প্রাইমারি স্কুলের জমি গুলো এখন প্রভাবশালীদের কব্জায়!
রাজধানীর আরমানিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮ দশমিক ২ শতাংশ জমি রয়েছে। এর মধ্য থেকে ৫ শতাংশ জমি বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জেবুননেছা বেগম নিজের নামে নামজারি করে নিয়েছেন। সেখানে তিনি আলিশান পাঁচতলা বাড়ি তুলেছেন। তার কাছ থেকে কিছুতেই বিদ্যালয়ের জমি উদ্ধার করতে পারছে না প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অবশেষে জেলা প্রশাসকের কাছে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এ ছাড়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবরেও নামজারি খারিজের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে জেবুননেছা বেগমকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। একই তথ্য সমকালকে জানালেন ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) শাহীন আরা বেগম।
মিরপুরের তুরাগ নদের তীরে গুদারাঘাটে অবস্থিত কাজী ফরিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নথিপত্রে এই বিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ১৮৫ শতাংশ। বাস্তবে মাত্র ১৬ শতাংশ জমি স্কুলের দখলে। অবশিষ্ট ১৬৯ শতাংশ জুড়ে বস্তি। সরকার দলীয় স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী এই বস্তি থেকে মাসে মাসে ভাড়া তুলছেন।
এভাবেই নানা উপায়ে দখল হয়ে গেছে রাজধানীর মোট ৫৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূল্যবান জমি। প্রভাবশালীদের চাপে তটস্থ থাকেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো মামলা-মোকদ্দমার শিকার হতে হয় তাদের। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি বিদ্যালয়ের জমিতে গড়ে উঠেছে বস্তি, হাইস্কুল, কলেজ, ওয়াসার পানির পাম্প, সিটি করপোরেশনের কার্যালয়, প্রতিবেশী কারও কারও চলাচলের রাস্তা। রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯৫।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে বস্তি গড়ে উঠেছে মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। ৩৬ শতাংশ জমির মধ্যে বস্তিবাসীর সঙ্গে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে বিদ্যালয়ের। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মূল্যবান এসব জমি উদ্ধারের কৌশল হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) নির্মাণ শুরু করেছে। ধানমণ্ডি ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ চলছে ধানমণ্ডি ল’ কলেজ কর্তৃপক্ষের। অবশ্য সম্প্রতি এই কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দখলে নেওয়া দুটি কক্ষের একটি উদ্ধারে সক্ষম হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
কোতোয়ালি থানা এলাকার হাজী মাজহারুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দখল করে বসানো হয়েছিল আনসার ক্যাম্প। সম্প্রতি আনসার ও ভিডিপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ দেনদরবার করে ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বহু চিঠি চালাচালি ও প্রচেষ্টার পর উত্তর বাইশটেকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সরানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। বেদখল হওয়া স্কুলের জমি উদ্ধার হয়েছে দক্ষিণখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও।
সূত্রাপুরের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিশু রক্ষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিও আংশিক দখলমুক্ত করা হয়েছে। শিশু রক্ষা বিদ্যালয়ের আংশিক জমি এখনও স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটির দখলে রয়েছে। এ ছাড়া এ স্কুলের ভবনটিও খুবই জরাজীর্ণ। তাই স্কুল ভবন ভেঙে পুরো জমিতে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সুপারিশ করেছে ভূমি উদ্ধারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি।
রাজধানীর বেইলি রোডের সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমি নিয়ে আদালতে মামলায় লড়ছে গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গত বছর অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ এই বিদ্যালয়টির ভবন ভেঙে দিলে শিশুরা রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে পাঠগ্রহণ করলে বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মামলার কারণে এক বছরেও সেই সমস্যার সুরাহা হয়নি। এখনও রাজধানীর বেইলি রোডের ওই স্কুলের শিশুরা মাটিতে বসেই খোলা আকাশের নিচে পাঠগ্রহণ করছে।
পুরান ঢাকার সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক হাজার ৮০ বর্গফুট জমিতে বসেছে ওয়াসার পাম্প। এই বিদ্যালয়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ তলায় রমনা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ছাড়া মিরপুরের শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডেমরার মাতুয়াইল ২ নম্বর, গুলশানের মেরাদিয়া, মতিঝিলের আইডিয়াল মুসলিম বালক/বালিকা ও মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমিতে রয়েছে ওয়াসার পাম্প। এসব জমি উদ্ধারেও ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চলছে চিঠি চালাচালি।
জমি বেদখল হয়ে আছে কোতোয়ালি থানা এলাকার এস কে এন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছোট কাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও। এই দুটি বিদ্যালয়েও দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণের সুপারিশ করেছে ভূমি উদ্ধারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি। শহীদ নবী সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশ জমি রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
ধানমরি পাম্প। এই বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণীতে পরিচালিত হয় ধানম ি ল’ কলেজের কার্যক্রম। সম্প্রতি একটি কক্ষ দখলে নিয়েছে বিদ্যালয়টি। বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি অংশে বসবাস করছেন ওই ভূমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা। তবে এতে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন কোতোয়ালি থানার শিক্ষা কর্মকর্তা।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আরা বেগম বলেন, জমি নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমার কারণেও তারা পেরে উঠছেন না।
আরও যত দখল: ধানম ি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৬ শতাংশ জমির মধ্যে ৩০ শতাংশ দখল করে বসানো হয়েছে ওয়াসার পাম্প। এই বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণীতে পরিচালিত হয় ধানম ি ল’ কলেজের কার্যক্রম। সম্প্রতি একটি কক্ষ দখলে নিয়েছে বিদ্যালয়টি। মিরপুরের আ. মান্নান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ জমির মধ্যে ২০ শতাংশ এবং মোহাম্মদপুর থানার কামরাঙ্গীচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৬ শতাংশ জমির মধ্যে ৩০ শতাংশ অবাঙালিদের দখলে রয়েছে।
মিরপুরের খলিলুর রহমান ও শেরেবাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি। রমনা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো না থাকায় সেখানে গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজার। দক্ষিণখান বিদ্যালয়ের জমিতে তৈরি হয়েছে ঈদগাহ মাঠ, আগারগাঁও তালতলা বিদ্যালয়ের জমিতে হয়েছে মসজিদ। খিলগাঁও মডেল বিদ্যালয়ের জমি দখল করে গ্যারেজ করা হয়েছে। এফ কে এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও চতুর্থ তলায় বংশাল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলে।
গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ জমির মধ্যে ২৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ জমি দখলে রেখেছে ‘খেলাঘর’। এ বিদ্যালয়ের সামনের তিনটি দোকান গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির দখলে। সূত্রাপুরের এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ জমির মধ্যে পাঁচ শতাংশ জমি দখল করে সেখানে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
মাতুয়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২১ শতাংশ জমির মধ্যে ১৫ শতাংশ জমি মূল ভবনসহ দখল করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ভূমি দখলমুক্ত করা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়।
সরকারি বিদ্যালয় পেয়ে সেখানে ওয়াসা পাম্প বসিয়েছে, সিটি করপোরেশন কার্যালয় বানিয়েছে। কেউ কেউ হাইস্কুল, কলেজ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের জমিতে গড়ে তুলেছে। এটি খুবই বাস্তব একটি সমস্যা। তিনি বলেন, কেবল এই ৫৪টি নয়, মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা শহরের সব বিদ্যালয়ের জমিসহ প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন করা হবে। এরপর করণীয় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

জেনেভা ক্যাম্পে মাছ ব্যবসায়ীকে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে আবারও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মাদক ব্যবসারবিস্তারিত পড়ুন

তারেক রহমান: আগে ভারতীয় শিল্পী আসতো, এখন পাকিস্তান থেকে আসে
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেশি শিল্পীদের উপেক্ষা করে ভারত ও পাকিস্তানবিস্তারিত পড়ুন

নির্বাচন নিয়ে সরকারের এত গড়িমসি কেন, প্রশ্ন রিজভীর
“নির্বাচন নিয়ে সরকারের এত গড়িমসি কেন”, এমন প্রশ্ন তুলে বিএনপিরবিস্তারিত পড়ুন