পুড়ে পিষে শেষ ২৪ প্রাণ
গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে একটি প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল শনিবার ভোরে আগুন লাগে, রাতেও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগুনে টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের কারখানাটির পাঁচতলা ভবনের পুরোটাই পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণ ও আগুনের তোড়ে ভবনটির বেশির ভাগ অংশ ধসে গেছে। দুর্ঘটনার পর গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও চিকিৎসকরা। তাদের মধ্যে কারখানাটির শ্রমিক-কর্মকর্তার পাশাপাশি পথচারী ও রিকশাচালকও আছে। বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে অগ্নিদগ্ধ হয়ে। আগুনে কারখানার কাঠামো ভেঙে পড়ায় তার নিচে চাপা পড়েও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক। উদ্ধারকাজ চলছে, হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
গতকালই কারখানাটিতে শেষ কর্মদিবস ছিল। কাজ শেষে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের। বেতন-বোনাসও পরিশোধ করা হয়েছিল। কর্মীদের মধ্যে ছিল খুশির আমেজ। কিন্তু বিস্ফোরণ আর আগুনে মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৯ জনের লাশ উদ্ধারের পর টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরো পাঁচজন মারা যায়। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গতকাল বিকেলে অন্যদের লাশও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্যে ৩৫ জন গতকাল টঙ্গী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল ও উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। কারখানাটিতে ফয়েল পেপারের পাশাপাশি চানাচুর, বিস্কুট, চিপসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের নানা ধরনের প্যাকেট তৈরি করা হতো। এ ধরনের কারখানার মধ্যে বাংলাদেশে এটিই সবচেয়ে বড়। বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কম্পানির পণ্যের মোড়কও এখানে তৈরি হতো। সেখানে প্রায় সাড়ে চার শ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তিন শিফটে কাজ চলত। ভোরে অগ্নিকাণ্ডের আগে শতাধিক কর্মীর কাজে থাকার কথা ছিল। গতকাল বিকেল পর্যন্ত অন্তত ১০ জন শ্রমিক নিখোঁজ থাকার তথ্য মিলেছে। আগুনের তীব্রতা, ধোঁয়া এবং ভবন ধসে যাওয়ায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছিল। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, আহত শ্রমিক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, কারখানাটির ভেতরে গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পাশে থাকা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বয়লার বিস্ফোরণে ভবনধস ও অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটসহ দেড় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী সারা দিন চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এরই মধ্যে পাশের একটি ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে আশপাশের কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত দেবে যাওয়া ভবনের ভেতরে তল্লাশির পাশাপাশি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা। তাঁরা বলছেন, কারখানটির ভেতরে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য থাকায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে বেশির ভাগ লোকজন সরিয়ে নেওয়ার দাবি করলেও তাঁরা জানিয়েছেন, অল্প কিছু মানুষ ভেতরে আটকে মারা যেতে পারে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, ভবন ও বয়লার—দুটিই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্রতা সহ্য করার মতো সক্ষমতা ছিল না ভবনটির। এ ঘটনার জন্য তাঁরা মালিক ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন। তাঁরা হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করেছেন।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গাজীপুর জেলা প্রশাসন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে।
জানা গেছে, টাম্পাকো কারখানাটি প্রায় ৪০ বছরের পুরনো। এর মালিক সৈয়দ মো. মকবুল হোসেন ওরফে লেচু মিয়া। সিলেট-৬ আসনে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। তবে গতকাল দুর্ঘটনার পর তাঁকে বা তাঁর কোনো প্রতিনিধিকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। যোগাযোগ করলে মোবাইল ফোনে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কর্তৃপক্ষের কোনো অবহেলা ছিল না। নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
ঈদের মাত্র দুই দিন আগে এমন মর্মান্তিক ঘটনায় বিসিক শিল্পনগরীসহ টঙ্গীর আশপাশের এলাকায় শোকের আবহ নেমে এসেছে। জানা গেছে, হতাহতসহ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা সবাই কারখানাসংলগ্ন এলাকায়ই থাকত।
যেভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত : টঙ্গীর আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়াল সড়কের নিচে রেলগেটের পূর্ব পাশ থেকেই বিসিক শিল্প নগরীর শুরু। সেখানে ২ নম্বর প্লটে প্রায় তিন বিঘা জমির ওপর টাম্পাকো প্যাকেজিং কারখানা। মালিক সৈয়দ মকবুল হোসেনের দাবি, ১৯৭৭ সালে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মূলত ফয়েল পেপার এবং চানাচুর, বিস্কুট, চিপস, দুধ, সিগারেটের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের প্যকেট তৈরি করা হতো। সাড়ে চার শর মতো শ্রমিক কাজ করত। কয়েক দিন আগেই বোনাসসহ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। তিন শিফটে কাজ হয় কারখানায়। শুক্রবার রাতের পালায় ৭৫ জনের মতো কাজ করছিল। গতকাল ঈদের ছুটি হওয়ার কথা ছিল।
শ্রমিকরা বলছেন, সকাল ৬টার দিকে দুর্ঘটনা ঘটে। তখন এক শিফট শেষে আরেক শিফট শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ সময় অন্ত দেড় শ শ্রমিক কাজে ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, ভোর ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় ভবনটির পূর্ব পাশের অনেকটা অংশ ছিটকে রাস্তা ও আশপাশের ভবনের ওপর গিয়ে পড়ে।
টঙ্গী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিক কামরুল হাসান বলেন, কারখানাটির চারতলায় তিনি অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। গতকাল সকাল পৌনে ৬টার দিকে কাজ শেষে বের হওয়ার সময় তিনি নিচতলায় ওয়ার্ডরুমের পাশে গ্যাসের রাইজার দিয়ে গ্যাস বের হওয়ার শব্দ পান। তখন সেখানে দাঁড়িয়ে শিফট ইনচার্জ শুভাস চন্দ্র (পরে যাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে) মোবাইল ফোনে কাউকে গ্যাস বের হওয়ার খবর দিচ্ছিলেন। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রথমে সেখানে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। তিনি (কামরুল) তখন জীবন বাঁচাতে দৌড়ে দেন। এর পরই বিকট শব্দে বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়। তিনি (কামরুল) ছিটকে পড়েন।
প্যাকিং শাখার আহত কর্মী মাহবুব বলেন, তিনিও কাজ শেষে বের হচ্ছিলেন। তখন হঠাৎ তীব্র বিস্ফোরণে তিনি ছিটকে পড়েন। এতে তাঁর হাত ভেঙে যায়। অন্য দুই কর্মী দাবি করেন, কারখানার নিচতলায় ১৯টি মেশিন ছিল। গতকাল ভোরে এর মধ্যে আটটি চালু ছিল। গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকেই বিস্ফোরণ ও আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
ঘটনার সময় কারখানার পূর্ব পাশের রাস্তা দিয়ে টেম্পোতে চড়ে যাচ্ছিলেন শহীদুল ইসলামসহ ১০-১২ জন শ্রমিক। শহীদুল জানান, ৬টা বাজার কয়েক মিনিট আগে তাঁদের টেম্পোটি কারখানার পাশে দাঁড়ায়। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দ হয় এবং ভবনটির কিছু অংশ রাস্তার ওপর এসে পড়ে। তখন তাঁদের টেম্পো, একটি রিকশা ও একটি ট্রাকসহ কয়েকজন পথচারী চাপা পড়ে। তিনি নিজেও আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, প্রথমে বিস্ফোরণে ভবনের পূর্ব ও উত্তর পাশের অংশ ধসে পড়ে। ঘটনার পরই গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তিতাস গ্যাসের গাজীপুরের ব্যবস্থাপক (সরবরাহ) আখেরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাসলাইনের সংযোগ থেকে কেমিক্যালের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে—এমন খবর পেয়ে ঘটনার আধাঘণ্টার মধ্যেই তাঁরা সংযোগ বন্ধ করে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, বিস্ফোরণে ভবনের ভাঙা অংশ আশপাশে ছিটকে পড়ায় কয়েকটি ভবনের দরজা-জানালা ও দেয়াল ভেঙে গেছে। কারখানার প্রিন্টিং অপারেটর আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার শিফট শেষে গেটে আসার পরই হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ভয়ে দৌড় দিই। দেখি নিচতলা ও উপরের তলা ভাইঙ্গা পড়তাছে। লোকজন তেমন দেখি না। তবে কয়েকজন তিনতলা ও চারতলা থেইকা বাঁচাও বাঁচাও বলে ডাকছিল। পরে কী হইছে জানি না।’
আরেক প্রিন্টিং অপারেটর রুস্তম আলী বলেন, ‘আমি কাজ করার জন্য ঢুকতেছিলাম। এমন সময় বিকট শব্দে কানে তালা লাইগা যায়। আমার পাশে রিকশা ও ট্রাকের উপর দেয়াল ভাইঙ্গা পড়ছে।’ ফায়ার সার্ভিসের জয়দেবপুরের স্টেশন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান বলেন, খবর পেয়ে সকাল ৬টার দিকে জয়দেবপুর, টঙ্গী, কুর্মিটোলা, সদর দপ্তর, মিরপুর ও উত্তরাসহ আশপাশের ফায়ার স্টেশনের ২৫টি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। কিছু সময়ের মধ্যে আগুন কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে, যা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকজনকে জীবিত অবস্থায় এবং কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক সার্জন পারভেজ হোসেন বলেন, সকালেই আটজনের লাশ পাওয়া যায়। ৩০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২৯ জনকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এলাকাজুড়ে আতঙ্ক : গতকাল স্থানীয়দের বেশির ভাগেরই ঘুম ভেঙেছে বয়লার বিস্ফোরণের বিকট শব্দে। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের পর বিসিক শিল্প নগরীসহ পুরো টঙ্গী এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আগুনের পাশাপাশি কালো ধোঁয়ায় আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। লোকজনের ভিড়ের কারণে ট্রেন চলাচলেও বিঘ্ন ঘটে। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, কারখানাটির অনেকটা অংশ হেলে পড়েছে পাশের টিনশেড ভবনের ওপর। একটি বাড়ির মালিক আবুল মাতাব্বর ও তাঁর স্ত্রী শারমিন বলেন, তাঁদের পুরো ভবনই ভেঙে গেছে। সেখানে কয়েকজন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পর আশিক (১২) নামের এক শিশু মারা যায়।
কারখানাটির দক্ষিণ পাশের তিনতলা ভবনের কিছু অংশও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের মালিক গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘ভোরে হঠাৎ বিকট শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে। প্রথমে মনে হয় ভূমিকম্প। পরে দেখি আগুন। এরপর আগুন বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে আমাদের বিল্ডিংয়েও আগুন চলে আসে। পরে এলাকাবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের চেষ্টায় আমাদের ভবনের আগুন নেভানো গেছে।’ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে কারখানার পূর্ব পাশের সোনালী ব্যাংক, জিট অ্যান্ড করপোরেশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সঞ্জীব কুমার রুদ্র বলেন, ‘ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের সব মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
দুপুরে স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘যেভাবে ঘণ্টার পর আগুন জ্বলছে, বুঝতে পারছি না কী হবে? তাই বাসার সবাইকে আত্মীয়ের ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। মালামালও কিছু সরিয়েছি।’ প্রত্যক্ষদর্শী টঙ্গী রেলস্টেশনের কর্মী লিখন বলেন, বিস্ফোরণের পর পাঁচতলা কারখানার চতুর্থ তলায় বেশ কিছু শ্রমিক জানালা দিয়ে হাত নেড়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল। এ সময় স্থানীয়রা মই নিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। পরে ধোঁয়া বেড়ে যাওয়ায় ওই শ্রমিকদের আর দেখা যায়নি।
আগুন নেভাতে হিমশিম : বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া ও আগুনের মাত্রা বাড়তে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ভেতরে পৌঁছতে পারছিলেন না। দুপুর ১২টার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এতে আগুন নেভার বদলে ধোঁয়ার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তবে দুপুর ২টার পর থেকে আগুনের মাত্রা কমতে থাকে। কিন্তু বিকেলে দক্ষিণ পাশের চারতলা ভবনের অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় ওই ভবনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল।
বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মোশারফ হুসেইন বলেন, ‘২৮টি ইউনিট সারা দিন কাজ করেছে। দেড় শর বেশি ভলান্টিয়ারও ছিল। আমরা বাইরে থেকেই চেষ্টা করে চলেছি। ভবনের মধ্যে কেমিক্যাল থাকায় সেখানে ঢুকে কাজ করা যাচ্ছিল না। আমরা আগুন নেভানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
রাত ৯টায় ফের ব্রিফিং করেন মোশারফ হুসেইন। তখন তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পর ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজউক ও বুয়েটের প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমরা যেন অত্যন্ত সাবধানে উদ্ধারকাজ চালাই। মই নিয়ে ভেতরে উদ্ধারকাজ চালানো ঠিক হবে না। এ মুহূর্তে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও নেভানো যায়নি। আমরা আগুন কারখানার ভেতরে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি, যাতে আর না ছড়াতে পারে।’ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, ভবনটির ভেতরে কেমিক্যাল থাকায় এবং এটি দেবে যাওয়ায় ভেতরে ঠিকমতো পানি দেওয়া যাচ্ছে না। আর একপাশের আগুন নেভালে আরেক পাশ থেকে জ্বলে উঠছে।
গতকাল শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার কারখানার প্রধান পরিদর্শক শাফায়ত আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত। দুটি বয়লার এখনো অক্ষত আছে। এর বেশি বয়লার ছিল কি না, কী ধরনের বয়লার ব্যবহারের অনুমোদন ছিল এবং কী ধরনের ব্যবহার করা হচ্ছিল তা তদন্ত করে দেখা হবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক কারখানায় দুর্বলতা থাকতে পারে। এখানকার কর্মপরিবেশ কেমন ছিল তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে।
গতকাল খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল উদ্দিন আহমদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
নিহত ও আহতদের পরিচয় : গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। কিছু লাশ দগ্ধ হয়ে বিকৃত হয়ে গেছে। ঢাকা মেডিক্যালে ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত করা হবে। এরপর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। টঙ্গী হাসপাতালে ১৯ জনের লাশ পাওয়া গেছে। আর পাঁচজন ঢাকা মেডিক্যালে মারা গেছে। এ হিসাবে ২৪ জন নিহত হয়েছে বলে তথ্য আছে। হাসপাতাল ও প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী নিহতদের মধ্যে কয়েজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কারখানার শিফট ইনচার্জ শুভাস চন্দ্র দাস (৪০), তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের হোগহলায়। দারোয়ান হান্নানের (৬৫) বাড়ি চাঁদপুরের মতলবের রুহিতার পাড়ায়। অপারেটর রফিকুল ইসলামের (৩০) বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। কারখানার অপারেটর রেদোয়ান ইসলামের (৩৩) বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জের কানিসাইল গ্রামে। অপারেটরের সহকারী জয়নুলের (৩০) বাড়িও ওই এলাকায়। অপারেটর আল মামুন দুলালের (৪০) বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মাছুয়া গ্রামে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী শংকর সরকারের (৩০) বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের চরখানেপুরে। নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলমের (২৫) বাড়ি ভোলার দৌলতখানের দিদারুল্লাহ গ্রামে। রিকশাচালক রাশেদের (২৮) বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের জামাইবাজারে। কারখানার প্রকৌশলী আনিসুর রহমানের (৪০) বাড়ি গাইবান্ধার তুলসীঘাটে। শ্রমিক সোলায়মানের (৩০) বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে। ওয়াহীদুজ্জামান (৪০) নামের আরেক অপারেটরও নিহত হয়েছেন, তাৎক্ষণিক তাঁর বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া রাশেদের রিকশার যাত্রী মর্জিনা খাতুন (২০) ও তাঁর বোন তাহমিনা খাতুনও (১৮) নিহত হয়েছেন। তাঁদের বাড়ি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। কারখানার অপারেটর ওয়াসী হোসেনের (২৫) বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে এবং গোপাল দাশের (২৫) বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। অপারেটরের সহকারী ইদ্রিস আলীর (৪০) বাড়ি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী। অপারেটর এনামুল হক (৩০), হাসান সিদ্দিকী (২০) ও সাইদুুর রহমানের (৪০) বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে। নিহত অপারেটর দেলোয়ার হোসেন (৩৫), আনোয়ার হোসেন (২৫) ও মামুনের (৩০) বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ রাত সাড়ে ১২টায় ওই কারখানার ভেতরে থেকে থেকে আগুন জ্বলছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, ভেতরে ঢুকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। সকালে পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

ব্যাংকক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদবিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকবির ম্যুরাল থেকে কালি মুছে দিল উপজেলা প্রশাসন
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যুরালে কালি দিয়ে মুখবিস্তারিত পড়ুন

ফখরুল: ইউনূস–মোদির বৈঠক আশার আলো দেখাচ্ছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন