“বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবন বৈচিত্র”
সুপ্রিয় চাকমা শুভ, রাঙ্গামাটি।
বাংলাদেশের সমগ্র ভূখন্ড জুড়ে বিভিন্ন স্থানে জুড়ে বসবাস করে করছে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। এবং বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর পাশা-পাশি মোট ১১ টি জনগোষ্ঠীর লোকের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। লক্ষ্য করা যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী যেমন—সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, রাজবংশী ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সবাই আদিবাসী। কারণ বরেন্দ্র এলাকায় এদের বাস বাঙালি জনগোষ্ঠীর আসার আগেই। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মান্দি (গারো), হাজং, কোচ ও হাদি; সিলেটের মণিপুরি, খাসী, ত্রিপুরা, লুসাই; বরিশালের রাখাইন; খুলনা অঞ্চলের মালো, মাহাতো এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের খিয়াং, খুমী, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ মোট ১১টি পার্বত্য জাতিগোষ্ঠী প্রায় ৫০০ বছর ধরে বাস করে আসছে। আর এই ১১ টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় হল অন্যতম। এই চাকমা জাতি সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদেও বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে চলছে। বিশেষ করে লক্ষ্য করা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি অঞ্চল জুড়ে চাকমাদের বসবাস। এছাড়া ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা,মিজোরাম, অরুনাচল এবং মায়ানমারের কিছু কিছু জায়গায় বহু সংখ্যক চাকমার বসবাস রয়েছে।
ভারত মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। অতীতেকালে অধিক তুলা উৎপাদন হত বলে বৃহত্তর এই পার্বত্য চট্টগ্রামেকে কার্পাস মহল নামে নাম করন করা হয়। ১৯৮৩ সালে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামকে বান্দরবান জেলা এবং পরে খাগড়াছড়ি জেলায় উন্নীত করে রাঙামাটিসহ তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয় ।
আদিকাল থেকে যুগ যুগ ধরে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে ১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি। বৈচিত্র এই জনগোষ্ঠি সমূহের জীবন ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে অতি কৌতুহলের। নান্দনিক এই পার্বত্য অঞ্চলের চাকমারা বিভিন্ন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করে চলছে। আর এই চাকমা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সব চাইতে পরিশ্রমী। কঠোর পরিশ্রম করার ফলে আদিবাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করছে চাকমা জাতি। আর চাকমা জাতিদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সমাজ, সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক ও সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ও জীবনাচার রয়েছে। চাকমা ভাষার প্রচুর বাংলা শব্দ ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের কিছুটা মিল রয়েছে। চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালায় তান্ত্রিক শাস্ত্র, পালা গান, কাব্য ও ধর্মীয় গ্রন্থেও পান্ডুলিপি লেখা রয়েছে।
চাকমা জাতির জীবন বৈচিত্রঃ-
চাকমা জাতির জীবনাচার সমগ্র মানুষের কাছে অতি কৌতুহলের। চাকমাদের সকল জীবনাচার বৈচিত্র বাংলাদেশে এক সৌন্দর্যময় রুপ হিসেবে পরিনত করে তুলছে। যেমন :-
* চাকমাদের ধর্ম :- বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল চাকমা সম্প্রদায়ে লোকেরা বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম হল বৌদ্ধ ত্রিপিটক। চাকমা ছাড়া ও বাংলাদেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মকে অনুসরন করে। যেমন :- রাখাইন, মারমা, সহ অনেকে বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে।
* চাকমাদের খাদ্য :- চাকমাদের অন্যতম প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। চাকমাদের অন্যতম জনপ্রিয় হল নাপ্পি (চিদোল)। এই জনপ্রিয় নাপ্পি(চিদোল) বিভিন্ন তরকারিতে মিছিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। মাছ এমন ভাবে রান্না করে যেন চিন্তার বিষয়। কেননা বাঁশের চুঙা দিয়ে চাকমারা মাছ-মাংস সহ বিভিন্ন প্রকার রান্না করে থাকে।
* চাকমাদের কৃষি :- চাকমাদের অন্যতম প্রধান কৃষি হল জুম চাষ। এক থেকে অন্য স্থান চাষাবাদের জন্য স্থান নির্বাচন করার নামই জুম চাষ। আদিবাসীরা জুম চাষের পাশা-পাশি জুম চাষের মধ্যে দিয়ে ধান,ভুট্টা, তুলা, আঁখ, শসা, বেগুন, আদা, হলুদ সহ ইত্যাদি চাষ করে। জুমের মধ্যে তুলা চাষ করা হত বলেই বৃটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম দেন কার্পাস মহল।
* চাকমাদের বিনোদন বৈচিত্র :- চাকমাদের অন্যতম প্রধান হল চাকমা ভাষায় রচিত গেংখুলি পালা গান। এছাড়াও বার মাসের পালা গান, ধর্মীয় গীতিকা, কাব্য, প্রবাদ বাক্য, ছড়া, ধাঁ ধাঁ ইত্যাদি গ্রন্থে চমৎকার ভাবে সবাইকে আকর্ষন করে তোলে।
* চাকমাদের হস্ত শিল্প :- চাকমা মেয়েরা অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় অনেক পরিশ্রমী। নিজের স্বাসীর উপর বসে না থেকে নিজেই পরিশ্রম করে বিভিন্ন ভাবে পরিবারে আয় করে থাকেন। পিনোন- কাদি হল চাকমা মেয়েদের অন্যতম পোশাক। আর এ পিনোন – কাদি বুননে চাকমা মেয়েরা অনেক পারদর্শী। আর এই পিনোন- কাদি তৈরি করে চাকমা মেয়েরা পরিবারে অর্থ যোগান দেয়। এমনকি মেয়েদের চাদর,ব্যাগ, শীত পোশাক ও বয়ন শিল্পেও চাকমা রমণীদের খ্যাতি সমৃদ্ধ।
* চাকমাদের শিক্ষা :- চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। আর সে সব বর্ণমালা গুলো লিখিত ভাবে বইতে রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে ২০১৬ প্রাথমিক স্তরে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালায় পাঠ্য শিক্ষাক্রম চালু করছে।
* চাকমাদের সংস্কৃতি :- চাকমাদের সংস্কৃতি বলতে চাকমাদের ঘর-বাড়ি, বিবাহ,ভাষা, বিজু উৎসব পালন, সামাজিক নিয়ম-নীতি, ধর্মীয় আচার, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছেদকে বোঝায়।
* চাকমাদের ঘর-বাড়ি :- চাকমাদের ঘর- বাড়ি সাধারনত বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাঁশ দিয়ে তৈরি করে নিজের বাস স্থান। কালবেদে অতীত ও বর্তমানে মাটির ঘর ও টিনের ঘর প্রচলন বেড়ে চলছে। তবে চাকমাদের প্রধান ঘর-বাড়ির ধরন হল মাচাং ঘর।
* চাকমাদের বিবাহের নিয়ম- নীতি :- অন্যান্য গোত্রের মত চাকমাদের বিয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-নীতি। চাকমারা সাধারনত চাকমা বাদে অন্য জাতিকে বিয়ে করা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ বলে জানে। চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষই চাকমা সম্পাদায়ের লোককে বিয়ে করতে পারবে। তবে সে অবশ্যই বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হতে হবে।
* চাকমাদের উৎসব: চাকমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব হল বিজু। চাকমা সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীরা এই বিজু উৎসব পালন করে। মূলত বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে এবং পুরাতন বছরকে বিদায় জানাতে চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে। আর এই বিজু বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। বিজুর একদিন আগে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে চাকমা মেয়েরা ফুল দিয়ে বরন করে। শতশত ফুলের রাশি দিয়ে নতুন বছর কে আমন্ত্রন করে থাকে।
* চাকমাদের মদ :- চাকমাদের অন্যতম প্রিয় ও প্রধান নেশাদ্রব্য হল মদ। বিজুতে মদ খেয়ে মনের খুশিতে গান গেয়ে হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়ানো, চাকমাদের অন্যতম । মদের পাশা-পাশি দাবা(হুক্কা) বেশ জনপ্রিয় লাভ করে। বিশেষ করে মেয়েরা দাবা(হুক্কা)তে বেশ আগহী।
* চাকমাদের ভাষা :- চাকমাদের অন্যতম প্রধান ভাষা হল চাকমা। চাকমাদের নিজস্ব চাকমা ভাষা রয়েছে। এমনকি চাকমা ভাষার নিজস্ব পান্ডুলিপি রয়েছে।
* চাকমাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ :- চাকমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক-পরিচ্ছেদ রয়েছে। মূলত ছেলেরা দুতি ও মেয়েরা পিনোন- কাদি পরিধান করে থাকে। এবং পায়ে বড় বড় হারু, মেয়েরা গলায় ও নাঁকে সোনা ও পায়ে রুপার নুপুর সহ অনেক কিছু পরিধান করে। বর্তমানে যুগের অনেক পরিবর্তন হওয়ায় চাকমারা প্যান্ট,শার্ট, ত্রিপিজ,শাড়ি, ব্লাউজ সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক-পরিচ্ছেদ ব্যবহার প্রচলন হচ্ছে।
* চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা :- চাকমাদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পিঠা স্বাদ ভিন্ন। চাকমাদের পিঠার স্বাদে যেন মধু মিশ্রিত। যা সকলের মন জুড়ে স্থান দখল করে নিয়েছে। পিঠা গুলো যেমন : চান্নেপিঠা, বরাপিঠা,কলাপিঠা,বিনিপিঠা,হোগা পিঠা সহ ইত্যাদি। চাকমাদের পিঠার গুলোর নাম যেন কৌতুহলের।
চাকমা জাতিগোষ্ঠীর এসব সংস্কৃতি যেন সমগ্র বাংলাদেশকে পরিপূর্ণতা দান করছে। এই চাকমা জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশ অবস্থান করছে বলেই বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে সমৃদ্ধতা লাভ করছে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে সিটি কলেজ সরিয়ে নেওয়ার দাবি ঢাকা কলেজের
ঢাকার সায়েন্সল্যাব মোড় এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদেরবিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূস: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরিপ্রার্থী তৈরি করে, এটি ত্রুটিপূর্ণ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা।বিস্তারিত পড়ুন
আইসিটি অধ্যাদেশ অনুমোদন, ধারণ করা যাবে বিচার প্রক্রিয়ার অডিও-ভিডিও
‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৪’’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনবিস্তারিত পড়ুন