বাবুল-মিতুর মেয়ের জিজ্ঞাসা মা কী আমার জন্মদিনেও আসবে না?
বাবুল-মিতুর ছোট্ট মেয়ে তাবাসসুম তাজনীন টাপুর। গেল ১৬ নভেম্বর পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। মাঝে মাঝে সে জানতে চায় মা কবে ফিরবে। সে জানে মা বিদেশে গেছে। খুব শিগগিরই ফিরবে। জানে না মা আর নেই। আর কখনো ফিরবে না।জন্মদিনে তাই টাপুরের প্রশ্ন ‘মা কী আমার জন্মদিনেও আসবে না?’ এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে নিজের চোখের পানি আড়াল করে রাখেন মিতুর মা শাহিদা মোশাররফ। মিতু হত্যার দুঃস্বপ্ন এখনও তার পরিবারের সকল সদস্যদের তাড়া করে বেড়ায়।
সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু (৩২) খুন হয়েছেন চলতি বছর ৫ জুন। এই ৬ মাসেও চাঞ্চল্যকর এ খুনের ঘটনার তদন্তে আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তারা। মিতু হত্যার পর তার পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি কিছুটা শুকালেও হৃদয়ের ক্ষত শুকায়নি।
সাহসিকতার সঙ্গে চট্টগ্রামে সর্বত্র জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের আস্তানা খুঁজে তাদের উত্থান ঠেকানোর নেপথ্যের নায়ক সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার হাজারো মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। কোনো মানুষ তার কাছে এসে সাহায্য না পেয়ে ফিরে যাননি। বদলি হওয়ার পর মানুষ তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে, অনেকের অশ্রু জলে নয়ন সিক্ত হয়েছে। চাকরি হারানোর পর এক সময়ের সেই সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ছেলে আকতার মাহমুদ মাহির(৭) ও মেয়ে তাবাসসুম তাজনীন টাপুরকে (৫) নিয়ে নিভৃতে সময় কাটাচ্ছেন। চাকরিরত অবস্থায় দেশে এবং দেশের বাইরে জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্বপালনের পর পেশাগত দায়িত্ববোধের কারণে নিজ সন্তানদের ঠিকভাবে সময় দিতে পারেননি বাবুল। স্ত্রী মিতুই দুই শিশু সন্তানকে আগলে রাখতেন। সেই স্ত্রী নিমর্মভাবে খুন হওয়ার পর চাকরিহারা বাবুল আক্তার এখন নিজেই দুই শিশু সন্তানকে আগলে রাখছেন।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ায় বাবুলের শ্বশুর বাড়িতে সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের কথা হয় তার শাশুড়ি ও মিতুর মা শাহিদা মোশাররফের সঙ্গে। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘টাপুর শুধু তার মায়ের কথা জানতে চায়। কারণ তাকে সত্যটি এখনো জানানো হয় নি। চেষ্টা করি মেয়ে হারানোর ব্যথা ভুলে থাকতে। কিন্তু নাতনি (টাপুর) যখন ওর মায়ের কথা জানতে চায় তখন বুঝতে পারি না যে নিজেকে সান্ত্বনা দেব, নাকি ওকে বুঝাবো।’
আবেগ তাড়িত কণ্ঠে শাহিদা মোশাররফ বলেন, ‘গত ১৬ নভেম্বর বুধবার টাপুর পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। সে এখন নার্সারিতে পড়ছে। সেদিনও আমার কাছে জানত চাইল আজ তো আমার জন্মদিন। আম্মু কি আমার জন্মদিনেও আসবে না? ওইদিন বারবার টাপুর মিতুর কথা জিজ্ঞেস করেছে। অবুঝ শিশু দুটোর কথার কোনো জবাব দিতে পারি না।’
দুপুরের খাবার খেতে খেতে মাঝে মধ্যে একটু বিরতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘মাকে ছাড়াই এই প্রথমবার ওরা (মাহির ও টাপুর) ঈদ কাটিয়েছে। জন্মদিনটিও সেভাবেই কেটে গেল। জন্মদিনের জন্য তেমন কোন আয়োজন করা হয়নি। গত ১৮ নভেম্বর শুক্রবার রাতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দোয়া মাহফিল শেষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেক কাটা হয়।’
হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহই এর বিচার করবেন। আর ততদিনে হয়তো ওরা (মাহির ও টাপুর) জানতে পারবে ওদের মা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে এবং কারা এর জন্য দায়ী।’
গত ৫ জুন (রোববার) সকাল ৬টা ২০ মিনিটে মাহমুদা আক্তার মিতুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ায় ২২০/এ নম্বর বাসায় দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন। বাবা হিসেবে বাবুল আক্তার দুই সন্তানের যথেষ্ট খেয়াল রাখছেন। সঙ্গে মিতুর পরিবারের সদস্যরাও দুই শিশু সন্তান আকতার মাহমুদ মাহির ও তাবাসসুম তাজনীন টাপুরের খেয়াল রাখেন।
বাবুল আক্তারের শ্বশুর মো. মোশাররফ হোসেন দ্য রিপোর্টকে জানান, বাবুলের বড় ছেলে আকতার মাহমুদ মাহিরের বয়স সাত বছর। বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে মাহিরকে এবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানোর চেষ্টা চলছে। বাবুল আক্তার এখন সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওদের খাওয়ানো, গোসল, স্কুলে আনা-নেওয়া সবই করে সে। মাঝে মধ্যে ওদের নিয়ে ঘুরতে বের হয় বাবুল। মা হারানোয় ওদের মনে যাতে কোনো ক্ষতের সৃষ্টি না হয় তার পুরো চেষ্টা করছে সে। এ ছাড়া টিভি দেখা, পত্রিকায় খবর পড়া এসব নিয়েই আছে বাবুল।
১৫ বছর আগে একই জেলায় পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল ওয়াদুদ ও পরিদর্শক (ওসি) মো. মোশাররফ হোসেনের মধ্যে পরিচয়ের সুবাদে তাদের ছেলে-মেয়ে বাবুল ও মিতুর মধ্যে বিয়ে হয়। বাবুল আক্তারের আচরণে মুগ্ধ হয়েছিলেন শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। বাবুল আক্তারও প্রথম দেখায় পছন্দ করে ২০০২ সালে বিয়ে করেন মাহবুবা আক্তার মিতুকে। বিয়ের পর বিসিএস দিয়ে পুলিশে যোগদান করেন বাবুল আক্তার। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সকল কাজের অনুপ্রেরণায় ছিলেন স্ত্রী মিতু। পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা আসবেই। সে বাধা মাড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে এমনটাই সব সময় বলতেন মিতু। উদ্বিগ্ন থাকলেও কখনো স্বামীর পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বে বাধা দেননি মিতু। বরং বিভিন্ন সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম নগরের খোয়াজ নগর থেকে হাটহাজারীর আমানবাজার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের ধরার পর তিনি খুবই উদ্বিগ্ন থাকতেন। বাবুল আক্তারের আশংকা ছিল তার পরিবারের উপর হামলা হতে পারে। এমনটিই বাবুল আক্তারের সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আর ওই সময়টি নিয়ে ভাবতে চাই না। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই আমার সকল চিন্তা। কিছু একটা তো করতে হবে। তবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই।’
প্রসঙ্গত, ছেলে আকতার মাহমুদ মাহিরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে দিয়ে আসার জন্য প্রতিদিন সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হতেন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। তবে গত ৪ জুন (শনিবার) রাতে একটি নম্বর থেকে তার মোবাইলে এসএমএস আসে যে সকালে ছেলের স্কুলে কুচকাওয়াজ ও অ্যাসেমব্লি রয়েছে। ওই এসএমএস পেয়েই মিতু পরদিন ৫ জুন (রোববার) সকাল ৬টা ২০ মিনিটে বাসা থেকে বের হন। বাসার ১০০ গজ দূরত্বে নগরের পাঁচলাইশ থানার জিইসি মোড়ে দুর্বৃত্তরা মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। মাহমুদা আক্তার মিতু শহরের ওআর নিজাম আবাসিক এলাকার ‘ইক্যুটি সেনটিয়াম’ নামে একটি বাড়ির সপ্তম তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। বাসায় ছেলে আকতার মাহমুদ মাহির, মেয়ে তাবাসসুম তাজনীন টাপুর ও গৃহকর্মী ফাতেমা আক্তার ছিলেন।
গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পদোন্নতি পাওয়ার পর তাকে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। তাকে কোথায় পদায়ন করা যায় কর্তৃপক্ষের এমন চিন্তাভাবনার মধ্যেই গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি’র মোড় এলাকায় তার স্ত্রী মিতু দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন। স্ত্রী খুন হওয়ার দিন তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। পরে তিনি স্ত্রীর লাশ আনতে চট্টগ্রাম যান। তবে এ ঘটনার পর গত ২৪ জুন রাতে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ঘণ্টা পর তাকে ২৫ জুন সন্ধ্যায় শ্বশুরের বাসায় আবার পৌঁছে দেওয়া হয়।
স্ত্রী মিতুকে হত্যার ঘটনায় গত ২৪ জুন পুলিশ সদর দফতরে বিশেষ পরিস্থিতিতে পদত্যাগপত্র জমা দেন বাবুল আক্তার। তবে সে সময় বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচিত হলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। দীর্ঘ ছুটি শেষে বাবুল আক্তার পুলিশ সদর দফতরে এলেও চাকরিতে যোগ দিতে না পারায়, বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ৪ আগস্ট বাবুল আক্তার পুলিশ সদর দফতরে কাজে যোগদানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। যেখানে এসপি বাবুল আক্তার বলেন, ‘Duties resume (দায়িত্বে পুনর্বহাল) করতে চাই।’ তবে তখন পুলিশ সদর দফতর থেকে বলা হয়, ‘পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ায় তার চাকরিতে যোগদানের সুযোগ নেই।’ এর পর তিনি চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য গত ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরও লিখিত আবেদন করেন। ওই আবেদন পত্রে তিনি বলেন, ‘গত ২৪ জুন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে, বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরির অব্যাহতি পত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। স্বেচ্ছায় দাখিল করিনি।’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
উপদেষ্টা মাহফুজ: সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন,“গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থেবিস্তারিত পড়ুন
বড় ব্যবধানে অ্যান্টিগা টেস্টে হারলো বাংলাদেশ
চতুর্থ দিনেই অ্যান্টিগা টেস্টের ফল কোন দিকে গড়াচ্ছে, তা নির্ধারণবিস্তারিত পড়ুন
কিশোরগঞ্জে মা-বাবা ও ২ সন্তানের মরদেহ উদ্ধার
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় একই পরিবারের চার জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেবিস্তারিত পড়ুন