ফেসবুক বৌদি!
আদতে ব্যাপারটা নেহাতই নিরীহ। ফেসবুক পেজ খুলে অতি সরল মস্তিষ্কে একবার কেবল সার্চ-এর জায়গায় গিয়ে ‘বৌদি’ শব্দটা ইংরেজি লিপিতে লিখে এন্টার দাবান। আপনার কাজ শেষ। আর খেলা আরম্ভ। ফেসবুকে লিখিত এই নিরীহ সম্বোধন আপনাকে নিয়ে যেতে চাইবে এমন সব পরিসরে, যেখানে দিনের বেলাতেও গা ছম ছম। বাঙালির এই একান্ত আপনার ডাকটিকে ঘিরে সেখানে নেমেছে ভৌতিকতার ঢল। না। এ ভূত মোটেই রামসে ব্রাদার্স অথবা রামগপাল বর্মার হরর সন্দর্ভ নয়। এই ভূত আমাদেরই ঘাড়ে চড়ে থাকা মর্যাল-ইমমর্যাল টাইটরোপ-পায়চারির নিজস্ব প্রেত। ফেসবুকে ‘বৌদি’ কোনও ডাক বা সম্বোধনমাত্র নয়। এ নিষিদ্ধ এক জগতের হাতছানি।
ফেক কি না জানা নেই, ফেসবুক এবং টুইটারের মতো খুল্লমখুল্লা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে একবার ‘বৌদি’ টাইপ করলেই খুলে যেতে থাকে অজস্র প্রোফাইল। স্বল্পবসনা আধা-সুন্দরী বাঙালি গৃহবধূদের হাতছানি-মার্কা ছবিছক্কা-সহ সে এক দেদার ব্যাপার। শুধু ছবিই নয়, তার উপরে-নীচে কমেন্ট, তার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট নম্বর। এরা কারা? কেনই বা এমন ধারা অতল জলের আহ্বান-মার্কা খিল্লি— এ নিয়ে ভাবতে বসে থই মেলে না। এ কি কোনও মধুচক্রের বিজ্ঞাপন? না কি, বাঙালির অন্তঃপুরে জমে থাকা কয়েকশো বছরের লিবিডোর উদ্দাম বিস্ফোরণ?
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক হিসেবে ফেসবুক সারা বিশ্বে ঠিক কতটা জনপ্রিয়, সে হিসেব নেওয়ার দরকার নেই এ প্রতিবেদনে। কেবল এটুকু মাথায় রাখলেই চলবে, এই নেটওয়ার্কিং সাইট বাঙালিকে (উভয় বঙ্গের) এক প্রকার যা খুশি করার ছাড়পত্র অকথিতভাবে প্রদান করে বসে আছ, সে কথাটা না মেনে উপায় নেই। গত চার-পাঁচ বছরে ফেসবুক একই সঙ্গে বাঙালির সেফ ডিপোজিট ভল্ট এবং ডাস্টবিন।
এখানে যেমন কিছু ডেলে রাখলে হারানোর ভয় নেই, তেমনই ফেসবুকের মারফতই লক্ষ-কোটি বাংলাভাষী তাঁদের গভীর ও অগভীর— উভয় কিসিমের বাসনাই এখানে গচ্ছিত রাখছেন। এই বাসনা ভাঁড়ারে ঝাঁক মারলে দেখা যাবে কী নেই এই সাইবার-কুঠুরিতে! কবিতা লেখার আনখা প্রয়াস থেকে শুরু করে ফোটোগ্রাফির অলজ্জ কেরদানি, রোমান্টিক খুচুর-মুচুর থেকে হার্ডকোর ইন্টু-বিন্টু—যে কোনও সময়ে ফেসবুক ভ্রমণ করলেই পাওয়া যায়। এ সবের ফাঁকে বাণিজ্যও বেশ ফুরফুরে ভাবে প্রসরমান।
নতু্ন বই বেরনো থেকে শুরু করে বিডস-এর গয়নার বুটিক— কী যে লভ্য নয় এই পরিসরে, অনুমান করে কঠিন। এই কাঠিন্যকে মান্যতা দিয়ে এমন কিছু পেজ-এর অস্তিত্ব এখানে বিদ্যমান, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তার হকিকত সম্পর্কে মৃত-নিশ্চিত হওয়াটা অসম্ভব। ‘বৌদি’-র মতো একটা আপাত-নিরীহ শব্দকে ঘিরে পেজ-এর ছয়লাপ-দশার কারণ বার করাটা কেবল মুশকিলই নয়, না-মুমকিনও বটে। মনে হতেই পারে, এই সব পেজ মধুচক্র অথবা এসকর্ট-র্ভিসের বিজ্ঞাপন। পরক্ষণেই আবার মনে হতে পারে, এই সব পেজ আরও গহেরা কিছু, যার থই পাওয়া সত্যিই দুরূহ।
এ সব অশৈলের কার্য-কারণ খুঁজে পেতে হলে ডুব দিতে হয় বাংলা-সংস্কৃতির গহীনে। বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে ‘বৌদি’ এমনই একটা সম্বোধন, যার সঙ্গে একটা ইরোটিক মাত্রা যুক্ত হয়ে রয়েছে বাই ডিফল্ট। ১৯৬০-দশকের পর্ন-সাহিত্যের সুবর্ণযুগে এই সম্বোধনই ছিল বঙ্গজনের উজ্জীবনের মহামন্ত্র। এ থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, বাঙালির ইরোটিক ইম্যাজিনেশনের ভাঁড়ারটা আর যাই হোক, খুব একটা বৈচিত্র্যময় বা অ্যাডভেঞ্চারাস নয়। নেহাৎই পারিবারিক চৌহদ্দির মধ্যে তাকে মাথা কুটে যেতে হয়েছে চিরটা কাল। সে দিন থেকে আজ, এই গ্লোবাল আঙিনায় নাচতে নেমেও তার ঘোমটা সমেত বৌদির বাইরে ফ্যান্টাসি প্রসারিত হয়নি। এ কি কোনও মনোরোগ? সামাজিক এবং সামূহিক ব্যাধি? ডাক-খোঁজ করতে যেতেই হল মনোবিদের কাছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের গবেষিকা অমৃতা পাণ্ডা জানালেন, বিষয়টাকে দুটো অবস্থানবিন্দু থেকে দেখা দরকার। এক, যাঁরা এ ধরনের প্রোফাইল খুলছেন। আর দুই, যাঁরা এ ধরনের প্রোফাইল সার্চ করছেন। তাঁর মতে, ‘‘ফেসবুক ছোট এফর্টে অনেকের কাছে পৌঁছনোর একটা সহজ উপায়। পরিসংখ্যান থেকে দেখা গিয়েছে, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মাঝবয়সিদের প্রোফাইল বেশি থাকে। এটা একটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার। আমাদের সমাজে সোশ্যাল ট্যাবুর পরিমাণ এমনিতেই মারাত্মক বাশি। এই ট্যাবুর কারণে সেক্সুয়াল পরিসরগুলোকে আমরা এক্সপ্লোর করার কথা ভাবিই না।’’
মাঝবয়সে এই ট্যাবু-জনিত অবদমন একটা বিস্ফার দাবি করে। সিঙ্গল বা কনজুগ্যাল— উভয়ের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। অন্যভাবে দেখলে, এটা একটা জেনুইন সেক্সুয়াল নিড। কারোর কারোর ক্ষেত্রে আবার এটা নিছকই মজা। তবে এই সব প্রোফাইলের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ প্রোফাইলই নকল। যাঁরা নিজস্ব প্রোফাইলে এ সব করছেন, তাঁরা প্রকৃতই ডেসপারেট। অনেক সময়েই যে ফোন নম্বর এই সব প্রোফাইলে দেওয়া থাকে, সেগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব থাকাটা আশ্চর্যের।
এর উলটো বিন্দুতে রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা এ ধরনের প্রোফাইল ভিজিট বা সার্চ করেন। সামাজিক ভাবে সফল অনেক মানুষই এই তালিকায় রয়েছেন। এবার এই সার্চ-করিয়েদের মধ্যে সাধারণ মানুষও রয়েছেন। মনোবিদের মতে, ‘‘এটা একদিক থেকে দেখলে সোশ্যাল থ্রেট তো বটেই। যদি আমরা সেক্সুয়ালিটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারতাম, তা হলে মোটেই এমনটা হত না।’’
পর্ন-সাইট নয়, অথচ এর কনটেন্ট সর্বজনসমক্ষে দেখার উপায় নেই— এই বিন্দু থেকে দেখলে, এই ‘বৌদি’-চাপল্য থেকে মুক্তির উপায় কী? উত্তরে ড. পাণ্ডা জানালেন, ‘‘আমাদের কোনও ওয়েল-ডিফাইন্ড সাইবার ল নেই। যতটুকু রয়েছে, তার আবার প্রয়োগের জায়গাটা খুবই অপ্রশস্ত। আমরাও জানি না, ঠিক কী ভাবে এগুলোকে ডিল করতে হবে।’’ তাঁর ধারণা অনুয়ায়ী এটা এক ধরনের ‘ভারচুয়াল মাস্কারেড’। যেখানে আসল পরিচয় গোপন রাখাটাই খেলার মূল শর্ত। এই মুখোশের ব্যাপারটা প্রকৃত মুখোশের চাইতে একেবারেই আলাদা। এক্ষেত্রে আত্মপরিচয় গোপন করার বদলে ফুটে ওঠে আমাদেরই ভিতরের চেহারা। অবয়বহীনতাই জন্ম দেয় বাসনা-প্রবাহের। ফলে মানসিকতার বিকাশ ব্যাহত হয়।
তা হলে কি সাইবার এজ আর ভারচুয়াল বন্ধুত্ব আমাদের একটা রিভার্স-যাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা “হযবরল”-র উদো-বুদোর মতো বয়সের বিপরীত জার্নিতাই সময় কাটিয়ে চলেছি? “হযবরল”-র প্রসঙ্গ আবার এসে পড়ায় মনে হল, কাক্কেশ্বর তো ঘাড়ের কাছে বসেই রয়েছে। ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দেখলাম, ঘুরছে না। চোখের সামনে খোলা এলসিডি স্ক্রিন ফেভিকলের জোড় হয়ে আটকে গিয়েছে। ঘাড় বরাবর একটা কটর কটর আওয়াজ খালি জেগে রইল। বাকিটা লা-পতা!
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সমুদ্র পাড়ে দুর্গারূপে নওশাবা
শুধু ঈদ কিংবা পূজা নয়, বিশেষ ধর্মীয় দিন উপলক্ষে ফটোশুটেবিস্তারিত পড়ুন
শুল্কমুক্ত গাড়ি খালাস করেছেন সাকিব-ফেরদৌস, পারেননি সুমনসহ অনেকে
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য আমদানি করাবিস্তারিত পড়ুন
আলোচিত নায়িকা পরীমনির পরিবার সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানতেন?
গভীর রাতে সাভারের বোট ক্লাবে গিয়ে যৌন হেনস্তা ও মারধরেরবিস্তারিত পড়ুন