পুলিশ দিয়েছিলো পতিতার লাইসেন্স, আর সাংবাদিকেরা দিলো মুক্তি !
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের বিভিন্ন কৌশলে ধরে এনে বিক্রি করা হচ্ছে ফরিদপুরের বিভিন্ন পতিতাপল্লীগুলোতে। এরপর এইসব অসহায় মেয়েদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর পূর্বক বাধ্য করা হচ্ছে অবৈধ দেহ ব্যবসায়। পড়াশোনা না জানা গ্রামের এইসব মেয়েদের অধিকাংশই জানেনা কবে তাদের মুক্তি মিলবে? কিংবা আদৌ মুক্তি মিলবে কিনা এই বন্দিদশার জীবন থেকে। অন্যদিকে, নারী পাচারকারী, দালাল ও পতিতা সর্দারনীদের ভয়ভীতির মুখে তারা কাউকে সহজে জানাতেও সাহস পায়না তাদের বন্দিদশার কথা।
নারী পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে ফরিদপুরের রথখোলা পতিতাপল্লীতে বিক্রি হওয়া এমনই একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরী জবা (ছদ্মনাম)। জন্মের পর বাবা মা আদর করে একটি নাম রাখলেও সেটি হারিয়ে গিয়েছিল নারী পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে। (সঙ্গত কারণেই নাম পরিচয় গোপন রাখা হলো)। পতিতাপল্লীতে ওকে দেয়া হয়েছিল এই জবা নামটিই। গত প্রায় ১ বছর ৮ মাস ফরিদপুরের রথখোলা পতিতাপল্লীর চার দেয়ালের মাঝে প্রতিদিন অগণিত খদ্দেরের ভোগের পণ্য হয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছিল সে। অবশেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অদম্য বাসনায় মুক্তি মিলেছে জবার। সাংবাদিকের হস্তক্ষেপে গত শনিবার রাতে অভিভাবকদের হাত ধরে সে ফিরে গেছে আপন ঠিকানায়। রোববার সকালে জবার পিতা এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। জবার জীবনে আবারও স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে কি না এটিই সময়ের প্রশ্ন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে জবার মতো আরো শত শত মেয়ে এখনো প্রতিদিন বোবা কান্না করে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। পতিতাপল্লীর চার দেয়ালে বন্দি ওদের কান্না শোনার মতো কেউ নেই যেনো। মুক্তির পর জবার জবানবন্দিতে জানা গেছে এ তথ্য।
জবার ভাষ্য মতে, ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকরীর জন্য ১ বছর ৮ মাস আগে সে দেশের বাড়ি থেকে রাজধানী ঢাকায় রওনা হয় ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরীর জন্য। যাত্রাবাড়ি বাসষ্ট্যান্ড থেকে মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ার একটি বাসায় যাওয়ার জন্য একটি ট্যাক্সিতে চড়লে পথে সে সংঘবদ্ধ পাচারকারীদের খপ্পরে পরে। এরপর পাচারকারীরা তাকে খাবারের সাথে নেশা জাতীয় কিছু মিশিয়ে খাইয়ে অজ্ঞান করে নিয়ে যায় একটি বাসায়। ঘুম থেকে জাগার পর সে কান্নাকাটি করতে থাকে। এরপর তাকে গার্মেন্টসে চাকরী দেয়ার কথা বলে নিয়ে আসা হয় ফরিদপুরের রথখোলা পতিতাপল্লীতে। সেখানে তাকে রথখোলা পতিতাপল্লীর বড় বাড়ির সর্দারনী মর্জিনার কাছে বিক্রি করা হয়। ১ লাখ টাকায় জবাকে কিনে নেয় সর্দারনী মর্জিনা। এমনই জানানো হয় তাকে। এরপর চলে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার প্রক্রিয়া।
জবা জানায়, প্রথম দিনেই তাকে হাজির করা হয় টিএসআই (টাউন সাব ইন্সপেক্টর) এর সামনে। তার আগে জবাকে বলা হয় যেনো সে টিএসআইকে বলে যে সে স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে। নইলে তাকে পঙ্গু ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে (পঙ্গু ঘরে) তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে পঙ্গু জীবন নিয়ে। ভীতসন্ত্রস্ত অসহায় জবা সর্দারনীর কথামতো বাধ্য হয় এই মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে। তবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অদম্য বাসনা কখনোই কমেনি তার। কথায় কথায় একদিন এক খদ্দেরের কাছে সে বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিষয়টি জানায়। এরপর ওই খদ্দের জবার নিকট থেকে তার বাবার মোবাইল নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে পুরো বিষয়টি পরিবারের কাছে জানায়।
জবার বাবা এই প্রতিবেদককে জানান, প্রথমে একজন অপরিচিত লোকের মাধ্যমে তিনি মেয়ের সন্ধান পান। এরপর মোবাইলে মাঝেমধ্যেই কথা হতে থাকে জবার সাথে। মোবাইলে কথা বলার সময় তার মেয়ে শুধু কান্নাকাটি করে যেকোনভাবে তাকে উদ্ধারের জন্য আকুতি মিনতি জানাতে থাকে। পিতা হয়ে মেয়ের এই কান্না তার নিকট অসহ্য ছিল। কিন্তু হতদরিদ্র বাবার পক্ষে জানা ছিল না কিভাবে তাঁর মেয়েকে উদ্ধার করা যাবে। অগত্যা তিনি মেয়েকে উদ্ধারের জন্য পূর্ব থেকে পরিচিত একজন স্থানীয় সাংবাদিকের সহায়তা চান।
এরপর ওই সাংবাদিক যোগাযোগ করেন ফরিদপুরের সাংবাদিকের সাথে। বিষয়টি জানার পর ফরিদপুরের দু’জন সাংবাদিকের সহযোগীতায় জবার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে শনিবার সন্ধায় সর্দারণী জবার পিতা ও অপর এক স্বজনকে সাথে নিয়ে মর্জিনার ডেরায় অভিযানে গিয়ে পাওয়া যায় জবাকে। সেখানে উল্লেখিত সাংবাদিকদের সহায়তায় রথখোলা পতিতাপল্লীর বড় বাড়ির সর্দারনী মর্জিনার খপ্পর থেকে উদ্ধার করা হয় জবাকে।
পতিতা পল্লী থেকে মুক্তির পর জবা এই প্রতিবেদককে জানায়, সর্দারনী মর্জিনার কথায় পঙ্গু ঘরে যাওয়ার ভীতি থেকে সে টিএসআই এর সামনে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তার কথার সত্যতা যাচাইয়ের কোন চেষ্টা করেননি পুলিশ। অভয়ের আশ্বাস কিংবা পতিতাবৃত্তির পরিণতি জানিয়ে তাকে মুক্ত জীবনে ফিরে যেতে কোনপ্রকার উৎসাহ দেয়া হয়নি। জবা জানায়, আখি ও বর্ষা (সর্দারনীর দেয়া ছদ্ম নাম) নামে দুটি মেয়ে সহ আরো তিনজন মেয়ে এখনও সর্দারনী মর্জিনার নিকট বন্দি রয়েছে। যারা মুক্ত জীবনে পরিবারের নিকট ফিরে যেতে প্রতিদিন কান্নাকাটি করতো তার মতো। এছাড়া আরো ৪টি মেয়ে একইভাবে কান্নাকাটি করায় তাদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। ওদের ভাগ্যে কি জুটেছে তা জানেনা জবা। এই প্রতিবেদকের নিকট জবার বিনীত আকুতি ছিল এই যে, বর্ষা ও আখিকে যেনো উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়।
জবার ভাষ্য অনুযায়ী, সর্দারনী মর্জিনার ন্যায় রথখোলা পতিতা পল্লীতে আরো অসংখ্য সর্দারণী রয়েছে যাদের নিকট তার (জবার) মতো শত শত মেয়ে এখনও বন্দি রয়েছে রথখোলা পতিতা পল্লীতে। এইসব মেয়েকেও তার মতো পঙ্গু ঘরে যাওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে বাধ্য হচ্ছে পুলিশের সামনে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে। পুলিশের নিকট বাড়ির ঠিকানা দিতেও নিষেধ করা হয় তাদের। এরপর মোটা অংকের টাকায় পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স নিয়ে প্রতিনিয়ত বাধ্য করা হয় খদ্দেরের মনোরঞ্জনে। অথচ, প্রাপ্ত টাকার সিকি ভাগও তাদের ভাগ্যে জোটেনা। জবা জানায়, পরিবারের নিকট ফিরে আসার সময় সর্দারণী তাকে একটি পয়সাও দেয়নি। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন খদ্দেরের নিকট তাকে যেতে হতো। অথচ সব মিলিয়ে ২/৩ শ’ টাকার বেশি সে পেতো না। খদ্দেরদের নিকট থেকে পাওয়া টাকা সাথে সাথে তুলে দিতে হতো সর্দারণীর হাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ফরিদপুরের রথখোলা পতিতাপল্লী বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ পতিতাপল্লী। এছাড়া শহরের অপর প্রান্তে পদ্মার পাড়ে সিএন্ডবি ঘাটে রয়েছে আরো একটি পতিতাপল্লী। পার্শ্ববর্তী রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ ঘাটেও রয়েছে আরো একটি পতিতাপল্লী। এইসব পতিতা পল্লী ঘিরে গড়ে উঠেছে নারী পাচারকারীদের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে নানা কৌশলে মেয়েদের পাচার করে এসব পতিতাপল্লীতে এনে বিক্রি করা হচ্ছে। সূত্র মতে, রথখোলা পতিতাপল্লীতে লাইসেন্স প্রাপ্ত ৫ শতাধিক নারী দেহ ব্যবসায় জড়িত। যাদের মধ্যে শতাধিক মেয়ে এখনও বন্দিদশা থেকে মুক্তির অপেক্ষার প্রহর গুনছে। এর বাইরে সিএন্ডবি ঘাট পতিতা পল্লী ও গোয়ালন্দ পতিতাপল্লীতেও রয়েছে এমন অগণিত অসহায় মেয়ে। পুলিশকে ৭ হাজার টাকা দিলে এদের পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স মিলে বলে অভিযোগ রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জবাকে পতিতাপল্লীতে পাচারের সময় তার (জবার) নিকট যেই মোবাইল ফোন নাম্বারটি সাথে ছিল সেটি পাচারকারীরা রেখে দেয়। গতকালও সেই মোবাইল নম্বরটি চালু পাওয়া গেছে।
এব্যাপারে ব্লাষ্টের ফরিদপুরের কার্যালয়ের সালিশ কর্মকর্তা অর্চনা দাস জানান, ফরিদপুরের বিভিন্ন পতিতাপল্লী থেকে ব্লাষ্টের মাধ্যমে কয়েকজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাদেরকে জোরপূর্বক অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত করা হয়েছিল। এরপর আদালতের মাধ্যমে কিছু মেয়েকে পরিবারের নিকট এবং কিছু মেয়েকে সেফ হোমে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এসব মেয়েদের উদ্ধার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেন।
ফরিদপুরের পতিতা পল্লীর অসহায় মেয়েদের নিয়ে কাজ করছে শাপলা মহিলা সংস্থা। যোগাযোগ করা হলে শাপলা মহিলা সংস্থার প্রজেক্ট অফিসার প্রশান্ত কুমার সাহা জানান, রথখোলা পতিতা পল্লী থেকে গত ২ বছরে ৪৪ জন মেয়েকে উদ্ধার করে পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন। রোববারও এমন একজনকে উদ্ধার করে পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সঠিক তথ্য পেলে তাঁরা পতিতাল্লীর বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে এসব অসহায় মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়ার সবরকম উদ্যোগ নিয়ে থাকেন।
জবার মতো ভাগ্যক্রমে কারো মুক্তি মিললেও নারী পাচারকারী হোতাদের খুঁজে বের করতে প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ পরীলক্ষিত হয় না। নিরপেক্ষ অভিযান চালালে এইসব স্বজনহারা অসহায় মেয়েরা স্বাভাবিক ও মুক্ত জীবন ফিরে পেতে পারে। একইসাথে চিহ্নিত হতে পারে সংঘবদ্ধ নারী পাচারকারী চক্রের সিন্ডিকেটও।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর পদ হারালেন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রদলেরবিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল গ্রেপ্তার
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে রাজধানীরবিস্তারিত পড়ুন