নিজামী-মীর কাসেমের ফাঁসি : দুই মন্ত্রীর জরিমানা
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। এ ঘটনায় তাদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন আদালত। সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুই মন্ত্রীকে অর্থদণ্ড দেয়ার সাজার বিষয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠে। তাদের মন্ত্রিত্ব থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজ্ঞরা।
একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে জামায়াত ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও ধনকুবের হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকছে কিনা এবং তাদের ফাঁসি কার্যকর নিয়ে ছিল ব্যাপক আলোচনা।
নিজামীর আপিল ও ফাঁসি কার্যকর:
১৪ মে মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একাত্তরের ভয়ঙ্কর বাহিনী আলবদরের নেতা ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকরের পঞ্চম ঘটনা ছিল এটি। তিনি ছিলেন বিএনপি জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের(সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি।
রাত ১২টা ৩৩ মিনিটে দুটি অ্যাম্বুলেন্স মরদেহ নিতে কারাগারে ঢোকে। দেড়টায় অ্যাম্বুলেন্স দুটি কারাগার থেকে বের হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা দেয় পাবনার সাঁথিয়ার উদ্দেশে।
পরিবারের ২৩ সদস্য রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে তিনটি গাড়িতে করে নিজামীর সঙ্গে শেষ দেখা করতে কারাগারে যান। তারা ৯টা ৩৩ মিনিটে বেরিয়ে আসেন। আপিল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে বলা হয়েছে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার। ২০০০ সালে সেই নিজামীই হন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের আমির। এমন কি বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) তিনি প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হন। তার গাড়িতে উড়তো জাতীয় পতাকা।
এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, নিজামীকে এ দেশের মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লাখ নারীর গালে চড় মারা হয়েছে। এটা জাতির জন্য লজ্জা, অবমাননা।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসি নিয়ে দ্বন্দ:
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২৩ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় এই নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এটি ফাঁসি কার্যকরের ষষ্ঠ ঘটনা। তাঁদের পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর এবং একজন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।
‘বাঙালি খান’ হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর ৪০ নম্বর কনডেমড সেলে ছিলেন মীর কাসেম। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাশিমপুর কারাগারে এই প্রথম কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম বদল করে ছাত্রশিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। মীর কাসেম ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আপিল বিভাগের রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলেও আরও পাঁচজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মরদেহসহ তাঁর মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
দুই মন্ত্রীর সাজা:
আদালত অবমাননার দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী দুই মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। পরে ওই জরিমানার টাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও লিভার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে দেন মন্ত্রীরা।
সাজা নিয়ে তারা মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। আইনজীবীদের একটি বড় অংশই সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকলেও নৈতিকতার প্রশ্নে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত বলে মত দিয়েছিলেন। তবে দুই মন্ত্রীর থাকা না-থাকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
রায়ে দুই মন্ত্রীকে সাত দিনের মধ্যে দণ্ডের অর্থ পরিশোধ না করলে এক সপ্তাহ করে জেল খাটতে হবে বলা হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই আদেশ দিয়েছিলেন।
তার আগে ২০ মার্চ এ দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা রুলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, দুই মন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তাঁদের আইনজীবীদের কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছিলেন, সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে তা ভঙ্গের পরিণতি কী হবে?
৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনঃশুনানির দাবি জানিয়েছিলেন। ওই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে অংশ না নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। একই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। এরপর ৮ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল দেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন ‘আমরা সব বিচারক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। আমরা আদালত অবমাননা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাই না। শুধু দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রসিডিংস ড্র(কার্যক্রম নেয়া)করেছি সারা জাতিকে একটি বার্তা দেয়ার জন্য। ভবিষ্যতে যেন কেউ এ ধরনের অবমাননার পুনরাবৃত্তি না করেন। তারা দেখুক আমরা কত কঠোর হতে পারি’।
তাঁদের বক্তব্য বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল এবং তা বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। যদি তাঁদের ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে যেকোনো ব্যক্তি বিচার বিভাগ সম্পর্কে একই রকম অবমাননাকর বক্তব্য দেবেন। এজন্য তাঁদের গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। তবে প্রথম সুযোগেই তাঁরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে উদারতা দেখানো হয়েছে’।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি বড় অংশ মনে করে, নৈতিকতার প্রশ্নে সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ। আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যদি তাঁরা পদত্যাগ না করেন, আশা করব প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করবেন।তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত লোক মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না, এজন্য কোনো আইনের প্রয়োজন হয় না।
দুই মন্ত্রী নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত:
আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রীর সাজায় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত বলেছিলেন আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, দুই মন্ত্রীর ঘটনায় বর্তমান সরকার, সবারই ক্ষতি হয়েছে। ন্যায়-নিষ্ঠার ওপরে কেউ নন। সবাইকে ন্যায়-নিষ্ঠার মধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। বিচারও হতে হবে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলেই আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। এসব বিষয় নিয়ে যিনি দায়িত্বে আছেন, বা যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের আরও বেশি করে ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
অভিযুক্ত দুই মন্ত্রীর পদে থাকা যৌক্তিক কি না, এমন প্রশ্নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমি এই বিতর্কে জড়াতে চাই না। তবে সবাই নৈতিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।পদত্যাগ করা, না করা নৈতিকতার ওপর নির্ভর করে’। জাগোনিউজ
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন
ময়মনসিংহে ওসি-এসপি’র বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর
সরকারি দায়-দায়িত্ব ও কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের যথাযথবিস্তারিত পড়ুন
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জনগণের সাথে রায়েছে বিচার বিভাগ
দেশের মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিচার বিভাগ জনগণের সঙ্গে আছেবিস্তারিত পড়ুন