প্রভাবশালীদের স্বজনরা বেপরোয়া কেন?
কুমার রায়ের হ য ব র ল মনে আছে? সেখানে ছিল এক গেছো দাদা। তিনি আছেন কিন্তু তার সাথে দেখা করা ভারী শক্ত। চলুন দেখি কেন শক্ত। কিভাবে দেখা করতে হবে তা সুকুমারের গল্পে আছে। বেড়াল বলল, “মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তার সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।”
আমি বললাম, “তা হলে তোমরা কী করে দেখা কর?”
বেড়াল বলল, “সে অনেক হাঙ্গামা। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তারপর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে।”
আমাদেরও সেই গেছোদাদাকে না পাওয়ার দশা। কোনও অপরাধ, দুর্ঘটনা যদি এমন কেউ ঘটায় যার লতায় পাতায় বা সরাসরি আত্মীয় কোনও সংসদ সদস্য তাহলেই জনগণ পায় ভয়, পুলিশ হয় নিজে থেকে বাড়তি সতর্ক। কিন্তু আসলে কি গেছোদাদার দেখা তারা পায় সবসময়? নাকি সুকুমারের মতোই কেবল আছে, কিন্তু কোথায় আছে তার হিসেব মেলানো যায় না।
খবরের কাগজ উল্টিয়ে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেলো। একটা লম্বা রাস্তা। সারি সারি গাছ পরিকল্পিতভাবে কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের চিত্র এটি। অভিযোগ তোলা হয়েছে গাছ কাটা হচ্ছে রেবেকা মানকিনের তত্ত্বাবধানে, যিনি কিনা ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনের এমপি প্রমোদ মানকিনের আত্মীয় হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।
আসলেই তিনি এমপির আত্মীয় কিনা বা তার গাছ কাটা নিয়ে কেউ কোনও প্রতিবাদ কেন করছে না এসব জানতে স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ শুরুর পর জানতে পারি ঘটনা এখনকার না। গত তিন-চার মাস আগে থেকেই এ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। স্থানীয় জনগণ গাছ কাটার কারণ জানতে চেয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে আতঙ্কিত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাংবাদিকরা কেউ কেউ জানতে চেয়েছিল নিয়ম মেনে গাছগুলো কাটা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। উনি এমপির আত্মীয় পরিচয় দিয়েই এলাকায় চলাফেরা করেন বলে তাকে কেউ কিছু বলে না।
তার মানে এখানে এমপির কোনও প্রবেশ নেই। পরিচয় দেওয়া এবং পরিচয়টা ধর্তব্যে নেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর আসি এ মাসের আলোচিত আরেক ঘটনায়। রাজধানীর গুলশানে ধনাঢ্য পরিবারের কিশোর কার রেসিংয়ে মেতে উঠেছিল। এ সময় ব্যবসায়ী এইচবিএম জাহিদুর রহমানের ছেলে ফারিজ রহমানের বেপরোয়া গাড়িচাপায় চারজন গুরুতর আহত হন। খবরটি পত্রিকার পাতায় আসতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ ঘণ্টার কাছাকাছি। প্রথম দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চারজন নিহতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পুলিশ জানায় ঘটনায় একজন শিশু নিহত হয়েছে। যদিও ঠিক তারপরের দিন পুলিশ স্পষ্ট করে বলেন, সেইদিন গুলশানে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ফারিজের ঘটনায় কেউ মারা যায়নি।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক বিষয় এখানেও ফারিজের চাচা সাবেক এমপি এইচবিএম ইকবালের নামই এলো বারবার। আর এই নাম আসার কারণে পুলিশ হয়ে উঠলো আরও সতর্ক, সার্জেন্টদের হাতে থাকা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে গাড়ির নম্বর দিয়ে মালিকের নাম পাওয়া গেল না।
পুলিশ বলল, ভুক্তভোগী ও এমপির স্বজনদের মধ্যে আপস হয়ে যাওয়ায় কোনও মামলা হয়নি। বিষয়টি গড়ালো হাইকোর্ট পর্যন্ত। আদালত ১৪ দিনের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ১৪ দিন পার হতে আর আছে আর এক সপ্তাহ।
যদি এইচবিএম ইকবালের নাম না জড়ানো হতো তাহলে কি অন্যকিছু ঘটতো? হয়তো ঘটতো কিংবা ঘটতো না। আমরা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে একটা বিষয় ভাল মতো শেকড় গেড়ে দিতে পেরেছি যে, প্রভাবশালীরা, ক্ষমতাধররা যেকোনও অপরাধ লুকানোর ক্ষমতা রাখেন এবং তারা তা নিয়তই করে থাকেন। আর এই ভেবে নেওয়াটাকে পুরো সিস্টেম একটা রূপ দিয়ে থাকে। সবক্ষেত্রেই যে একই ঘটনা ঘটবে তা না-ও হতে পারে। সেই ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকু জিইয়ে রাখা দরকার। আর অপরাধের পর মামলা করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে আসা এবং তারপরও সপ্তাহ কাটিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা কোনও একসময় ঘটবে না সেই প্রত্যাশাটুকু না থাকলে আগামীতে মানুষ অনিরাপদ বোধ করবে। যেকোনও কথা বলার আগে, প্রতিবাদ করার আগে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরাধীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাববে, তার কত ক্ষমতা আর সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কী ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। ফলে অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর ক্ষীণতর হবে।
আইনজীবীরা বলছেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাহলে এমপি স্বজন পরিচয় পাওয়া গেলে সেখানে এই নিজে থেকে সতর্ক হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো কেন ঘটে? এমপিরা প্রভাব খাটান? না, সবক্ষেত্রে না। এসব ক্ষেত্রে একধরনের সেল্ফসেন্সরশিপ কাজ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনও কখনও নিজেরাই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন বলেই অভিযোগ আছে।
অপরাধকে কেবল অপরাধ হিসেবে দেখে আর দশজনের জন্য যে নিয়ম মানা হয় সেই নিয়ম মেনে একবার দেখা যেতে পারে আসলেই এমপি-আত্মীয় বিষয়টা জুজু, নাকি সংসদ সদস্যরা লতায় পাতায় আত্মীয়দের বিষয়ে আসলেই মাথা ঘামান এবং অপরাধ লুকানোর পরামর্শ দেন।
বাংলা ট্রিবিউন
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর পদ হারালেন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রদলেরবিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল গ্রেপ্তার
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে রাজধানীরবিস্তারিত পড়ুন