বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের ফেডারেল কোর্ট। সোমবার তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল করে আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমানে কানাডায় অবৈধ ভাবে বসবাস করছেন নূর চৌধুরী। সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনও মূহুর্তে তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গিয়েছে, কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই নূর চৌধুরীকে দেশে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্র জানান, কানাডায় আইনী লড়াইয়ে নূর চৌধুরী হেরে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ফলপ্রসূ আলোচনার পর বাংলাদেশের অনুরোধ রেখেছে বন্ধুপ্রতীম দেশটি। এ বার তাঁকে দেশে ফেরত আনার পালা।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের রাতে এই নূর চৌধুরীই গুলি করেছিলেন জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে কামালের বন্ধু ছিলেন মেজর নূর। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির শেষ ধাপে আসতে না আসতেই গর্জে ওঠে নূর-বজলুল হুদার রাইফেল।
সে দিন ভোরের আজানের আগেই গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধুর। যা তিনি কখনও কল্পনাও করেননি। গোলাগুলির শব্দে দোতলা বাড়ির উপরতলা থেকে ঘুমঘুম চোখে নীচে নেমে আসেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। মুহূর্তেই স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান তিনি। এর পর এলোপাথারি গুলি চলে কিছু ক্ষণ। দোতলা থেকে নেমে আসার সময়ে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে কুলাঙ্গারের দল।
সেই কালো রাতে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খুনিরা মেতে উঠেছিল হত্যার উল্লাসে। বঙ্গবন্ধু, তার স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধু, ভাই, ভাগ্নে, ভাগ্নের স্ত্রী, কাজের লোক-সহ ২১ জনকে হত্যা করা হয় সেই রাতে।
পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে শেখ রাসেলের বয়স ছিল নয়। বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে তাকে আগেই বন্দি করে খুনিরা। উপরে গুলির শব্দ শুনে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আকুতি করে ছোট্ট অবুঝ ছেলেটি। কিন্তু তাকেও ছাড়েনি খুনিরা।
সেই দিন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহেনা ছিলেন বিদেশে। আর সে কারণেই বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা।
১৯৯৬ সালের জুনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মুহূর্তেই খুনী নূর চৌধুরী সপরিবারে কানাডায় পালিয়ে যান। কানাডায় গিয়ে ফেড়ারেল কোর্টে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে নূর চৌধুরী নিজেকে চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। আবেদনে বঙ্গবন্ধু সরকারের কুৎসা আর জিয়াউর রহমানের প্রতি নিজের সমর্থন ও যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধী কানাডা সরকারও তখন তাঁকে শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
এর পর থেকে নানা ভাবেই বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিপক্ষে থাকায় নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়নি কানাডা। তবে হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। নানা ভাবে কানাডাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এই রায় কার্যকরের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার মন্ট্রিলের হায়াত রিজেন্সি হোটেলে কানাডা সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দু’দেশ নূর চৌধুরীর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছয়। বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মোহম্মদ শহীদুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসবেন এবং এর উপায় খুঁজে বের করবেন।”
তিনি আরও বলেন, “এই আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা।”
এরপর গত সোমবার কানাডার নিম্ন আদালত বাংলাদেশে নূর চৌধুরীর অপকর্মের কথা উল্লেখ করে তাঁর আশ্রয় আবেদনটি বাতিল করে দেয়। এর পর খুনী নূর চৌধুরী উচ্চ আদালতে আপিল করেন।
উচ্চ আদালতের বিচারপতি জেমস রাসেল তার আপিল বাতিল করে কানাডা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “দেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি ও বিচার হয়েছে। আসামি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও নূর চৌধুরীর পক্ষে আইনজীবী যথেষ্ট আইনী লড়াইয়ের সুযোগ পেয়েছেন। ফলে দেশে সুবিচার মিলবে না, নূর চৌধুরীর এমন দাবি সঠিক নয়।”
ফেডারেল আদালত আরও বলেছে, ১৫ অগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার মুহূর্তেই সেনা চেকপোস্ট পেরিয়ে নূর চৌধুরীর অবারিত যাতায়াত সন্দেহ বলে মনে করা হয়। বিচারপতি নূর চৌধুরীকে কানাডায় থাকার অযোগ্য উল্লেখ করে বলেন, ওই রাতে নিরীহ জনগণ, নারী-শিশুর ওপর যে পরিকল্পিত সুসংগটিত হামলা হয়েছে সে ষড়যন্ত্রে নূর চৌধুরীর যুক্ত থাকার সম্ভাবনা সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
১৫ অগস্টের কালো রাতে বাঙালি হারিয়েছিল তাদের প্রিয় নেতাকে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নায়ককে। ষড়যন্ত্র, মিথ্যা আর অপপ্রচারে তাঁর আর বাঙালি জাতির সব অর্জনকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে গত ৩৪ বছর ধরে। কিন্তু দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে সর্বোচ্চ আদালতের রায় শেষ পর্যন্ত সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যে বাংলাদেশে আইন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রেহাই দেওয়া হয়েছিল, যে দেশ এক সময় সেই ঘাতকদের বিদেশের দুতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছিল। সেই বাংলাদেশ আজ অন্য এক ইতিহাস রচনা করছে। এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এ দেশে জাতির জনকের ঘাতকদের বিচার শেষে রায় কার্যকর হয়েছে, এখন পলাতকদেরও ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এ যেন সত্য আর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার এক নতুন ইতিহাস তৈরির অনন্য কাল।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
যে কারনে যুক্তরাজ্য বিএনপির সম্মেলন স্থগিত
বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশক্রমে মাত্র এক সপ্তাহের নোটিশে যুক্তরাজ্য বিএনপিরবিস্তারিত পড়ুন
ইউরোপ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে বাড়ছে চাপ !
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের ফিরিয়েবিস্তারিত পড়ুন
বাংলাদেশ থেকে তিন হাজার শ্রমিক নেবে সৌদি আরব
চলতি বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পেশার প্রায় ৩ হাজারবিস্তারিত পড়ুন