নিরাপত্তার ফাঁক গলে গ্রেনেড হামলা
নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। ছিল পুলিশের ঘোষিত ‘নিশ্ছিদ্র’ প্রস্তুতিও। নিয়োজিত ছিলেন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির দেড় হাজার সদস্য। নজরদারির জন্য ছিল ৩২টি সিসি ক্যামেরা। ছিল চারটি মেটাল ডিটেক্টর এবং ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক। এর মধ্যেই শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে গ্রেনেড হামলা হয় পুরান ঢাকার হোসেনি দালান ইমামবাড়ার ভেতরে। এক কিশোরের প্রাণ নিয়ে, দেড় শ মানুষকে আহত করে হামলাকারীরা নিরাপদে পালিয়েও গেছে।
তাহলে নিরাপত্তাব্যবস্থা কি কার্যকর ছিল না? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে ওই এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পবিত্র আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালান ইমামবাড়া ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তারব্যবস্থা বলতে যা ছিল, তা ছিল অনেকটা ঢিলেঢালা। রাতে ইমামবাড়ার ভেতরে যাওয়া কোনো লোককে তল্লাশির মুখে পড়তে হয়নি। ইমামবাড়ার কোনো ফটকে আর্চওয়ে ছিল না। যে চারটি মেটাল ডিটেক্টর ছিল, সেগুলোও ছিল ইমামবাড়ার স্বেচ্ছাসেবীদের। তাঁরা সেগুলো হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছেন। মূল ফটকে যেসব পুলিশ ও র্যাব সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন, জনস্রোতের সামনে তাঁরা ছিলেন অনেকটা ‘দর্শকের’ মতো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, নিরাপত্তায় কোনো ফাঁকফোকর ছিল না। তিনি বলেন, পুলিশ যখন ভোররাতের মিছিল এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইমামবাড়ার ফটকের বাইরে অবস্থান নেয়, ঠিক তখনই হামলাকারীরা ইমামবাড়ার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটায়।
হামলার ৩৬ ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে ইমামবাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ফটকের সামনের সব দোকান তুলে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের গাড়ি। এর বাইরে গণমাধ্যমকর্মী ও ইমামবাড়ার পরিচালনা কমিটির কিছু লোকজন ছাড়া কেউ নেই। পরিবেশ থমথমে। সবার চোখেমুখে বিষাদের ছাপ।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গাবতলীতে তল্লাশি করার সময় ছুরি মেরে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার মাসুদ রানার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা ও বগুড়া থেকে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে পুলিশ জানিয়েছিল, বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা হচ্ছে। এর আগে ২১ অক্টোবর বুধবার দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তাজিয়া মিছিলের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব সরকারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘তাজিয়া মিছিল বাস্তবায়ন কমিটিকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। শুক্রবার রাত ১২টার পরে তাজিয়া বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ ও ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আশুরার মিছিলের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরাও শঙ্কিত ছিলেন। এ কারণে পুলিশের মহাপরিদর্শক, কমিশনার ও লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা কাজে যুক্ত হন ইমামবাড়ার ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবী। ইমামবাড়ায় আগে থেকেই ১৬টি সিসি ক্যামেরা ছিল। আশুরা উপলক্ষে আরও ১৬টি ক্যামেরা বসানো হয়। নতুন করে বসানো ১৬টি ক্যামেরার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশকে। ইমামবাড়ার ভেতরে লাইব্রেরিতে সেই ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয়। ইমামবাড়ার ভেতরের সব দৃশ্য এই ৩২টি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
ইমামবাড়ার ভেতরে স্থাপন করা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে দেখা গেছে, পিন খুলে এক যুবক দুবার হাত ঘুরিয়ে কিছু একটা ছুড়ে দিচ্ছেন। আর বিকট শব্দে তা ফেটে যাচ্ছে। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন, বাকিরা ছোটাছুটি করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কয়েকজন নিক্ষেপকারীকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। হামলার পর একজন চলে যাচ্ছে।
পুলিশ জানায়, ইমামবাড়ার ভেতরের কবরস্থানের পাশ থেকে হামলা করা হয়েছে। হামলার পর কবরস্থানের ভেতর দিয়ে প্রাচীর টপকে চলে গেছে হামলাকারীরা। কিন্তু সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তাদের পালানোর দৃশ্য নেই। কারণ, কবরস্থান কোনো ক্যামেরার আওতায় ছিল না। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটা হয়তো হামলাকারীরা জানত। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কোন নিরাপত্তা ছক বা বিশ্লেষণ থেকে এই এলাকাটি ক্যামেরার বাইরে থেকে গেল? আর যে সিসি ক্যামেরাগুলো ছিল, সেগুলোর মাধ্যমে পুরো জায়গার ওপর নজর রাখার কথা নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে। কোন দিক থেকে হামলা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাবেন, যাতে হামলাকারীদের অন্তত ধরা যায়। কিন্তু গত দুই দিন উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশনামতে নিরাপত্তায় যুক্ত ব্যক্তিরা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কর্মকর্তাও গত দুই দিনে এমন কোনো তাৎক্ষণিক তৎপরতার তথ্য দেননি।
তবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণের পর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা গতকাল রোববার বলেন, তাঁদের ধারণা, হামলাকারী দুজন ছিল। ইমামবাড়ার ভেতরে পাঠাগারের পশ্চিম কোণে তারা অবস্থান করছিল। হামলা চালিয়ে তারা কবরস্থানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকের অপেক্ষাকৃত নিচু প্রাচীর টপকে পালিয়ে যায়। অনেক মানুষ সেটা দেখেছে, কিন্তু হামলাকারীদের ধরতে কেউ এগিয়ে যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ১৯ অক্টোবর আশুরার নিরাপত্তা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আশুরার নিরাপত্তার জন্য আড়াই হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এরপর গত শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহত ব্যক্তিদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, শুক্রবার রাতে হামলার সময় সেখানে দেড় হাজার পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাজিয়া মিছিল যে দিক দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সে পথগুলোর দুই পাশে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। এ ছাড়া সেই পথগুলোর দুই পাশের বহুতল ভবনগুলোর ছাদেও পুলিশ ছিল। এত নিরাপত্তার ভেতরেও কীভাবে হামলা হলো—জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, ‘হোসেনি দালানের ভেতরটা দেখেছেন? চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত। ওই সুরক্ষিত ভবনটির ভেতরে শুধু আশুরা পালন করতে আসা লোকজনই ছিল। হয়তো তাদের ভেতর থেকে কেউ এই হামলা চালিয়েছে।’
শনিবার হাসপাতালে ডিএমপি কমিশনারের এই বক্তব্যের সময় হোসেনি দালান কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মির্জা নকি হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ডিএমপি কমিশনার তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা এখনো বলছি, আশুরার আয়োজন ঘিরে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল। যাঁরা ভেতরে ছিলেন, তাঁরা সবাই আপনাদের লোক। এঁদের মধ্য থেকে কেউ এই হামলার ঘটনাটি ঘটাতে পারেন। বাইরে থেকে কোনো হামলা হয়নি। ভেতরে থাকা লোকদের মধ্য থেকেই কেউ গ্রেনেডগুলো ছুড়ে মেরেছেন।’
মির্জা নকি হাসান ওই দিন হোসেনি দালানে বলেন, হোসেনি দালানের ৪০০ বছরের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা এটাই প্রথম। সেদিন রাতে ফটকের পশ্চিম দিকে প্রথম গ্রেনেডটি পড়ে। সেখানে থাকা অনেক নারী-পুরুষ, শিশু পেছনের ফটকের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। এর পরপরই আরও দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়।
ইমামবাড়ার আশপাশের লোকজন গতকালও বলেছেন, পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতিতে তাঁরা ওই দিন বিরক্তই ছিলেন। এত বেশি পুলিশ এর আগে কখনো আসেনি। কিন্তু হামলার পর এখনো এঁরাও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করছেন।
হোসেনি দালান পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, পুলিশ তাদের মতো বিভিন্ন স্থানে থাকলেও লোক এত বেশি ছিল যে তাদের কিছু করার ছিল না। এ সময় তাঁর পাশে থাকা এক ব্যক্তি বললেন, ‘পুলিশ হুদাই খাড়ায়া আছিল। কাউরে তো সার্চ (তল্লাশি) করে নাই।’ তাঁর মতে, পুলিশ তল্লাশি করলে গ্রেনেড নিয়ে কেউ ইমামবাড়ার ভেতরে যেতে সাহস পেত না।
জানতে চাইলে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নিরাপত্তার কোথাও ফাঁকফোকর ছিল কি না, সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি। যদি কোনো গাফিলতি থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভেতরে আসা লোকদের তল্লাশি করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ইমামবাড়ার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক মির্জা মো. ফিরোজ হোসাইন বলেন, রাতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট ছোট মিছিল এসে ঢুকছিল ইমামবাড়ার ভেতরে। এসব মিছিলে আসা লোকজনের হাতে-গায়ে লোহার চেইন বা চাকু লাগানো চেইনও থাকে। এত ভিড়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক লোকজনকে তল্লাশি করা সম্ভব নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক ইলাহী চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, যেখানে হামলা হয়েছে, তা একটি উন্মুক্ত জায়গা। এসব জায়গায় শতভাগ নিরাপত্তা দেওয়াটা খুব কঠিন। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশেও এ ধরনের হামলা হয় এবং হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে চলে যেতে সক্ষম হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। ক্ষতি আরও বেশি হতে পারত। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে সব বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে হবে।’
নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সংখ্যা ছিল
১৫০০
হোসেনি দালানের বিভিন্ন অংশে সিসি ক্যামেরা ছিল
৩২টি
গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়
৫টি
নিহত ১, আহত ১৫০
সূত্রঃ প্রথম আলো
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
তারেক রহমান: আগে ভারতীয় শিল্পী আসতো, এখন পাকিস্তান থেকে আসে
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেশি শিল্পীদের উপেক্ষা করে ভারত ও পাকিস্তানবিস্তারিত পড়ুন
নির্বাচন নিয়ে সরকারের এত গড়িমসি কেন, প্রশ্ন রিজভীর
“নির্বাচন নিয়ে সরকারের এত গড়িমসি কেন”, এমন প্রশ্ন তুলে বিএনপিরবিস্তারিত পড়ুন
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন