বিলের ধারে ঘুমিয়ে আছে তনু
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙার দিকে- পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ? ..
জীবন ও জগতের চিরন্তন এই সত্যকে বহন করেই মানুষকে একদিন চলে যেতে হয়। পৃথিবীর ধূলিকণা-মৃত্তিকায় নাশপাতির মতো লুপ্ত হয় মানুষের নিশ্চল দেহাবশেষ। মানুষ চলে যায় ঠিকই, রয়ে যায় তার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সাধ। তনুরও তো স্বপ্ন ছিল, ছিল সাধ। বড় হয়ে একদিন গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবে। পীড়িতের মুখে হাসি ফোটাবে। মানবজন্ম সার্থক করবে। কিন্তু এক কেমন মৃত্যু? এ কেমন নৃশংসতা? যেখানে কুড়িতেই ঝরে পড়তে হলো প্রস্ফুটমান পদ্মকে। ঝরে পড়া এমন ফুলের মূল্য কে দেবে, কেই বা শোনাবে সান্ত্বনার বাণী। দাদিমা বড় শখ করে নাম রেখেছিলেন সোহাগী। পুরো নাম সোহাগী জাহান তনু। সেই সোহাগীই এখন স্বজনদের সোহাগ ভুলে না ফেরার দেশে চলে গেছে অনন্ত অভিমানে। মুখ ভর্তি হাসি লুকিয়ে তনুর স্বপ্ন এখন শুয়ে আছে বিলের ধারে। আহ! অপার ক্লান্তিতে তনুর হৃদয় আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঘুনে ধরা ঘৃণ্য সমাজ বাস্তবতা থেকে।
কী দোষ করেছিল তনু? কেনই বা তাকে মাংসাশীদের হাতে এমন বিভৎস যন্ত্রণা ভোগ করে মরতে হল? কে দেবে সেই জবাব, তনুর চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্র কি এই ঘৃণ্যতার প্রতিবাদে সরব হতে প্রস্তুত? হয়তো প্রস্তুত, হয়তো না। কিন্তু সন্তানের অকাল মৃত্যুতে পিতার মনে যে বেদনা, যে ক্ষতের জন্ম হয়েছে কোন রঙে তাতে প্রলেপ দেবো আমরা। এমন কোনো শব্দপুঞ্জ কি আছে যাতে তনুর পরিবারকে মৃত্যুর মূল্য দেয়া সম্ভব।
মেয়ের মৃত্যুতে শোক বিহ্বল পিতা ইয়ার হোসেন কাঁপা কণ্ঠে জানাচ্ছেন- জন্মের পর আমার জেঠি আদর করে ওর নাম রেখেছিল সোহাগী। সবাই তাকে খুব আদর করতো। আমি আমার মা’টাকে বলতাম, মা’রে তোরে আমি বুকের মধ্যে আটকে রাখতে চাই। এই বলে বলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতাম। সে তখন বলতো- বাবা আমি তো বড় হয়েছি। তুমি কি পারবে সারাজীবন আমাকে তোমার বুকের মধ্যে আটকে রাখতে।
তনুদের গ্রামেরই এক বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছিলেন- ইয়ার হোসেন শহরে চাকরি করে। মেয়্টো পরিবারে সবার ছোট। গ্রামের বাড়িয়ে বেড়াতে আসে বছরে একবার কি দুবার। আমরা সবাই বলতাম- এই মেয়ে একদিন বড় অফিসার হবে। কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধের গলা বসে গেল বোবাকান্নায়। গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন- এর বিচার যেন আল্লাহ্ করে!
তনুর আদরের ভাই রুবেল তনুর কথা স্মরণ করে মুহুর্মুহু চোখের জল ফেলছে। যে বোন তাকে এতো আদর করতো পলকেই কি করে সে ভুলবে তাকে। ভগিনী স্নেহে বেড়ে ওঠা রুবেল বলে, বোনটি বাসায় ফিরতে দেরি হলে আব্বা খুব চিন্তা করতেন। আমাকে বলতেন, যাওতো দেখো তো তনু তো এখনো বাসায় ফিরলো না। সেদিনও প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে তুই আর বাসায় ফিরলি না। অথচ গত ক’দিন ধরে তোকে খুঁজেতে খুঁজতে তোর বাবা-মা ভাত-পানি ছেড়েছে। তোর মা এখন ঘুমোতে পারে না। প্রতিরাতে ঘুমের ভেতর তোকে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে। তুই পুরস্কার আনার জন্য যে দুটো নতুন জামা আনতে বলেছিলি মা সেগুলো তোর জন্য যত্নে সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু তোকে না পেয়ে তোর মা এখন পাগলের মতো ছটফট করছে। মা কি আর কোনোদিনই পাবে না তোকে!
তনু হয়তো আর কোনোদিনই ফিরবে না। কিন্তু যাকে জীবনের কান্না দিয়ে দূর দেশে চলে গেলো তনু সেই মায়ের বুক ফেটে যাচ্ছে তবু মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। তবু সন্তানের জন্য আকুল হয়ে দিনভর বিলাপ করছেন তনুর মা। মেয়েকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে বলছেন- জননী গো…আমি বাসায় গেলে কে থাকবে আমার পাশে। আমারে একলা রাইখা তুই কই গেলি রে মা আমার। যে মা দিনের পর দিন তনুকে জঠরে ধারণ করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, হাঁটতে শিখিয়েছেন কয়েক প্রহরের অশ্রু বিসর্জন কি জঠরের সেই জ্বালা নিবারণ করতে পারবে। আজ তনুর মায়ের কান্না থামানোর কেউ নেই। রুবেল মায়ের কাছে এসে তার কান্না থামাতে চাইলো। কিন্তু মায়ের কান্না থামাতে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। পরক্ষণেই রুবেল বলছিল- এইতো ক’দিন আগেও আমি আপু আর আম্মু একসঙ্গে ছবি তুলেছি আপুর বার্থ ডে তে। একসাথে আমরা কত যে মজা করতাম আজ আপু চলে যাওয়াতে তা খুব বেশি করে মনে পড়ছে।
রুবেলের কথাগুলো শুনে নিথর দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামের অন্য মহিলারাও চোখের জল রোধ করতে পারলো না। তাদের চোখ গড়িয়েও তখন টপটপ করে নীরবে ঝরছে অশ্রু। তনু যেন দূরে গিয়ে আরো বেশি করে সবার মাঝে ফিরে আসলো।
বৃহস্পতিবার মাগরেবের গ্রামের মানুষগুলো দলবেধে তনুর কবর জিয়ারত করতে গেল। বাড়ি ফেরার পথে তাদের মুখে তনুকে নিয়ে নানা আশা-আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি ঘাতকদের প্রতি ক্ষোভ আর হতাশা ঝরে পড়লো। ভিক্টোরিয়া কলেজের সবুজ মাঠ মাড়িয়ে তনুর নিথর দেহখানি এখন নিরিবিলি শুয়ে আছে মির্জাপুরের কবরপ্রাঙ্গণে। ঘাতকদের নখড়াঘাতে তনুর স্বপ্ন আজ শতচ্ছিন্ন মেদিনীর মতো বাতাসে ভাসছে। স্বপ্নের সাথে ভাসছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর দ্রোহের অঙ্গীকার।
ক’দিন আগেও তনু তার ফেসবুকে লিখেছিল- আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি। সত্যিই আজ কত গোছগাছ আর পরিপাটি হয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে শুয়ে আছে সোহাগী। চাঁদের আলোতে কবরের ঘাসে ঝিকমিক করছে তার প্রাণোচ্ছ্বল হাসি।
মৃত্যুর মাত্র ৪দিন আগেও তনু তার ফেসবুকে লিখেছিল মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গানটি। সবাই তো সুখী হতে চায়/ তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয়না।
কলেজপড়ুয়া নাট্যশিল্পী সোহাগী জাহান তনুও হয়তো সুখী হওয়ারই স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সে সুখটুকু তার কপালে সইলো না। হায়েনাদের নখড়ে নখড়ে ক্ষত-বিক্ষত তনুর তনুমন আজ বিউগলে বিষণ্ন সুর তুলে উড়ছে মুক্তির আকাশে। গাইছে শেকল ভাঙার গান। তনু নেই। কিন্তু তার আত্মার প্রতিধ্বনিটুকু নিয়ে জ্বলে উঠুক আমাদের বিবেকী হৃদয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন
কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারণায় বাজবে এ আর রহমানের গান
আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসেরবিস্তারিত পড়ুন
উপদেষ্টা আদিলুর: পূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেবিস্তারিত পড়ুন