বিপজ্জনক ৫৪ ওষুধ কম্পানি
ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ বানিয়ে আসছে দেশীয় ওষুধ কম্পানি টেকনো ড্রাগ। কম্পানিটি তৈরি ও বাজারজাত করছে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক এবং হরমোন জাতীয় ওষুধও। অথচ ওই কম্পানির তিনটি কারখানার একটিতেও সঠিক মানসম্মতভাবে এ ওষুধ তৈরি করা হয় না। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির কাছ থেকে এমন চিত্র পেয়ে ওই কম্পানির পেনিসিলিন ও সিফালোস্পিরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক এবং হরমোন জাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
শুধু এই একটি কম্পানিই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭৬ সালের জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করাসহ আরো কিছু কারণে গতকাল বুধবার দেশের ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ মোট ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এর আগে ওই কমিটির উদ্যোগে ওষুধ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পরিদর্শন টিম ৮৪টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। গতকাল এক সভায় ওই প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার পর ওই কমিটি এসব সুপারিশ করে। এ সুপারিশ কার্যকরের জন্য তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। দুই বছর আগে সংসদীয় কমিটির এমন এক তদন্তকেন্দ্রিক সুপারিশ অনুসারে সরকার ৬২টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই ৬২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তখন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হয়েছিল। পরে
একাধিক প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালত থেকে লাইসেন্স বাতিল আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ পেয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। এবার শাস্তির আওতায় থাকা কয়েকটি ওষুধ কম্পানি আগের দফায়ও শাস্তির আওতায় ছিল।
সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ না করলে উৎপাদিত ওষুধ মানসম্পন্ন হয় না, ব্যবহারকারীর রোগ না সেরে বরং শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, যে ক্ষতি প্রাণঘাতীও হতে পারে এবং এই ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য সার্বিক বিবেচনায় পরিত্যাজ্য।’
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব কম্পানির ওষুধ এখনো যেহেতু বাজারে রয়েছে, তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুত আদেশের মাধ্যমে এসব ওষুধ বাজার থেকে তুলে ফেলা। নয়তো এসব কম্পানির ওষুধ নিয়ে চিকিৎসক-রোগীদের মধ্যে যেমন বিভ্রান্তি তৈরি হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করলেও এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। তারা অফিশিয়ালি আদিষ্ট হওয়ার পরই কার্যকর ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে বাজার থেকে সংশ্লিষ্ট ওষুধ প্রত্যাহারেরও ব্যবস্থা নেবে তারা।
জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বিধান অনুসারে মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখান থেকে আবার আমাদের অধিদপ্তরে আসার পরপরই আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ শুরু করে দেব। আর যেহেতু সংসদীয় কমিটিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবও থাকেন আর তাঁদের উপস্থিতিতেই সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, তাই বলা যায় এটাই চূড়ান্ত। আমরা এখন কেবল নথিপত্রের দাপ্তরিক নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বা মন্ত্রণালয়ের আদেশে আমরা যেসব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি, অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের আদেশে আমরা সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই। কারণ এখনো ১২-১৩টি কম্পানি আমাদের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালত থেকে আদেশ পেয়ে উৎপাদন ও বাজারজাত চালু রেখেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো আইনি লড়াই করছি।’
এবার সংসদীয় তদন্ত কমিটি ২০টি ওষুধ কম্পানির ওষুধ উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি ১৪টি কম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপ) উৎপাদনের অনুমতি বাতিল, ২২টি কম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি কম্পানির মানবদেহে বাহ্যিকভাবে ব্যবহার্য ওষুধ, একটিকে প্রাণিসম্পদে ব্যবহার্য ওষুধ এবং অপর একটিকে সেফালোস্পিরিন বাদে অন্যান্য গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
গতকাল ওষুধ উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশের আওতায় থাকা ২০টি কম্পানির মধ্যে রয়েছে—এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলফা ল্যাবরেটরিজ, কাফিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো কেমিক্যাল, রিড ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে ওই প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা শেষে সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়। কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, আ ফ ম রুহুল হক, ইউনুস আলী সরকার ও সেলিনা বেগম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এ ছাড়া বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কমিটি সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত তদন্তদলের পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। পাঁচ সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ তদন্তদলে আরো ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাহাবুদ্দিন কবীর চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী।
গতকাল সংসদীয় কমিটির সভায় নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ১৪টি কম্পানির মধ্যে রয়েছে আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্টাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, ফনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল, সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড ইত্যাদি।
এ ছাড়া পেনিসিলিন ও সেফালোস্পিরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ২২টি কম্পানি হচ্ছে—অ্যামিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএম’স ল্যাবরেটরিজ (সাবেক রেমিডি), গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল, মাকস ড্রাগস, মেডিম্যাট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যাল, মাইস্টিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যাল, সীমা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ও হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
কমিটির সদস্য সেলিনা বেগম কালের কণ্ঠকে জানান, সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। বিশেষ করে জীবনহানিকর ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি যারা বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। কালের কণ্ঠ
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ভরিতে এবার ১,৯৯৪ টাকা বাড়লো স্বর্ণের দাম
দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনবিস্তারিত পড়ুন
সংস্কার হলে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কত কমানো সম্ভব জানালো সিপিডি
মূল্য নির্ধারণ কাঠামোর সংস্কার হলে লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১১বিস্তারিত পড়ুন
রাজশাহীতে সমন্বয়ককে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর অভিযোগ
রাজশাহীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় এক সমন্বয়ককে হাতুড়িপেটা করার অভিযোগবিস্তারিত পড়ুন