নাটাইগারদের নামাতে পারবে না, ৭ নম্বর থেকে
আঘাত না পেলে বোধহয় ভেতরের ক্রোধটা ঠিকরে বের হয় না, ভেতরে রক্তক্ষরণ না হলে বোধহয় জেদটাও জ্বলে ওঠে না। আর কে না জানে, ক্ষুধার্ত না হলে বাঘ তার তীক্ষষ্ট নখগুলো বের করে না! ঠিক এভাবেই টাইগাররা গেল ক’দিনের অকল্পনীয় সংযমে মুড়ে রাখা সব অসহ্য অন্তর্দাহ উগরে দিল দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর। দপ করে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো দীপ্ত হয়ে মাশরাফিরা যেন চিৎকার করে বললেন- দেখো, আমরা হারিয়ে যাইনি!
দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৬২ রানে বেঁধে রেখে সর্বনিম্ন রানের লজ্জায় ডুবিয়ে টাইগাররা সমুচিত জবাব দিল ৭ উইকেটে ম্যাচ জিতে। হারের বৃত্ত ভেঙে তারা শুধু সিরিজে ১-১-এ সমতাতেই ফিরলেন না, তাহিরকে ছক্কা হাঁকিয়ে সৌম্যরা আট বছর পর ফের প্রোটিয়াদের হারের স্বাদও দিলেন। নিশ্চিত করে ফেললেন ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির টিকিটও। পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ মিলে এখন যত জারিজুরিই করুক না কেন,
বাংলাদেশকে র্যাংকিংয়ে সাত নম্বর থেকে কেউ নামাতে পারবে না। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পেলেন তারা, নড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে। যে আত্মবিশ্বাস তারা অর্জন করেছিলেন সেই বিশ্বকাপ থেকে। বিশ্বকাপের সেই সৌম্য-মাহমুদুল্লাহ, ভারত সিরিজের সেই মুস্তাফিজ। সবকিছুই ফিরে পেয়েছিলেন এদিন মাশরাফি। বাড়তি পাওয়া ছিল নতুন এক নাসির হোসেনকে। যার অফস্পিনে ঘায়েল হয়েছিল প্রোটিয়ারা।
মিরপুরের বিজয়মঞ্চে শুধু নিষ্প্রভ তামিমকে পাওয়া যায়নি। মিডিয়ার সমালোচনা, বিসিবি কর্তাদের কড়া চোখের সঙ্গে সমর্থকদের কটু মন্তব্য- তীব্র এক যন্ত্রণা আর স্নায়ুর চাপ নিয়েই মাঠে নেমেছিল এদিন বাংলাদেশ।
সেখান থেকে এদিন বেরিয়ে এসেছিল এক ‘টিম বাংলাদেশ’। মুস্তাফিজের একেকটি কাটার, রুবেলের বাউন্সার, নাসিরের আর্মার, লিটনের ক্লিক, সৌম্যর পুল, মাহমদুল্লাহর কভার ড্রাইভ- প্রতিটি অস্ত্রের সঙ্গেই যেন ঠিকরে বেরিয়েছিল ভেতরের জমে থাকা সুতীব্র যন্ত্রণার আগুন। যে আগুনে এদিন পুড়ে গিয়েছিল প্রোটিয়াদের সব অহঙ্কার। জয়ের আসল ভিতটা অবশ্য এদিন গড়ে দিয়েছিলেন বোলাররাই। তবে গত কয়েক ম্যাচের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ব্যাটসম্যানদের নিয়েও একটা চাপা শঙ্কা ছিল।
প্রথম বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে তামিম যা বাড়িয়েও দিয়েছিলেন। দায়িত্বহীন ব্যাটিং করেছিলেন তামিম। কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই তিনি রাবাদাকে এগিয়ে এসে বাউন্ডারি মারতে গিয়েছিলেন। বোল্ড হয়ে যান ৫ রান করে। এরপর লিটন ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠেছিলেন। রাবাদার বলে আঙুলে চোট পাওয়ার পর তিনি অবশ্য বোল্ড হয়ে যান। তবে তার ১৭ রানের ইনিংসে রাবাদাকে হুক করে যে ছক্কাটি তিনি হাঁকিয়েছিলেন, অ্যাবোটকে ফ্লিক করে মিড উইকেট দিয়ে যেভাবে বাউন্ডারিছাড়া করেছিলেন, তা দেখে হাথুরুসিংহে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। এরপর মাহমুদুল্লাহ আর সৌম্য মিলে এক পরিণত ইনিংস খেলেছিলেন। এ জুটিতে এসেছিল ১৩৫ রানের জয়ের ভিত্তি। সৌম্যকে খুব সচেতনভাবে কোচ বলে দিয়েছিলেন তার ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংসগুলোকে হাফ সেঞ্চুরিতে পরিণত করতে।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকেও বলে দেওয়া হয়েছিলে, লুজ বলগুলোতে ব্যাট চালানোর জন্য। তারা সেটাই করেছেন। সৌম্য এদিন ৮৮ করেছেন, রিয়াদও করেছেন ৫০ রান। তবে রিয়াদের মৃদু আফসোস রয়েছে, জয় থেকে চার রান দূরে আউট হতে হয় তাকে। এদিন সৌম্য আর রিয়াদ রানগুলো করেছেন প্রোটিয়া বোলারদের ওপর দাপট খাটিয়ে। অ্যাবোটকে পয়েন্ট দিয়ে, রাবাদাকে স্কয়ার লেগ দিয়ে, মরিসকে মিডঅন দিয়ে, লংঅন, কভার- মাঠের চারপাশ দিয়েই এদিন বাউন্ডারির ফোয়ারা ছড়িয়েছেন সৌম্য।
বিশ্বকাপের প্রিয় সঙ্গীকে পেয়ে রিয়াদও দারুণ ছন্দ তুলেছিলেন। ডুমিনিকে প্যাডেল সুইপ, তাহিরকে লেট কাট মেরে স্পিন বলে তার পাকানো হাতের প্রমাণ দিয়েছিলেন। যে রাবাদা আগের ম্যাচে ছয় উইকেট নিয়ে রেকর্ড করেছিলেন, তাকেও এদিন কাউ কর্নার দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সব মিলিয়ে গোলাভরা ধান উঠে এসেছিল বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে। এসব অবশ্য কোনো জাদুর ছোঁয়ায় আসেনি, রাতভর স্টাডি করে এদিন মাঠে নেমেছিলেন মাশরাফি। আগের দিন হাতুড়ি দিয়ে পিচ পিটিয়েই মাশরাফি হয়তো বুঝেছিলেন, পেসার দিয়েই এ মঞ্চে প্রোটিয়াদের নাচাবেন।
ফিল্ডিংও সাজিয়েছিলেন জালের মতো করে, স্লিপ, গালি, পয়েন্ট, সিলি পয়েন্ট, কভার, এক্সট্রা কভার দিয়ে রীতিমতো অফসাইডে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সে ছকেই বল ফেলছিলেন মুস্তাফিজ। রানের জন্য ছটফট করতে থাকা প্রোটিয়া ওপেনার ডি কক এরপর ঠিকই ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন। মুস্তাফিজের বলটি হঠাৎ লাফিয়ে ওঠায় ব্যাট দিয়ে মুখ বাঁচাতে যান ডি কক। ললিপপ ক্যাচটি ধরতে কোনো সমস্যাই হয়নি সাবি্বরের। এরপর মাশরাফি নিজেকে সরিয়ে এনেছিলেন রুবেলকে। তার ঘণ্টায় ১৪২ কিলোমিটার গতির বলটি আমলার স্টাম্প উড়িয়ে দিয়েছিল। ৪৫ রানে ২ উইকেট, ততক্ষণে নড়েচড়ে বসেছে মিরপুরের গ্যালারি।
রানের গতিও লোকাল বাসের মতো চলছিল তখন। ফাফ ডু প্লেসিস আর রুশো বাউন্ডারি ভুলে মনোযোগ দিয়েছিলেন সিঙ্গেলস নেওয়ায়। প্রথম স্পেলে মুস্তাফিজকে ৫ আর রুবেলকে ৪ ওভার করিয়েই মাশরাফি তার ঝোলা থেকে বের করেছিলেন অফস্পিনার নাসিরকে। ওভার দ্য উইকেটে এসে প্রথম বলেই নাসির বোল্ড করে দেন রুশোকে। একেকটি রান তখন প্রোটিয়াদের কাছে হাজার ডলার মূল্য! ইনিংসের দশ থেকে পনেরো ওভারের মধ্যে মাত্র ৯ রান আসে অতিথিদের। অন্য পাশ থেকে সাকিবও চেপে ধরেন ডু প্লেসিসদের। তার মধ্যেই বল হাতে তুলে নেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। স্পিন খেলতে তখন পা জড়িয়ে যাচ্ছিল প্রোটিয়াদের।
আগের দিন যিনি সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘কিলার মিলার’ হতে চাই, সেই ডেভিড মিলারকেই নিজের শিকার বানিয়ে নেন রিয়াদ। ইনিংসের ৭ থেকে ৩২ ওভার পর্যন্ত মাত্র দুটি বাউন্ডারি হাঁকাতে পেরেছিল প্রোটিয়ারা। জালের মতো ফিল্ড সেটআপে নাসির ছিলেন সবচেয়ে ক্ষিপ্র। একটি বলও তার আশপাশ দিয়ে যেতে দেননি নাসির। একদিক দিয়ে উইকেট পড়তে থাকা, আর নিখুঁত ফিল্ডিংয়ের সামনে অনেকটা অসহায়ের মতো লাগছিল ফর্মে থাকা ডু প্লেসিসকে। নাসিরকে এগিয়ে এসে বাউন্ডারিছাড়া করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে ওতপেতে থাকা সৌম্য ডিপ মিড উইকেট থেকে লুফে নেন তার ক্যাচটি। ৯৩ রানে ৫ উইকেট, ত্রিশ ওভারেও একশ’ স্পর্শ করেনি। প্রেসবক্সে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার দুই সাংবাদিক জোহানেসবার্গে তার অফিসে ফোন করে বলছিলেন, আজ বোধহয় হচ্ছে না…!
আসলে ডু প্লেসিস ৪১ রান করে আউট হয়ে যাওয়ার পরই প্রোটিয়াদের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। এরপর যেটুকু আশা ছিল তাদের, সেটা ওই ডুমিনিকে নিয়ে। কিন্তু মুস্তাফিজকে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরিয়ে এনেই ‘কাটার’ ছাড়তে বলেন মাশরাফি। গতি কমিয়ে ১২৭ কিলোমিটারে নামিয়ে সেই সুইং! মুস্তাফিজের বিখ্যাত অফ কাটারেই শর্টকভারে মোওয়া ক্যাচ তুলে দেন ডুমিনি। এরপর দেড়শ’ পার করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় অতিথিদের। মুস্তাফিজের পাশাপাশি রুবেলও ফিরে আসেন দ্বিতীয় স্পেলে।
ইয়র্কার, বাউন্সার, শর্ট বল- সব অস্ত্রই একেক করে বের করছিলেন রুবেল। যেন এই সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে জমানো সব শক্তি উগরে দিচ্ছিলেন। সেই রুবেলের সামনেই এলবিডবি্লউ হয়ে যান মরিস। শেষ দিকে রাবাদা আর বোহারদিন মিলে চলি্লশ ওভারের পর বেপরোয়া কিছু শট খেলে দু-চারটি বাউন্ডারি পেয়েছিলেন বটে, তাতে হয়তো দেড়শ’ পার হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের সর্বনিম্ন রান ১৬২ থেকে রক্ষা করতে পারেননি। স্কোর বোর্ডে ১৬২ দেখে কি খুব কষ্ট হচ্ছিল আমলাদের, যেমন কষ্ট হয়েছিল চার বছর আগে বাংলাদেশের।
সেবার ৭৮ রানে অলআউট হওয়াটা আজও নীরবে কাঁদায় সাকিবদের, হয়তো গতকালের ইনিংসটিও এভাবে ক্ষত হয়ে থাকবে প্রোটিয়াদের মনে। আফসোস শুধু একটাই, এদিন বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামী ম্যাচটি মিরপুরের ভরা গ্যালারি উপভোগ করতে পারেনি। হতাশা থেকেই হয়তো অনেকে মাঠে আসেননি। তবে যারা এসেছিলেন তারা সুদে-আসলে পয়সা উসুল করে গেছেন। এখন পালা চট্টগ্রামের দর্শকের, বুধবার সিরিজের শেষ ম্যাচটি তারা অন্তত মিস করবেন না।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া, দ্রুত সমাধানের আশ্বাস
টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেবিস্তারিত পড়ুন
প্রোটিয়াদের রানের পাহাড়, টাইগাররা নামতেই বদলে গেল পিচের ধরন!
চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ৫ সেশনেরও বেশি সময় ব্যাটিং করেছে দক্ষিণবিস্তারিত পড়ুন
নেপালকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে সাফবিস্তারিত পড়ুন