন ভরাট পরিপূর্ন হাসি। সে হাসিতে ভরা বাদলে বিজলী চমকায়। ক্যামেরার লেন্স বাড়িয়ে ধোয়াশে আবরনে ঘেরা ভীরু চঞ্চল অস্পষ্ট একটা মুখ ভালোলাগার মুগ্ধ আবেশে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি। সবাই কি ভাবছিল জানিনা। আদৌ এসব নিয়ে কেউ কিছু ভাবছিল কি না তাও জানিনা। ক্যামেরা ঘোরানোর ভাব দেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিয়া শুধু বলল, তাই তো বলি বাড়ীর ভেতরে যাওয়ার ব্যস্ততা নেই কেন! বললাম, ইমু যেহেতু গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছে তাই ভাবলাম ওকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো মেয়েটির সঠিক নাম ও ঠিকানা পাওয়া যাবে। ততক্ষনে আমাদের সাথে ইমু যোগদিয়ে বলল, তোকে এখানের কেউ চেনে না আবার তুইও কাউকে চিনবী না। তবে শোন, ও আমাদের অর্থাৎ তোর নতুন ভাবীর বোন। নাম, জয়ীতা। গায়ে হলুদ দিতে এসে পরিচয় হয়েছে। বেশ চটপটে ও চঞ্চাল মেয়ে, সেদিন জমিয়ে গল্পও করেছিলাম। একদমে কথাগুলো বলে হাফ ছাড়লো। ইমুর মুখে ফিকে হাসির রেখা ঝুলছে তার রেশ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আমার ভেরতকার হাবভাব কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু আমার নিস্কৃয় নির্বেকার ভূমিকা তাকে উৎসাহ যোগালো না।
এই ক্যামেরাম্যান এদিকে এসো, বলে কণে বাড়ীর কে যেন ডাকলো দু’একবার। মজা করতে এসে এমন শব্দ শুনে আতে ঘা লাগলো, সামনা সামনী পেলে ব্যটার ঘাড় মটকানোর দৃশ্যটাও ভিডিও করে রাখতাম। আমাদের খুব লজ্জা লাগছে তবু এক সময় মিনমিন করতে করতে অবশেষে নিজেরাই বাড়ীর ভেতরে গেলাম। আকাশের গুমোট ভাবটা তখনো কাটেনী তবে বৃষ্টির উৎপাত কিছুটা কমে এলেও যেকোন মহুর্তে হুট করে তার ঝাপি মেলে দিতে পারে। দোতলা বাড়ীর উপর নিচ ছোটাছুটি করে কণে সাজানো থেকে শুরু করে উপস্থীত অতিথিদের সকল অনুষ্ঠান ধারন করতে বোধহয় বিকেল গড়িয়ে যাবে। এত সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে আমি জয়ীতাকে খুজেছি কিন্তু আহত হলাম তার দেখা না পেয়ে। দুপুর গড়িয়ে চলেছে, বিয়ের পড়ানোর সকল আয়োজন শেষে খাওয়ার টেবিলে বসে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকে খুঁজে চলেছি। কোথাও তার দেখা নেই। মনেমনে চিন্তার অন্ত নেই। কোথায় গেলো মেয়েটা! আমার খাওয়া তখন প্রায় শেষ হতে চলেছে। গ্রামের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আগত অতিতিদের খাওয়া শেষে কণে পক্ষের মহিলাদের পালা শুরু হয়। ছোটছোট বাচ্চাসহ স্থানীয় মহিলারা এসে একে একে সবাই বসতে শুরু করেছে। কিন্তু জয়ীতার মতো আমি কাউকে দেখি না। ওর মতো টুকটুকে লাল শাড়ীতে কাউকে আসতে দেখলে আমার কেবল পিলে চমকে উঠে।
পূর্ব কোনে ঘন আধার মেঘ জমেছে গুড়িগুড়ি থেকে আবারও বেশ জোরে বৃষ্টি নামলো। ওদিকে ভিডিও ধারন করার জন্য ঘনঘন ডাক পড়েছে জয়ীতাকে দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে যেমনী চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়েছি। জয়ীতাও ঠিক সে মহুর্তে একদল মেয়ের সাথে আমার টেবিলের সামনেই বসলো। চুলোর যাক সব কাজ এ মূহুর্তে আমি কোথাও যাব না। সবাই যখন খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন জয়ীতাকে দেখছি পরম বিস্ময়ে। মনে হলো আমার এবং বিশ্বের সবার অদেখা সৌন্দর্য আমার সামনে আমারই দেয়া আসনে ঠাই নিয়েছে। বড় নির্দোষ মনে হলো হেলেনের রুপে মুগ্ধ হওয়া যেসব সেনাপতির কারনে ট্রয় ধ্বংস হয়েছিল। অপূর্ব ঢেউ খেলানো বপকাট চুল চঞ্চল বাতাস বারবার তার মুখাবয় ঢেকে দিচ্ছে। আমার চোখে সরাসরি চোখে চোখ পড়তেই লজ্জাবনত ভুবন ভুলানো হাসি ঝলকে উঠলো। তাকানোর ভিতর চমৎকার একটা আর্ট আছে। আমি তো বলি ভিঞ্চির বিশ্বজয়ী মোনালিসার চেয়ে ওর হাসিটাই ছিল সুন্দর! ডাইনিং টেবিলের দিকে ভিডিও তাক করে ধরেছি জয়ীতাকে ঘিরে জীবনের সবচেয়ে মধুরতম এই ক্ষনটি ধরে রাখার জন্য। বুকের ভিতর অনুভব করছিলাম আমি জন্ম-জন্মান্তর ধরে যার অপেক্ষায়, যাকে বহুদিন ধরে খুজে চলেছি। সে যেন আজ আমার পাশেই বসা। তার উপস্থিতিতে পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে সুন্দর মনে হতে লাগল। ভিডিও করতে করতে দর্শকদের জন্য যত হাসির কথা বলছিলাম আমি অনুভব করছিলাম আমার সব কথা কেবল তার জন্যই বলা। অনুষ্ঠানের হাজার দর্শক আমার এ বেহাল দশা টের পেয়েছিল কি না জানিনা। কিভাবে যে কি হচ্ছিল ঠিক যন্ত্র চালিত রোবোটের মতো অবস্থা। খাওয়া শেষে জয়ীতা চলে গেল। শুধু আমি বসে রইলাম হতবাক হয়ে! যে রুপ প্রত্যক্ষ করার জন্য বিশ্ববিধাতা আমার দুই চক্ষু কপালতলে বসিয়েছে আজ এতকাল পর সেই রুপসম্ভার আমারই সামনে এনে বসালেন। এত বড় শ্রেষ্ঠত্ব আর কখনো লাভ করিনী। কতক্ষন! কত মিনিট ওভাবে বোকার মতো চেয়ে ছিলাম কে জানে!
ইমুর ডাকে ধাতস্থ হলাম। বলল, বিকেল গড়িয়ে গেছে সে খেয়াল কি আছে? ফিরে আসার তাড়া দিয়ে বলল, চল, সবাই গাড়ীতে গিয়ে বসেছে। কেবল আমাদের জন্য অপেক্ষা। তাড়াহুড়ো করে চলে আসাতে সেদিন নতুন ভাবীর সাথে আর কোন কথাই বলা হয়নি। নানান ব্যস্ততায় পরের দিনই ঢাকায় চলে এলাম। একএক করে সবকিছু চলছে নিত্য অভ্যাস মতো। তবে আমার হৃদয়ের গভীর গহীন স্তরটি গরিবের রান্নাঘরের এলোমেলো হাঁড়িপাতিলের মতো হতে থাকল। মাঝে মাঝে জয়ীতার কথা খুব ভাবতে লাগলাম। ইতিমধ্যে জয়ীতাকে নিয়ে আমার দু’একটা লেখাও পত্রিকায় বেরিয়েছে। আনন্দঘন আবেশ না ফুরাতেই তা থেকে বিচ্চ্যুতি ঘটায় শুধু হৃদয়টা আগের মতো নেই কোথায় যেন বাধা পড়েছি সে হিসাব মেলে না। হঠাৎ এমন একটা হোঁচট খাওয়ার পর নিজের ভিতর কেমন একটা শুন্যতা এসে ভর করেছে। এমন অপরিমাণ রুপ-সৌন্দের্যের ভেতর কি পরিমাণ ভালোবাসা নিয়ে একটি মন বসবাস করে চলেছে তা জানার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলাম। কত বিচিত্রভবেই না মানুষ ভালোবাসে। সিতাকে অপহরন করেছে বলেই রামায়ণ, হেলেনের জন্য ইলিয়ড। কত কবিতা, কত শিল্প, কত শাহাজাহান, কত ফ্রয়েড। এসব কিছু নিয়েই ভালোবাসা। তবু ভালোবাসা এসবের কিছুই নয়। বড্ড আশ্চার্য্য লাগে। অষ্টম এডওয়ার্ড সাধারণ নারী ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড সিম্পসনের জন্য আনন্দ ঐর্শয্য সব ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত রাজ্য ছেড়ে ছিল কি তবে এই জন্য? এই কাপুনী বিহীন জ্বরে কাতর হয়ে কি ইভা ব্রাউনকে ভালোবেসেছিল লৌহ-মানব হিটলার! আমার ভাবনার অন্ত নেই।
ওর পরিচিত জনের সাথে যেটুকু সময় ওকে দেখেছি ভারি চঞ্চল আর রাজ্যের সব আজগুবি গল্প বলাতে জয়ীতার জুড়ি নেই। চঞ্চলতা আমার ভালোলাগে কিন্তু ওর চোখ নেড়ে কথা বলার ধরন যেন একটু আলাদা। ওর চেখের ইশারায় যেন কাঞ্চন জঙ্ঘার সব বরফ গলতে পারে, মরু সাহারয় বৃষ্টি হতে পারে! হ্যামিলিয়নের বাঁশিঁওয়ালার কণ্ঠে যেমন মাদকতা ছিল, শুর সম্রাট তানসেনের তাল-লয়ে যেমন রাজ্যময় বুদ হয়ে থাকতো, আমার কাছে জয়ীতার কথা বলার ভঙ্গিমা অনেকটা সে রকমের। প্রথম দেখাতেই পিছু লেগেছি, খুব চালাক আমার কথাবার্তার ধরন দেখে সবকিছু আঁচ করে ফেলেছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাকে পাত্তা দিতেই ওর যত আপত্তি। আমিও বারে বারে চেয়েছি ভালোলাগা এই মানবীকে মনের কথাটা জানাতেই হবে। হীরকের মতো কঠিন আর জোকের মতো ধান্দায় লেগে আছি কখন তাকে বশ্যতা শিকার করানো যায় এ আশায়। কত ভাব বিনিয়ে কথা বলে, কত চিঠি লিখেছি নানান ছুতোয়। কোন কিছুতেই কাজ হয়না। আমাকে দেখলেই কেবল সে কিং কোবরার মতো ফোঁস করে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
জয়ীতাদের বাড়ীতে খুব একটা যাওয়া হয়না। কি একটা কারনে আজ মনে নেই, সেদিন ওদের বাড়ী গিয়ে দোতালার ঘরে মাত্র বসেছি। লোকজন এলে ওরা সাধারনত উপরের ঘরটাকে গেষ্টরুম হিসাবে ব্যবহার করে। আমাকে ঘিরে ভাবির মা বাবা খুব ব্যাস্ত, জয়ীতাকে দেখলাম এক জগ পানি আর গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে একটা ভেংচি কেটে আবার বেরিয়ে যেতে। মাথায় গিজগিজ করা বুদ্ধি তখন টর্নেডোর মতো উপচে উঠল, চট করে জয়ীতার সামনে গিয়ে একহাতে টেবিলে রাখা কাঁচের জগ, অন্য হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললাম এগুলোর প্রয়োজন নেই ও তখন দুহাতে জগ ও গ্লাস না রেখেই ফিরে যাবে ওমনি দুহাত ধরে ঠোঁটের উপর একটা গভির চুমু একে বহুদিন পর একটা গোপন কথা বলে ফেললাম, বললাম, তোমাকে আমার ভীষন পছন্দ, তোমার জন্য সেন্টমার্টিন থেকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপেও নির্বাসনে যেতে রাজী তবু তোমাকে সারা জীবনের জন্য চাই। আমার দিকে বরিশালের আমড়ার মতো মোটা মোটা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। বেচারী নট নড়ন চড়ন, না পারছে নড়তে না পারছে চিৎকার করতে, বাধ্য হয়ে যা বললাম তাতেই মিষ্টি হেসে সম্মতি দিল। ব্যস এতেই কাজ হল, মহারানীর অবস্থা গলে একেবারে আলুভর্তা। যতক্ষন ছিলাম, যা বলেছি আমার সমস্ত হুকুম সে একমনে মন যুগিয়ে মেনে চলেছে।
ভার্সিটির ক্লাস, তাছাড়া বিভিন্ন কারনে তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। একদিন হঠাৎ জয়ীতার চিঠি পেলাম, বিচিত্র সব ভালোবাসার উপমায় সে লিখেছে। ভাবীর কাছে আমি তো ভালো করে জেনে নিয়েছি ও খুব বুদ্ধিমতী সহজে যে কাউকে বোকা বানাতে সিদ্ধহস্ত। ভাবলাম আমাকেও সে বোকা বানাতে পারে। তাই ঠিক করলাম যখন আমাদের বাড়ীতে সে বেড়াতে আসবে তখন সত্য মিথ্যা যাচাই করে নেব। কথা মতো কাজ হলো, সেবার ঈদে যখন সে বেড়াতে এলো তার মুখোমুখি হয়ে চিঠিতে যা লিখেছে তার সত্যতা জানতে চাইলাম। অদ্ভুত মেয়ে অকপটে সব অস্বীকার করে বলল, চিঠিতে ওসব এমনি এমনি বোকা বনানোর জন্য লিখেছি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে সামলে বললাম, আমার সাথে সবাই কেবল চালাকী করে আর আমিও এমন একটা বোকারাম যে সবকিছু না বুঝেই বিশ্বাস করে ফেলি, সত্যি বলে ভেবে নিই! তবে জয়ীতাকে যখন তখন বিরক্ত করার জন্য তখন ক্ষমা চাইলাম। পাশাপাশি এও বোঝালাম আমি তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি। জয়ীতা তখন আবেগ জড়ানো নরম গলায় যা জানিয়েছিল তাতে তার অন্যসব অপূর্নতা ক্ষমা করে দিয়ে সেদিন নবম এডওয়ার্ড হওয়ার স্বপ্ন দেখলাম।
জয়ীতার উনিশতম জন্মদিনে এক মজার কান্ড ঘটেছিল। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। নতুন মেহমান হিসাবে আমার কোন কাজ নেই। বরং দুপুর থেকে কখন ওকে একা পাওয়া যায় সে সুযোগ খুজছিলাম। সন্ধ্যায় মোক্ষম সে সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, জন্মদিনে কারো মনে ব্যথা দিতে নেই, একটা কথা বলবো শুনবে? মাথা নাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে দিল। বললাম, স্রেফ ঠোঁটে একটা কিস দাও! বেশ কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলো, চারিদিকে দেখে শুনে চুপিচুপি বলল, তুমি কি লাজ শরমের মাথা খেয়েছ! রাত গভির হোক তারপর। আমার আর তর সইলো না ভুলিয়ে ভালিয়ে বহু কথা বলে রাজি করালাম। তারপর আলো-আধারের মাঝে রবীন্দ্রনাথের ‘‘সমাপ্তী’’ গল্পের বালিকা মৃন্মীয় মতো সহসা ফিরে ফিরে আলতো চুম্বন আমার ঠোঁট ছুয়ে গেল ক’য়েকবার। এরপর থেকে সে আমাকে ভিষণ ভালোবাসতে শুরু করে। মাঝে মাঝে জয়ীতার দেখা হলে সুযোগ খুঁজে একটু হাতে হাত রেখে একটু খানী শীতল স্পর্শের, ওর চোখে চোখ রেখে হৃদয়ের ভাষা বোঝার জন্য আমারও মন সারাক্ষণ খচখচ করতো।
আমি সবসময় কারনে অকারনে আড্ডা মারতে পছন্দ করি। জয়ীতাও একারনে আমাকে পছন্দ করে বলে আমি জানি। ছোট বাচ্চাদের জয়ীতা খুব পছন্দ করতো। প্রায়ই মজা করে বলতো, আমার কিন্তু এক ঘর ভর্তি বাচ্চা চাই। আমি হেসে বলতাম, ঠিক আছে, তাই হবে। আসলে তোমার কথাই ঠিক, শিশুরা হলো ফুলের মতো, স্বর্গের ছোট একটা অংশ। তাই দুটো তোমার কোলে, দুটো তার বাবার অর্থাৎ আমার কোলে, কাধে আর সারা উঠোন জুড়ে বিচরন করে বেড়ানোর মতো ডজন খানি বাচ্চা তো আমরা নিবোই উপরোন্ত না হয় দু চারটা ধার দেনা দত্তক নেবো। কথাটা আমি হেসে বললেও জয়ীতা আবার ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলতো, বাচ্চা নিতে গিয়ে আমি যদি মরে যাই তখন! আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলতাম, আমি শুধু তোমার শরীরটাকে ভালোবাসি না। তুমি আমার কাছে এই পৃথিবীর মতোই প্রিয়। ঝড়বাদল, জলোচ্ছাস ইত্যাদি প্রত্যাহিক শত কষ্টের মধ্যেও যাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। মেঘমুক্ত একটি সুন্দর সকালের মতো তোমার ঠোটের এক চিলতে হাসি আমাকে সহস্র বছরর বেচে থাকার প্রেরনা জোগায়। তোমার কোন ক্ষতি হোক কি আমি চাইতে পারি?
অনেকক্ষণ নিরব থেকে কি জানি কি ভেবে জয়ীতা আমাকে বলল, একটা কথা বলতে চাই। এ কথা তুমি আর কাউকে বলোনা। কথাট শোনার আগেই একটা অজানা ভয়ে আমার মনটা হঠাৎ মুচড়ে উঠলো। কোন অনাহূত বিপদের আশঙ্খায় ডুবে আছি। বলল, আপু কানাডা থেকে আসার পর থেকে তার আর বাবার কথাবার্তা কেমন যেন মনে হচ্ছে। বোধহয় আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমি জয়ীতাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে অনেকটা সিনেমার ষ্টাইলে বললাম, আমার কাছ থেকে তোমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। জয়ীতা আমার বুকের মাঝে পায়রার উষ্ণতা ছড়িয়ে অস্থিরভাবে বলেছিল, তুমি তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করো। দরকার হলে গোপনে, কোর্টে গিয়ে আমরা. . . .
আমি আবারও ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ওভাবে নয়। সামনে আমার এম.এ পরীক্ষা, পড়াশোনাটা শেষ হোক তারপর না হয় ভাবা যাবে। জয়ীতা তবু আশ্বস্থ হতে পারিনি। কাপা কাপা গলায় বলেছিল, বড় ভয় করছে। ওর চুলের সমুদ্রে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে বলেছিলাম, কোনো ভয় নেই! কিন্তু আমাদের এই প্রত্যাশিত চাওয়া পাওয়া, প্রকাশিত ভালোবাসার পরিনতি বড্ড নির্মম ও নেপথ্য শয়তানের অপ্রত্যাশিত চক্রান্তের শিকার তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ঠিক এর পাঁচ মাস পর পরীক্ষা শেষে জয়ীতাদের বাড়ীতে যাব ভেবে টুকটাক শপিং করলাম। বিয়ের জন্য চমৎকার একটা আংটি কিনলাম। ওকে পরাবো বলে আমার পছন্দের সব জিনিষ পত্র কেনাকাটা করে নিয়ে যখন তাদের বাড়ীতে গেলাম অসম্ভব ভালো লাগায় মনটা ভরে ছিল। কপাল দোষে নাকি চক্রান্ত জানিনা। সেদিন জয়ীতাদের বাড়ীতে পরপর দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও জয়ীতার সঙ্গে দেখা হলো না। ব্যালকনির ডান দিকে ভেতরের ঘরে আমাকে বসিয়ে রেখে সবাই হাওয়া হয়ে গেছে। একাএকা বসে বসে এটাওটা ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে কান পেতে শুনলাম, ওর বাবা আমার সাথে দেখা করতে দেবে না বলে জয়ীতাকে মামার বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার চেচামেচি করছে। কিছুক্ষণ পর জয়ীতার মা’র এসে জানিয়ে দিল, জয়ীতা বলেছে সে আর আমাকে পছন্দ করে না। আমি যেন জয়ীতাকে ভুলে যাই।
চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ দুলে উঠলো ঠিক যেন পৃথিবী সৃষ্টি বা ধ্বংস দিনের মতো এক প্রবল বিস্ফোরণে। চেনা ভূবনটাই এক মুহূর্তে বদলে গেল। আমিত্ব হারালে সব অসুন্দর হয় আমারও তাই হলো। কেন কিভাবে পারলো সে এভাবে চলে যেতে! সেসব প্রশ্ন আমাকে প্রতিক্ষন বিদ্ধ করতে লাগলো সূক্ষ ফলার মতো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। এমন ভাব করতাম যেন সব ঠিক আছে। কিন্তু তা ছিল নিজের সাথে মস্ত ফাকি বাজীর এক খেলা। ব্যক্তিগত আমি ক্রমেই ক্ষয়ে যেতে লাগলাম। প্রতিনিয়ত কি এক শুন্যতার অন্তর্ঘাত আমাকে আরও সহজ করে দিয়েছে। সকল অপমানের ক্ষত যেন বেমালুম ভুলে গেলাম, নিজের থেকেই ওর সাথে আবার যোগাযোগ করলাম।
দিনেদিনে দুই পরিবারের মধ্যে ছোটখাট আন্তকলহ রেশারেশির পরিমানটা এতই বিষাক্ত রুপ ধারন করে যে তার জেদের গরল কালিমায় বিশেষ করে জয়ীতার বাবার একান্ত অনইচ্ছায় আমাদের ভালোবাসা সেখানে মলিন হয়ে যায়। আমার মা জয়ীতার বাবার একমাত্র শত্রু। তাছাড়া এক ভাইকে তো এক মেয়ে দেওয়াই আছে আবার কেন? সুতরাং এই ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হতেই পারে না। জয়ীতার বাবা শিক্ষিত, ধনী হওয়া সত্তেও প্রচন্ড একগুয়ে আর মধ্যযুগীয় মানসিকতায় আক্রান্ত। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি জয়ীতার বাবা, মা, বোন সবকিছু জেনেশুনে কেউ একটুও সেটা বোঝার চেষ্টা করলো না। বরং বিভিন্ন বিষয়ে নিত্য নতুন ইস্যু উপস্থাপনের মাধ্যমে ছলচাতুরী করে ভেতরে ভেতরে জয়ীতাকে তারা প্রলুব্ধ করে আমার বিরুদ্ধেই দাঁড় করায়। আমি তার কিছই বুঝতে পারিনী। অবশ্য জয়ীতার পরিবর্তিত আচারনে একটু একটু করে সব প্রকাশ পায়। সে আমাকে ভালোবাসে তবে নানা রকম শর্তে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে, তার জন্য আমার বাবা, মা সবাইকে ছাড়তে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান বেড়াজাল দিয়ে তৈরি করা আজগুবি সব শর্ত। আসলে এগুলো কথার কথা। দিনে দিনে ভালোবাসার এতটা পথ পেরিয়ে এসে মনে হলো আমার ফেরার সকল পথই যেন এক এক করে বন্ধ হয়ে গেছে। ভেবে দেখলাম তাকে হীনা বেঁচে থাকাটাই আমার দায় হয়ে দাঁড়াবে। আবার সে যদি স্বেচ্ছায় চলে যায় সেটাও আমার ভবিষৎ জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। গলায় বিদ্ধ কাটায় ছটফট করছি। কোন কিছু চিন্তা না করে ভাবলাম ওরা যা বলছে তার কোন ভিক্তি নেই তবু সমাজ সংসার সব ভুলে তার ভালোবাসায় উন্মুখ হয়ে সকল শর্তে সায় দিলাম। জানি অন্যায় তবু সে যা চেয়েছে তাতেই মুগ্ধ হয়ে সায় দিয়েছি। তার দেয়া কষ্টের আঘাতকে আড়ালে রেখে হাসি মুখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি কেবল ওকে পাব বলে। আমার ধারনার সাথে কোন কিছুই মেলেনা। সরল অংকের মতো জীবনটাকে বুঝতে চেয়েছিলাম। প্রতিবার পরিক্ষার খাতায় সরল অংককে জটিল করে সমাধান করতে গিয়ে অংকে শুন্য পেতাম। ভুলেই গিয়েছিলাম এখন দিন বদলেছে। একবার ভালোবেসে কারো নেশাকাটে না। বহুগামিতা এখন যুগের ফ্যাশন। পরনারী আসক্তী আর পর পুরূষ মোহগ্রস্থ হলো উন্নত চরিত্রের নিদর্শন।
যাকে যার ভালো লাগেনা তার সবকিছুতেই অসহ্য অস্বস্থী মনে হয়। চলনে বলনে সহজ সরল যুক্তিগুলো মনের মধ্যে দুঃসহ তর্কের ফেনীল সমুদ্র হয়ে পাল্টা আঘাত করে। জয়ীতার ভাবভঙ্গি একে একে হঠাৎ করে বদলে গেল। চেনা চেনা শুরগুলো কেমন বেশুরে বাজতে শুরু করলো। দিনেদিনে বদলে যাওয়া জয়ীতার হৃদয়ের অহমিকা ছিল পৃথিবীর সবকিছুর উদ্ধে। প্রতিটা কথায় কাজে আমাকে চুড়ান্ত রকম অপমান করতো। এমন কোন অপমানের বাক্য নেই যা সে ব্যবহার করেনী। ওর আক্রশ আর মুখের অভিব্যাক্তি দেখে আমার সবটুকু প্রতিরোধ ভেঙে গেল। কেমন যেন সমহিত হয়ে গেলাম। তার কর্কশ কথার তীব্র নিষ্ঠুরতা একটু একটু করে আমার মনের সকল জোর কেড়ে নিচ্ছিল। সেদিন যেন পুরোপুরি ভেঙে গুড়িয়ে গেলাম। আর তারপরই জানলাম ফ্যাদোমিটার দিয়ে সমুদ্রের গভিরতা মাপা গেলেও হৃদয়ের গভিরতা মাপার কোন যন্ত্র আজও অনাবিস্কৃত। মানুষের মনের ভিতর কি ভাঙ্গাগড়া হয় বাইরের অবয়বে তা কি বোঝা যায়! তবে আমি কি করে জানবো সে আমাকে কতটুকু ভালোবাসে নাকি আজও বাসেনী! আজও জানিনা কোন অলৌকিক তন্ত্র-মন্ত্রে আদর স্নেহ, ভালোবাসায় দিনে দিনে বেড়ে ওঠা জয়ীতা অমন করে বদলে গেল। ঝড় যতো যোরেই আসুক অপেক্ষা করেছিলাম ওর জন্য, কিন্তু হলোনা কেবল আহত হলাম। অপেক্ষা হলো এক নিস্তব্ধ ঘাতক নির্মমভাবে হত্যা করে সে সুন্দর মহূর্তগুলোকে। দিনের পর দিন এভাবে কেটে গেল, চিন্তা চেতনায় হৃদয়ের নিবিড় মগ্নতায় ফিরে এলাম আমি। মনটা শক্ত হতে লাগলো। শুধু নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকবো এতটা মনোযোগি আমি হতে পারিনী। উপলব্ধি করছিলাম সমাজ সংসার আর জয়ীতাকে ঘিরে আমার ঘোরলাগা স্বপ্নগুলো কেমন এলোমেল হয়ে যাচ্ছে। তবুও যখন ওকে দেখি সব ভুলে সে একটু কাছে আসে তখন এক বিমূর্ত আনন্দ আমাকে এক নির্মল স্বপ্নস্রোতে নিমজ্জিত করে রাখে। ভুলে যাই সব জীবন-যন্ত্রণা।
হ্যা তার সাথে শেষ বারের মতো দেখা হলো ঠিকই কিন্তু অন্যরুপে। কারন এই পাঁচ বছরে খরস্রোতা নদীর মতো সদা বহমান জীবন নদীর পাড় ভেঙেছে অনেক বার আবার তাতে চরও জেগেছে। যান্ত্রিক ক্যামেরায় অপরিপক্ক চোখে দেখা বিয়ে বাড়ীর সেই মেয়েটি আজ অনেক বড় হয়েগেছে। বুঝতে শিখেছে কাড়িকাড়ি অর্থ ছাড়া ভিখেরীর মতো শুধু মুখের ভালোবাসার এক কানাকড়িও মুল্য নেই। শিখেছে আমার মতো ক্যামেরার লেন্স নয় বাস্তবের চোখে পৃথিবী দেখতে। সে সময় জয়ীতা আমার এতো আকুলতা এত চঞ্চলতা এক মুহুর্তে ভুলে গিয়ে আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্বর মতো আমারই বিপক্ষে দাঁড়ায়। আগ্রহ, দাবি, অধিকার সব বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে চুরে বিললিন করে দিয়ে ফনা ধরা সাপ হয়ে আমাকে অভিরাম ছোবল দিতে থাকে। কি বলব তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। জীবনের সব সৌন্দর্যের মহামিলন যার মধ্যে প্রত্যক্ষ করলাম অকস্মাৎ পৃথিবীর সব আশ্চার্য পেছনে ফেলে সে চলে যেতে চাইছে। ওকে কি দিয়ে বোঝবো, কি করে ফেরাবো আমি!
মেয়েদের ছোটখাট সহজ বুদ্ধি পুরুষের ভাবনার চেয়ে অনেক তিক্ষ্ণ। ঠকার পরেই পুরুষ অনেকটা ঠেকে শেখে। জানা ছিলনা সস্তায় শেখানো আওড়ানো মিথ্যে বুলিতে নারীরা সুখ খুজে পায়। সত্য পুরুষকে নিতান্ত বোকা ভাবতে অভ্যস্থ, সরল পুরুষকে ক্যাবলা বানাতে তারা সিদ্ধহস্ত। মাঝেমাঝে ভাবতাম এভাবে কি আমি তাকে ধরে রাখতে পারবো? আমর ভরসায় কুলোয় না। কারো জন্য কারো জীবন হয়তো থেমে থাকে না। টানাপোড়া খাওয়া এই দুরন্ত কেতাদুরস্থ রাস্তায় আমি অনাভ্যস্থ নবীন পথিক। পিছন ফিরে দেখি আনকোরা মুখগুলোর ভিড়ে আমিই কেবল একা। অনেক আগেই আমাকে ফেলে চেনা জানা পথিকরা একেএকে চলে গেছে। ঘুনাক্ষরে জানতেও পারিনী কখন যে পরিকল্পিত ভাবে জয়ীতার বাবা, মা ও তার বড় বোন মিলে কারসাজি করে আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সন্ধান পেয়ে কারো তোয়াক্কা না করেই প্রবল উল্লাসে জয়ীতাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছে। আমার বাবা কোথা থেকে যেন জেনেছিল বিষয়টা কিন্তু প্রতিবাদ করেনী। যা কিছু ঘটেছে সব জয়ীতার মা এবং বড় বোনের চক্রান্তে। জয়ীতার মতামত কি ছিল জানিনা। মেয়েদের একবার বিয়ের পর তা জানতে চাওয়াটা নিঃপ্রয়োজন, বড্ড বেমানান, ইচ্ছা কিংবা অনিইচ্ছায় হোক বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছে। সেখানে আর প্রশ্ন করা চলেনা। যাইহোক জয়ীতার মা হয়তো কিছুটা আপত্তি করেছিল বলে আমার বিশ্বাস ছিল। হয়তো তা করেছিলেনও কিন্তু জয়ীতার বাবা তার মাকেও ডিভোর্সের ভয় দেখিয়ে রাজী করাতে কসুর করেনী। আবার এর উল্টো কারনও হতে পারে, যেখানে কেবল জয়ীতার মায়ের কারনে সবকিছু ভেস্তে গেছে। কি জানি হয়তো এর সবটাই আমার ধারনা। যদি এমন হয় তবে ভাবতে হবে কতোটা কদর্যতায় ভরা এই মানুষগুলো। সবকিছুকে যদি নিয়তী বলে মেনে নিই তবে ওর মায়ের ধোকায় পড়ে জয়ীতাকে ভালোবাসাটা আমার আজন্ম পাপ হয়ে গেছে। জন কিটস এর কবিতার ভাষায়, She was taken from life, when life & love was new. (তখনই তাকে চলে যেতে হলো, যখন জীবন আর প্রেম প্রষ্ফুটিত হচ্ছে কেবল।)
বিনা মেঘে বজ্রপাতে আমার চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো। একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর আবার যেন জন্ম হলো আমার। জীবন থেকে কি একটা চলে গেল, কারনে অকারনে বুকের ভেতরটা অসীম শুন্যতায় ভরে উঠেছে। তার ভারসাম্যহীন অস্বাভাবিক প্রশ্নগুলো প্রতিমহূর্তে আমাকে ভারসাম্যহীন করে তুলতো। প্রবল অন্ধকারে আমি খেই হারালাম। হাতড়ে যে আলোটুকু পেলাম তাকে অাঁকড়ে ধরেই সান্তনা খুঁজলাম। ভেবেছিলাম সব কষ্টই এক সময় সয়ে যাবে। সমস্ত ধারনাটাই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলো।
মায়ের পৌনঃপুনিক অনুরোধে বিয়ে করি, সংসারে নতুন দিগন্তের মাঝে ডুবে যেতে চেষ্ট করি কিন্তু হায়! কোন কিছুতেই আমি স্থীর নই। সংকোচ আর অসংকোচ প্রতিনিয়ত আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। মনেহয় বুক চিরে তাকে দেখিয়ে দিই, বুকের ভেতর কি এক অলৌকিক যন্ত্রণা আমার শুন্যতার অন্তর্লোকে প্রতি মহূর্তে জ্বলে উঠছে, দগ্ধ করছে। শতাব্দীর পুরোনো বাড়ীতে গজিয়ে ওঠা বটমূলের মতো হৃদয়ের ভিতরের সমস্তটা সে তো এফোড় ওফোড় করে দিয়ে গেছে। আজ জয়ীতার সংসার হয়েছে। আমারও চেনা-জানা পথগুলো বহুদুরে রেল লাইনের মতো অচিন রেখায় মিলিয় গেছে।
জয়ীতাকে আমি ভুলতে পারিনি, পারিনি নিজেকে ক্ষমা করতে। জয়ীতার মতো করে আমি কাউকে ভালোবাসতে পারিনী। একজনমে কতজনকে আর ভালোবাসা যায়? কতজনকেই বা বিলানো যায় সিমাবদ্ধতার জটিল মাংসপিন্ড হৃদয়টা। আমার চোখে জয়ীতার তুলনা কেবল-ই জয়ীতা। দুর আকাশে মিম্রমান প্রভাউজ্জল তারকার মতো তার ক্ষয় নেই। বিয়ে বাড়ীতে আনন্দরত বিচ্ছু বাহিনীর কনিষ্টতম সদস্য বাবু পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে, বন্ধু ইমু জীবনের চরম শত্রু হয়েগেছে এখন কেউ কারো খোঁজ রাখিনা। ডাক্তারী বিদ্যার কঠিন ঘোরপ্যাচে পড়ে জিয়া আছে কোন এক দূর্গম শহরে। একএক করে দিন, মাস গুনে অনেকটা বছর পেরিয়ে গেছে। জয়ীতার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ইচ্ছা কিম্বা অনিচ্ছা কিনা জানিনা, জয়ীতাকে ভুলে কোথায় গেলে একটু সুখ পাব সে আশায় আমিও একদিন দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছি। প্রবাস জীবনের একটু অবসরে যখনই সময় পাই সবার অলক্ষে ঘুরেফিরে জয়ীতার স্মৃতিগুলো হাতড়ে মরি। মনেহয় আত্মহত্যা করলে হয়তো মুক্তি পেতাম। ভিডিও করা চিত্রগুলো ক্লান্তিহীন ভাবে যখন বারবার টেনেটুনে দেখি, তখন দেশের কথা, জয়ীতার ষোড়শী অবয়বের সেই চঞ্চল মুখটা খুব করে মনে হয়। নিজের গোপন স্মৃতিতে সুক্ষ্ম সুতোয় বোনা আল্পনা আঁকা ছবিতে হৃদয় বিদীর্ন করা একটা নাড়ি ছেড়া টান অনুভব করি। চোখবুজে সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই। যার সবকিছু আজ ভাঙ্গাচোরা বর্নহীন।
অজানা এবং অস্পষ্ট কারনে ভাবী আমাকে খুব ঘৃর্ণা করে সেটা তার চিঠিতেই জেনেছি। আমিও উপযাচক হয়ে তাকে প্রশ্ন করিনা। কেন করবো? ভাঙ্গা গড়ার খেলা খেলতে গিয়ে স্বর্থপরতায় তারাই তো আমাকে বহুদুরে নিক্ষেপ করে আবার আমাকেই এখন দোষী ভাবে। এ কেমন নির্মমতা! এ কোন দূর্বিসহ যন্ত্রনার স্টীম রোলার! প্রায় এক যুগ হতে চললো, এখন সেদিনের ভিডিও ক্লিব ছাড়া জয়ীতার বিশেষ কোন স্মৃতি আমার কাছে নেই। জয়ীতার বর্তমান কোন খবরও আমার অজানা। জানতেও চেষ্টা করিনা। জানিনা সে এখন কোথায় আছে? কেমন আছে তার যাচাই করে পাওয়া রাজপুত্রের সংসারে। ছোট বেলার হাজারও দুষ্টমীর স্মৃতিগুলো আমার মতো ওকে ভাবায় কিনা, জানিনা হাজার কাজের ভিড়ে কৈশরের দুরন্ত ভাবনাগুলো ওকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে কিনা। ওর মনে পড়ে কি? সুখ দুঃখের কন্নায় ভেসে যাওয়া ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ইদানিং জয়ীতাকে মাঝেমাঝে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। খুব জানতে ইচ্ছা করে গল্পের আসরে সে সবার মধ্যমনি হয়ে হাসির ঝলকে মুখরিত করে কি? কে তাকে আদা চা করে দেয়? জ্বর এলে মাথায় জল পট্টি বেধে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়? দুহাতে মুখটা ধরে বলতে ইচ্ছা করে, কেমন করে এমন শক্ত আটুঁনি ফসকে তুমি পালিয়ে গেলে! পালাবেই যদি তবে কেন বলেছিলে! আমার জন্য গাছ তলায় বসে শুকনো রুটি খেয়ে থাকবে? চলে গিয়ে হয়তো সুন্দর গন্তব্য তুমি ফিরে পেয়েছ। কিন্তু নিউরনের জালে জালে ছড়িয়ে দিয়ে গেছ ভালোবসার নীল কষ্ট। কথার ভিড়ে কিছু কথা হারিয়ে যায়, নয়তো অস্পষ্ট হয়। আবার বলতে গিয়েও কিছু কথা থেকে যায় সঙ্গোপনে; আর বলা হয়ে ওঠে না। আমার জীবনটা যেন আধখাওয়া বিস্কুটের মতো যার একটা অংশ ক্ষয়ে গেলে বাকিটা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ে।
জয়ীতার নিজস্ব ভুবনে আজ অনেক প্রাপ্তি, সে এখন দ্বীপ্ত প্রভাজয়ী আলোক বর্তিকা। যে আলো কখনো অন্ধকারের কাছে পরাজিত হয় না। আর আমি সেই ফেরারী বাতি ওয়ালা যার নিজের ঘরেই আলো নেই। সঞ্চিত কত স্বপ্নই রয়ে গেছে হৃদয় নিভৃতে আমার। লুকিয়ে রাখা টুকরো টুকরো এতসব গল্পের আয়োজনে মন কেমন করে ওঠে। এ অনির্বচনীয় অসাধারন এক অনুভুতি, একে ব্যাখা করা যায় না।
সময় মানুষকে পথ দেখায় ঠিকই, তবে সে পথকে চিনতে পারা কজনের ভাগ্যে ঘটে? মানুষকে বাদ দিয়ে জীবন চলে না, এটা যেমন সত্য, তেমনী ভুল মানুষের কারনে জীবনের পথটা ভুল হয়ে যেতে পারে, এটাও তো মিথ্যে নয়! জয়ীতা আমার দু’চোখের কোনে জমে থাকা শ্রাবনের মেঘ, দুচোখের বৃষ্টি। সে আমাকে ঠকিয়ে গেছে এই কি ছিল আমার অদৃষ্ট লেখন! যান্ত্রিক সভ্যতা ঘেরা শহরের নাগরিক কোলাহলে আমার অকৃত্রিম প্রশ্নগুলো ক্রমশ্য মিলিয়ে যায়। নিপার ডাকে স্বচকিত হয়ে ভাবনার অতল সাগরে থেকে মুখ তুলে রির্মোটের লাল বোতামের চাপে ভিডিও ক্লিবগুলো গুটিয়ে রাখি আগামী দিনের কোন এক অবসরে তাকে দেখব আর ফিরে যাব সেই কান্না হাসির আশৈশব কৈশরে।
জানিনা এ আমার আরেকটি পাপ কি না, কারন আমার স্ত্রীও আমাকে খুব ভালোবাসে। নেপথ্য বাজতে থাকা রবাট ব্রাউনিংয়ের ‘‘সমাম বনাম’’ কবিতার পুংতিগুলো বারবার আমার মাথায় ঠোক্কর খেয়ে হারিয়ে যায়।
Truth, that’s brighter then gem
Trust, that’s purer than pearl-
brightest truth, purest trusts in
the universes.
All were for me
in the kiss of one girl.
সত্য, যা রত্নের চেয়ে উজ্জল
বিশ্বাস, যা মুক্তার চেয়ে শুদ্ধ
এবিশ্বের উজ্জলতম সত্য,
শুদ্ধতম বিশ্বাস-
সবই আমার জন্য ছিল
একটি মেয়ের চুমুতে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আহা চিকুনগুনিয়া !
ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে আমিবিস্তারিত পড়ুন
‘দৃষ্টিশক্তি থাকা, কিন্তু জীবনে লক্ষ্য না থাকা অন্ধত্বের চেয়েও খারাপ’
চক্ষু, কর্ন, জিহবা, নাসিকা, ত্বক – মানুষের এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়েরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষিতা মেয়েটির গল্প
পারিনি সেদিন নিজেকে শোষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে, পারিনি সেদিনবিস্তারিত পড়ুন