বিতর্কে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
বিদেশ থেকে আসে জঙ্গিবাদের টাকা
মাত্র এক বছরেই ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) নামে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। ২০০৮ সালে ওই অর্থ দিয়েছে দুই ব্যক্তি ও দুটি এনজিও। অভিযোগ আছে, দুই ব্যক্তি দাতার মধ্যে একজনের প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলায় আল-কায়েদাকে অর্থ দিয়েছিল। এনজিও দুটিও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়ন করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। আইআইইউসির নামে আসা অর্থ কোন খাতে খরচ হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও আবাসিক হল নির্মাণের নামে এলেও এই দুই খাতে অতিরিক্ত খরচ দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।
আইআইইউসি ছাড়াও এ ধরনের অর্থ পাওয়ার সন্দেহের তালিকায় আছে রাজধানীর সাত-আটটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই বিদেশি সাহায্য নিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা বিএনপি-জামায়াত ঘরানার।
জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসছে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আসছে তাদের নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক দেশেই এসব প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একাডেমিক ভবন, হোস্টেল নির্মাণসহ নানা কাজের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ এলেও তা ব্যয়ের সঠিক হিসাব দিতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বিদেশি সাহায্য নিতে হলে আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এ নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করছে না বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থ গ্রহণ শেষে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে।
সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে চিহ্নিত হয়। জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহে আটকও করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ায় তাদের অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে উঠেছে বিদেশি সাহায্য নিয়ে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত টাকা বিদেশি সাহায্য এসেছে এবং তা কিভাবে ব্যয় হয়েছে সেই তথ্য খুুঁজছে মন্ত্রণালয়।
আইআইইউসির কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক : আইআইইউসিতে শুধু ২০০৮ সালেই সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ছয় কোটি ২৯ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুটি ভবন নির্মাণের পেছনে ব্যয় করেছে। ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে পারে এমন সুবিধার একটি ছাত্রাবাস নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে তিন কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। আরেকটি একাডেমিক ভবন নির্মাণে দুই কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। বাকি আট কোটি টাকা কোন খাতে খরচ হয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে।
জানা গেছে, আইআইইউসির নামে গত আট বছরে মোট কী পরিমাণ অর্থ এসেছে তাও জানে না ইউজিসি। আইআইইউসি কর্তৃপক্ষ যে দুই ব্যক্তি ও দুটি সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে এর মধ্যে একজন হলেন আল-বারাকা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এবিআইডি) চেয়ারম্যান শেখ সালেহ কামাল। এ প্রতিষ্ঠান ও সালেহ কামালের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলায় সন্ত্রাসীদের অর্থ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি ক্ষতিপূরণের মামলাও তখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করা হয়েছিল সালেহ কামালের বিরুদ্ধে। তবে প্রমাণের অভাবে তিনি সে যাত্রায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। সৌদি ধনকুবের সালেহ কামাল আইআইইউসিকে ২০০৮ সালে তিন লাখ ৯৩ হাজার ডলার অনুদান দেন। ওই বছর ব্যক্তিপর্যায়ে আরেক সৌদি ধনকুবের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আহমেদ মোহাম্মদ আলী আল মাদানি আইআইইউসিকে দিয়েছেন চার লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার।
জানা গেছে, ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদান ছাড়া আইআইইউসি কুয়েতভিত্তিক সাহায্য সংস্থা জাকাত হাউসের কাছ থেকে ২০০৮ সালে পেয়েছে ৯ হাজার ৯১৬ ডলার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের এনজিও শারজাহ চ্যারিটি হাউস ফাউন্ডেশন থেকে ৯ লাখ ৬০ হাজার ৮১৬ মার্কিন ডলার। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বিশেষত ইসলামী ব্রাদারহুডের পেছনে অর্থ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি কোনো সন্ত্রাসীকে অর্থ দেয় না, বরং তারা এমন সব প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দিয়ে থাকে যারা সন্ত্রাসীদের পেছনে ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ ব্যয় করে থাকে।
কুয়েতের জাকাত হাউস ২০১০ সালে রিভাইভাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটিকে (আরআইএইচএস) দেড় মিলিয়ন ডলার অনুমোদন দিয়েছে। আরআইএইচএস বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত আছে এমন বহু নজির রয়েছে।
মার্কিন অর্থ দপ্তরের ২০০৮ সালের ১৩ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আল-কায়েদা ও বিশ্বব্যাপী এর সহযোগী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অর্থ দিয়ে থাকে আরআইএইচএস।
বিদেশ থেকে অনুদান নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আইআইইউসির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এ কে এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিদেশি কোনো অনুদান নিই না।’ বিদেশি অনুদানের দিনক্ষণ উল্লেখ ও দাতা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করার পর তিনি বলেন, ‘টাকা এসে থাকলে সরকারের অনুমতি নিয়েই এসেছে। আমাদের বিদেশি শিক্ষার্থী আছে, তাদের স্কলারশিপ বাবদও অর্থ আসতে পারে।’ বিতর্কিত সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. এ এ কে এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকটি বিষয়ে অডিট হয়ে থাকে। বিস্তারিত জানতে চাইলে অফিস সময়ে আসেন।’
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ হাজার ৩৩। এর মধ্যে ৭৯ জন বিদেশি। মোট ৩৯৩ জন শিক্ষকের মধ্যে খণ্ডকালীন শিক্ষক ১০০ জন। ২০১৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় আয় করেছিল ৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ব্যয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় করে ৭১ হাজার ৭৯২ টাকা।
অবৈধ ক্যাম্পাসও পরিচালনা করছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ভর্তি না হতে সতর্কতা জারি করেছে। যে পাঁচ ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে নিষেধ করা হয় সেগুলো হলো—চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, কর্ণফুলী ভবন, কেয়ারি শপিং মলের পেছনে বর্ধিত ভবন, গুলজার টাওয়ার ও চট্টেশ্বরী রোড শাখা। এর আগে ২০১৪ সালে ইউজিসির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস পরিচালনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সারা বিশ্বের। তারা যত বেশি বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা করবে, অনুদান গ্রহণ করবে তত বেশি ভালো। সেই হিসেবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিপথগামী হওয়ায় বিদেশি অনুদান নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। সন্দেহটাও শুরু হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি ওআইসি চালায়। তারা বিরাট বড় সংস্থা। তাদের সঙ্গে সরকারেরও ভালো সম্পর্ক। তাই আইআইইউসি যখন বিদেশি অনুদান গ্রহণ করে আমাদের কাছে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট চাইলে আমরা ইউজিসির মতামত গ্রহণ করে দিয়ে দিই। এরপর তা চ্যান্সেলর অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়।’
আইআইইউসির নিয়ন্ত্রণ জামায়াত নেতাদের হাতে : এদিকে চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব জানান, আইআইইউসি নিয়ন্ত্রণ করছেন জামায়াত নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের ৩৯ সদস্যের মধ্যে ২৫ জন বিদেশি। এই ২৫ জন সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য নেই সরকারের কাছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যে ১৪ জন রয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা শামসুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে মহানগর জামায়াতের আমির। কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্য ১২ জনের সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দলটির কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে জানা গেছে।
বিদেশি কোটায় ট্রাস্টি বোর্ডে থাকা ২৫ জন সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে লুকোচুরি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ট্রাস্টি বোর্ডের অপশন থাকলেও তা ব্লক করা।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
রবিবার যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
গ্যাস পাইপলাইনের মেরামত কাজ ও জরুরি স্থানান্তরের জন্য রবিবার দেশেরবিস্তারিত পড়ুন
জেমিনি চ্যাটবটে যুক্ত হলো মেমোরি, যে সুবিধা পাওয়া যাবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট জেমিনিতে নতুন সুবিধা যুক্ত করেছে গুগল।বিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা সিটি কলেজে ক্লাস বন্ধ রাখা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার সংঘর্ষেবিস্তারিত পড়ুন