বক্স-অফিস কাঁপানো জুটির নতুন ছবি নিয়ে তখন কথা পাকা হচ্ছে। নায়ককে ডাকলেন নায়িকা। বললেন, ‘‘উতো শুনেছিস, আমাদের নাম ভাঙিয়ে ওরা কী-হারে লাভ করে চলেছে! আমি এই বলে দিলাম, তুই আর আমি কেউই এ বার থেকে এক লক্ষ টাকার কমে কাজ করব না।’’

‘ওরা’ মানে এখানে প্রযোজক-গোষ্ঠী। ‘উতো’ উত্তমকুমার আর নায়িকা সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা, মানে তাঁর ‘রমা’র কথা ফেলতে পারেননি উত্তমও। ষাটের দশকের গোড়ার কথা। সুচিত্রার ইন্ধনেই এক লাফে দু’জনের পারিশ্রমিক তিন-চার গুণ বেড়ে যায়।

প্রয়াণের দু’বছর বাদে ফের সুচিত্রার ছায়া টালিগঞ্জে। সদ্য মু্ক্তি পাওয়া একটি ছবির পোস্টারে নায়িকার চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। একটু ঢেউ খেলানো, ঘাড়ের সীমানায় শাসিত কেশসাজ।

সুচিত্রার আদলে পোস্টারের মুখ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এ ছবির নামও ‘মহানায়িকা’। এই নতুন ছবি সুচিত্রা সেনের জীবন-কাহিনি কি না, সে কৌতূহল কবেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এখন অনেকেই বলছেন, ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘শকুন্তলা সেন’-এর স্বকীয় সত্তার মধ্যে সুচিত্রা সেনের ঘাড় সোজা রাখা ব্যক্তিত্বেরই ছাপ পড়েছে। তাঁর প্রিয় ‘উতো’র সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দুরন্ত বোঝাপড়া থাকুক। কাজের ক্ষেত্রে মর্যাদার প্রশ্নে কারও কাছেই মাথা নোয়ানোর বান্দা ছিলেন না সুচিত্রা। টাইটল কার্ডে নায়কের আগে তাঁর নাম বসানোর দাবি পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন সকলে। খোদ উত্তমকুমারও আপত্তি করেননি।

নায়ক না নায়িকা কে বড়, সে প্রশ্নটা এত দিন পরে ফের উস্কে দিচ্ছে ঋতুপর্ণার ‘মহানায়িকা’ও। কারণ ইন্ডাস্ট্রিতে সুচিত্রা সেনেরা ব্যতিক্রম। চিত্রনাট্য, পোস্টার থেকে পারিশ্রমিকে ধারাবাহিক ভাবে নায়কই এগিয়ে। দেখা যায়, নায়কদের ইনিংস তুলনায় লম্বা। নায়িকাদের কেরিয়ারে অকাল যবনিকা পড়েছে। নানা সামাজিক চাপেও নায়িকারা বারবার পিছিয়ে পড়েছেন। ‘মহানায়িকা’য় ফিল্মি তারকা ‘শকুন্তলা সেন’-এর সঙ্কটটাও তেমনই। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকার সময়েই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রভাবশালী একটি ফিল্ম নির্মাতা পরিবারে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তাতেই যত বিপত্তি। হবু শ্বশুরের ফরমান, বিয়ের পরে পারিবারিক ব্যানার ছাড়া সব অভিনয় বন্ধ। নায়িকা তথা অভিনেত্রীর জন্য যা নিজের শিল্পী-সত্তাকে বিকিয়ে দেওয়ার সমান। ঋতুপর্ণার কথায়, ‘‘নায়িকাদের চলার পথে এমন টানাপড়েন থাকেই। কিছু দিন আগেও লোকে ভাবত হিরোইনের বিয়ে হলে সে অচল।’’ অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে, একদা ‘ব্যক্তিগত’ কারণে প্রসেনজিতের সঙ্গে কাজ করবেন না-বলে অজস্র ফিল্মের অফার ছেড়ে দিয়েছিলেন ঋতু। এর মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ বা ‘দোসর’-ও রয়েছে।

এত দিন বাদে অবশ্য প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণা নতুন করে জুটি বাঁধছেন। প্রসেনজিতের মতে, ‘‘সুচিত্রা সেনের পরে টালিগঞ্জের নায়িকাদের মধ্যে অপর্ণা সেনও হিরোদের সমান মর্যাদা নিয়ে কাজ করেছেন। আমার নায়িকাদের মধ্যে দেবশ্রী রায়, ঋতুপর্ণা অসম্ভব ক্ষমতাশালী।’’ তাঁর মতে, ‘‘শুধু নায়ক নয়! ছবির স্বার্থেই নায়িকা-পরিচালক-পার্শ্বঅভিনেতা-কলাকুশলীদের আরও মর্যাদা জরুরি।’’

বলিউড কিছু কাল হল এ পথে হাঁটতে শুরু করেছে। ‘কুইন’ ও ‘তন্নু ওয়েডস মন্নু রিটার্নস’ বাজেটের চারগুণো ব্যবসা করার পরে বলিউডে কঙ্গনা রানাওয়াত যেমন ফিল্মপিছু ১১ কোটি টাকার দর হাঁকিয়েছেন। নায়কদের সমান টাকা নায়িকাদের ন্যূনতম প্রাপ্য বলে তিনি দাবি করেন। বলিউডে এখনও ‘খানে’রা ছবির লভ্যাংশের খানিকটা ভাগ দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, ক্যাটরিনা কাইফ, বিদ্যা বালন, আলিয়া ভট্টরা উঠে আসছেন। চিত্রনাট্য, পারিশ্রমিক— সবেতেই এর প্রভাব পড়ছে। ‘বাজিরাও মস্তানি’-তে দেখা গিয়েছে রণবীর সিংহের থেকে কম যান না দীপিকা বা প্রিয়ঙ্কা। বলিউডের ট্রেড অ্যানালিস্ট তরণ আদর্শ মনে করাচ্ছেন, ‘‘মীনাকুমারী, মধুবালা, রেখা, শ্রীদেবী, মাধুরীরাও বহু ছবি একা টেনেছেন।’’ তবে তাঁর কথায়, ‘‘ইদানীং নায়িকাদের নিছকই সেক্স-সিম্বল হিসেবে দেখার প্রবণতাটা পাল্টাচ্ছে। কেউ কেউ অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। ফলে, ফিল্ম ব্যবসায় নায়িকাদের গুরুত্বও ইদানীং প্রকট।’’

টলিউডে অভিনয়ের বৈচিত্র্য ও ধারাবাহিকতায় ঋতুপর্ণা অনেক দিন ধরেই আলাদা মর্যাদা পান। নায়কের পাশে ঠিকঠাক গুরুত্ব না-পেলে ছবি ছেড়ে দেওয়ার স্পর্ধাও দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি। টালিগঞ্জের প্রথম সারির পরিচালকদের এক জন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘ঠিকঠাক চরিত্র বা স্ক্রিপ্ট চিনতে পারার ক্ষমতাটাও শিল্পীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’’ ‘মহানায়িকা’ ছবি তারকা-অভিনেত্রীর কাছে নিজেকে চেনার দৌড়। ‘‘শকুন্তলা সেনের মধ্যে সব যুগের নায়িকাদের লড়াইটাই ছুঁতে চেয়েছি,’’ বলছেন ঋতুপর্ণা।