নিজেদের দায়িত্ব বিষয়ে জানেন না জেলা পরিষদ সদস্যরা!
জেলা পরিষদে নির্বাচনে বিজয়ী ওয়ার্ড সদস্যরা জানেন না তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের মর্যাদা কী হতে পারে, সেই বিষয়েও ওয়াকিবহাল নন এই সদস্যরা। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই কাজকর্ম হতে পারে—এমনটি মনে করেই তারা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তাদের মতে, সরকার যেহেতু নির্বাচন দিয়েছে, সেহেতু কোনও না কোনও দায়িত্বও তাদের দেওয়া হবে। আইনে জেলা পরিষদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া থাকলেও পরিষদ সদস্যদের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা দেওয়া নেই। আইনে এ বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়নের কথা থাকলেও আইন প্রণয়নের পর গত ১৬ বছরে সরকার কোনও বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি।
বুধবার পার্বত্য তিন জেলা বাদের দেশের ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিষদের চেয়ারম্যান ছাড়াও সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে নির্বাচন হয়। প্রতিটি জেলাকে ১৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৫টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে বিভক্ত করে এই নির্বাচন হয়। এই হিসেবে ৬১ জেলায় ৯১৫টি সাধারণ ও ৩০৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিভক্ত করে এসব পদে ভোট হয়েছে। নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এতে ৫ থেকে ৮টি ইউনিয়ন মিলে একটি সাধারন ওয়ার্ড ও ১৫ থেকে ২৪টি ইউনিয়ন মিলে একটি সংরক্ষিত ওয়ার্ড গঠিত হয়।
নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিত ওয়ার্ড সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বেশিরভাগ প্রার্থীই পদমর্যাদা ও দায়িত্ব-কর্তব্য না জেনে বুঝেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনি সীমানার আয়তন বেশি মনে করে ক্ষমতা বেশি থাকবে, এমনটা মনে করে তারা আগ্রহী হয়ে নির্বাচনে এসেছেন।
এদিকে এখতিয়ার না জানলেও বিজয়ী হতে মরিয়া ছিলেন সদস্য পদের প্রার্থীরা। গড়ে ৬৯ জন ভোটারের এই নির্বাচনে কেউ-কেউ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে ভোটার-প্রতি এক থেকে দুই লাখ টাকা খরচ করেছেন বলে নির্বাচনের পর জানা যাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো জেলা পরিষদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনেও নির্বাচনে টাকা ছড়াছড়ির অভিযোগের কথা জানিয়েছে। তারা বলেছে, নির্বাচনে যেভাবে টাকা ছড়াছড়ির খরব পাওয়া গেছে, তাতে এই নির্বাচনকে আদর্শ নির্বাচন বলা যায় না।
জেলা পরিষদ আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০১৬) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর কয়েকটি ধারায় জেলা পরিষদের কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। পরিষদের বাধত্যমূলক ও ঐচ্ছিক এই দুই ধরনের কাজ রয়েছে। বাধ্যতামূলক কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে ১। জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, ২। উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা, ৩। সাধারণ পাঠাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ, ৪। উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা বা সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত নয়, এমন জনপথ, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন, ৫। রাস্তার পাশে ও জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ, ৬। জনসাধারণের ব্যবহারার্থে উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ, ৭। সরকারি, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভার রক্ষণাবেক্ষণে নয় এমন খেয়াঘাটের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ, ৮। সরাইখানা, ডাকবাংলা এবং বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ, ৯। জেলা পরিষদের অনুরূপ কার্যাবলি সম্পানরত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা, ১০। উপজেলা ও পৌরসভাকে সহায়তা, সহযোগিতা এবং উৎসাহ দেওয়া, ১১। সরকার কর্তৃক জেলা পরিষদের ওপর অর্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও ১২। সরকার কর্তৃক আরোপিত অন্যান্য কাজ।
আর ঐচ্ছিক কাজের মধ্যে রয়েছে, শিক্ষা, সাংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, অর্থনৈতিক কল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত ইত্যাদি। এছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে টোল আদায়ের কাজও পরিষদের রয়েছে।
প্রসঙ্গত, আইনে জেলা পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া থাকলেও এর সদস্যদের কাজের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে দায়িত্ব কর্তব্য নির্ধারণের জন্য আইনে বিধি প্রণয়নের বিধান রাখা হয়েছে। তবে ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করা হলেও এখনপর্যন্ত বিধি তৈরি করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘এই নির্বাচনটা প্রথমবারের মতো হয়েছে। দায়িত্বের বিষয়টি আমরা সেভাবে ওয়াকিবহাল নই। এই পদের কাজ কী, তাও জানি না। এই নিয়ে সরকার হয়তো প্রজ্ঞাপন জারি করে আমাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিক করে দেবে। সরকার যখন নির্বাচন দিয়েছে, নিশ্চয়ই দায়িত্বও স্পষ্ট করবে।’
একই জেলার ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সদস্য ফারুজ্জামান ফারুকও একই ধরনের মন্তব্য করেন। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমাদের পদের অধিক্ষেত্র কী, মর্যাদা বা ক্ষমতা কী, সেটা এখনও জানি না। আগে থেকে জানার চেষ্টাও করিনি। নির্বাচন সামনে এসেছে। তাই অংশ নিয়েছি। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কাজ আমাদের থাকবে।’
বরগুনা জেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী (৫ নম্বর ওয়ার্ডের) সদস্য ফৌজিয়া খানম বলেন, ‘আমাদের কাজ কী, সেটা জানি না। জেলা পরিষদ যেহেতু বড় একটি পরিসর, নিশ্চয়ই কাজ তেমনটি হবে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কিছু না কিছু সম্মান তো নিশ্চয়ই পাব।’
বরিশাল জেলা পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী সদস্য মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের কর্তব্য কী হবে, সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা আমার নেই। তবে নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণলয়ে এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। জেনেছি আমাদের কাজের পরিধি ঠিক করে দেওয়া হবে। যতদূর আমি বুঝতে পেরেছি, তাতে বলতে পারি, আগে যে জেলা বোর্ড ছিল, তার আদলে একটি পরিপূর্ণ পরিষদ হবে।’ মর্যাদা সম্পর্কে নব নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘দায়িত্ব-কর্তব্যের মতো এটার বিষয়েও তাদের ধারণাটা অস্পষ্ট। তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা যে মর্যাদা পাচ্ছেন, আমাদেরও সেই মর্যাদা দেওয়া হতে পারে।’
খুলনা জেলা পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিজিত সদস্য শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল হওয়ার পর সদস্য পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলাম। পরে পরিচিত লোকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওই পদের দায়িত্ব ও মর্যাদা এখনও স্পষ্ট নয়। অল্প কয়েকটি ভোটের এই নির্বাচনে জিততে হলে খরচও করতে হবে অনেক। যে কারণে পরে নির্বাচন থেকে সরে গেছি। যেভাবে টাকা ছড়াছড়ির খরব শুনতে পাচ্ছি, তাতে মনে হয়, প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তটা ভালোই হয়েছে।’
জেলা পরিষদের দায়িত্ব-কর্ত্যব্য সম্পর্কে মঙ্গলবার বিসিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘স্থানীয় অবকাঠামো তৈরি, সমন্বয় করা, বিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান নির্মাণ, কৃষি কাজ সহায়তার জন্য জেলা পরিষদ ছোট ছোট খাল তৈরি করবে। জেলা পরিষদের এ রকম অনেক কাজ করার আছে।’
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও গত ৫ বছরে তাদের মর্যাদা বা কার্যাবলি স্পষ্ট করেনি সরকার। এ জন্য প্রতি বছর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় প্রশাসকেরা মর্যাদা নির্ধারণসহ তাদের এখতিয়ারের বিষয়টি নির্ধারণ করে দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। তবে এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনও সদুত্তর দেওয়া হয়নি।
চলতি বছর মার্চে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পর্যালোচনা সভায় এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জেলা পরিষদের প্রশাসকরা যেসব অভিযোগ ও দাবি উত্থাপন করেছেন, তার সবই ঠিক। আমার ক্ষমতা থাকলে সবকিছু এখনই বাস্তবায়ন করতাম। আমার পক্ষে যেটুকু মানা সম্ভব, সেটুকু দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।’
এর আগে ২০১৩ সালের ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বলেছিলেন, ‘আবার সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা পরিষদ প্রশাসকদের ক্ষমতার পরিধিও বাড়ানো হবে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘জেলাভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন করা হবে। কেন্দ্রের কাছে শুধু বাজেট এলোকেশন, পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। জেলা পরিষদ প্রশাসকরা সব উন্নয়ন কাজ তদারকি করবেন। ভবিষ্যতে জেলা পরিষদের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন দায়িত্বও দেওয়া হবে। তবে গত ৩ বছরে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ফের ২ দিন রিমান্ডে আনিসুল হক
রাজধানীর বাড্ডা থানার স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা আল-আমিন হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
জামিন পেলেন সাবেক বিচারপতি মানিক
অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকেবিস্তারিত পড়ুন