১৪ বছর কারাদণ্ড! বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ রায় এটি
তারাপুর চা-বাগান বন্দোবস্ত নিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতির অভিয়োগ প্রমাণিত হওয়ায় বহুল আলোচিত শিল্পপতি রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইকে পৃথক চারটি ধারায় মোট ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরো বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় এক পৃষ্ঠার এই সংক্ষিপ্ত রায় পাঁচ মিনিটে পড়া শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দেন।
একই সঙ্গে আদালত তাদেরকে দুটি ধারায় ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে তিনমাস করে মোট ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এছাড়া দণ্ডবিধির ৪৬৬/৪৬৮ ধারায় ছয় বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। আর ৪২০ ও ৪৭১ ধারায় পিতাপুত্রের প্রত্যেককে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই সাজা আলাদা করে ধারাবাহিকভাবে মোট ১৪ বছর করে প্রত্যেককে ভোগ করতে হবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরো বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটিও একটি জনগুরুত্বপূর্ণ রায়। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য দ্বারা এটা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আসামি রাগীব আলী ও তার ছেলে আব্দুল হাই শুধুমাত্র সিলেটের নয়, তারা অর্থ-বিত্তে বলিয়ান দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী।
এই ধরণের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বর্তমান বাংলাদেশে তাদের অবৈধ প্রভাবকে ব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করার জন্য কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক (সরকারি) ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে কাগজপত্র প্রতারণামূলকভাবে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মানবিক মুখোশ পড়ে অবৈধ পক্রিয়ায় জনসম্পদ আত্মসাৎ তথা লুটপাট করছে তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত এই রায়।
বিচারক আরও উল্লেখ করেন, রাষ্ট্র তথা স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন এবং বিজ্ঞ প্রসিকিউশন টিম এই মামলায় আনীত অভিযোগ প্রমাণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা তথা নজিরবিহীনভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রায়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা খুশি। এই রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যদিকে, রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। তাই আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর আলোচিত এ মামলার আসামিদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। মোট ১৪ সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। পরে অবশ্য রাগীব আলী ও তার ছেলে গ্রেফতার হলে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই ১১ সাক্ষীকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা পুনরায় জেরা করেন। এছাড়া দুজন সাক্ষী আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে ও ভূমিন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি করে তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে নেন রাগীব আলী। বাগানের একাংশে রাগীব আলী ও তার স্ত্রীর নামে মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজ স্থাপন করেন।
সিলেটের তারাপুর চা বাগান নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ১৯৯৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন তৎকালীন ভূমি কমিশনার এসএম আব্দুল কাদের। এছাড়া সরকারের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন।
মামলায় ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জায়গায় গড়ে ওঠা সিলেটের হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগানের জমি আত্মসাতের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জাল করার অভিযোগ আনা হয়ে রাগীব আলী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে।
এই মামলার বিরুদ্ধে রাগীব আলী উচ্চ আদালতে গেলে দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের শুরুতে তার নিষ্পত্তি হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত ১৯ জানুয়ারি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালুর নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই আদেশের পর ১৫ মে চা-বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।
মামলা হওয়ার ১১ বছর পর গত বছরের ১০ জুলাই সিলেটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত সুপার সারোয়ার জাহান আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এ মামলায় গত ১০ আগস্ট রাগীব আলী ও তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম আদালত। ওই দিনই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যান তিনি।
গত বছরের ১২ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে গ্রেফতার করে জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ। আর ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২৪ নভেম্বর ভারতে গ্রেফতার হন রাগীব আলী। ওই দিনই সিলেটের সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে তাকে তাকে দেশে এনে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ভূমি আত্মসাতের মামলায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার।
রাগীব আলীর স্মারক জালিয়াতি মামলার রায় হলেও তার বিরুদ্ধে ভূমি আত্মসাতের মামলায় এখনও সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এ মামলার আসামিদের মধ্যে রাগীব আলী, আবদুল হাই জেলে রয়েছেন। জামিনে আছেন সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ও ভুয়া সেবায়েত মোস্তাক মজিদ। আর রাগীবের জামাতা আবদুল কাদির ও মেয়ে রুজিনা কাদির পলাতক।
৭৮ বছর বয়সী রাগীব আলী সিলেটের আলোচিত-সমালোচিত শিল্প উদ্যোক্তা। ব্যাংক, চা-বাগান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও লিডিং ইউনির্ভাসিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন সিলেটের বিশ্বনাথের কামালবাজারে জন্ম নেওয়া রাগীব আলী।
এছাড়াও তিনি স্থানীয় দৈনিক সিলেটের ডাকের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ও তার ছেলে আব্দুল হাই পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। বর্তমানে তারা দুজন জেলে থাকায় তার ভাতিজা আবদুল হান্নান সিলেটের ডাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর পদ হারালেন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রদলেরবিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল গ্রেপ্তার
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে রাজধানীরবিস্তারিত পড়ুন