বিস্ময়কর ৫ আগ্নেয়গিরি পানির নিচে !

আগ্নেয়গিরির কথা ভাবলেই একটা বিষয় মাথায় আসে। অত্যাবশ্যকীয় সেই বিষয়টি হচ্ছে লাভা। আগ্নেয়গিরি থাকবে, আর তার থেকে গরম লাভা উদগিরণের ব্যাপারটা থাকবে না, এমনটাও হয় নাকি আবার? কিন্তু না। এমন কিছু আগ্নেয়গিরি রয়েছে যেগুলো উদগিরণ করে, তবে লাভা নয়, মাটির তরল। আর এই আগ্নেয়গিরির অবস্থানটাও মাটির ওপরে নয়। পানির এক্কেবারে নিচে।
গভীর সমুদ্রের কালো অন্ধকারে পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত পাঁচ আগ্নেয়গিরি। প্রকৃত অর্থে সেই আগ্নেয়গিরিগুলো জীবন্ত। যেগুলো কিনা কেবল মাটিই নয়, মাঝে মাঝে উগরে দেয় মিথেন গ্যাসও!
তবে আজকে এই শীতল আগ্নেয়গিরি নয়, বলব অন্যকিছুর কথা। আর সেই অন্যকিছুটা জড়িয়ে রয়েছে এই আগ্নেয়গিরিগুলোর সঙ্গেই। পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিগুলো যতটা না অদ্ভুত, ঠিক তেমনি আরেক বা তার চেয়ে বেশি অদ্ভুত আরেকটি বিষয়বস্তু হচ্ছে এই আগ্নেয়গিরির ভেতরে বাস করা কীটগুলো। বছরের পর বছর যাদের কেটে যায় অন্ধকারে, পানির নিচে, সেই মিথেন গ্যাসের সঙ্গে! কিন্তু কী করে এভাবে এতশত বছর বেঁচে রয়েছে এরা এই আগ্নেয়গিরিগুলোর ভেতরে? আর কী করেই বা করে চলেছে বংশবৃদ্ধি? এত দিনের অজানা এই কীটগুলো দিনকে দিন যতটা বেশি মানুষের জানার কাছাকাছি আসছে, ততটাই বেশি বাড়িয়ে তুলছে মানুষের আগ্রহ। নিজেদের নিয়ে, নিজেদের টিকে থাকাকে নিয়ে।
২০০৯ সালের কথা। আর্কটিক নেট প্রকল্পের আওতায় গবেষণা কাজের জন্যে কিছু বিজ্ঞানী সেবার রওনা হন কানাডার উত্তরে ও আলাস্কার খুব কাছে অবস্থিত বিওফোর্ট সমুদ্রের দিকে। আর সে সময়ই হঠাৎ পানিতে একটা গোলাকার জিনিসের আভাস পান তারা। যদিও খুব দ্রুতই সেটা উধাও হয়ে যায়, মনে করা হয় সেটা একটি সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরিই উদগিরণ ছিল।
মিথেন গ্যাসের চাপের কারণেই এমন উদগিরণে বাধ্য হয় আগ্নেয়গিরিগুলো- এমনটাই ধারণা সবার। তবে সেবার হালকাভাবে সবটা খেয়াল করলেও ২০১৩ সালে সবটা অনেক কাছ থেকে ভালো করে দেখার জন্যে, শীতল আগ্নেয়গিরিকে আরো ভালোভাবে জানার জন্যে সমুদ্রের নিচে, আগ্নেয়গিরির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিজ্ঞানী দল।
অক্টোবরে শুরু হয় কাজ। পানি যখন পুরোপুরি জমে যায়নি এমন একটা সময় বেছে নিয়ে পানির নিচে এক জানালার একটি যান নিয়ে ডুব দেন বিজ্ঞানীরা। চলে যান আগ্নেয়গিরির একেবারে কাছাকাছি। দেখতে পান বিশাল এক আগ্নেয়গিরিকে। যাকে একপাশ দিয়ে একবারে দেখে পুরোটা বোঝার উপায় নেই। প্রথমেই আগ্নেয়গিরিকে ভালোভাবে বুঝতে সেই এলাকার একটি বিস্তারিত মানচিত্র এঁকে নেন বিজ্ঞানীরা যন্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু পুরো মানচিত্র পাওয়ার পর অবাক হয়ে খেয়াল করেন তারা যে সেখানে আসলে একটি নয়, বরং ৩০ মিটার লম্বা মোট পাঁচটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
এবার কেবল আগ্নেয়গিরির অবস্থান নয়, এর আকৃতি ও প্রকৃতি নিয়েও জানতে আরম্ভ করেন সবাই। জানা যায় আগ্নেয়গিরির গোলাকার মুখ আর প্রতিবছর প্রায় ২৭ মিলিয়ন টন মিথেন গ্যাস উদগিরণ করার কথা। আগ্নেয়গিরির উদগীরিত মিথেনকে প্রথমটায় মাটির নিচের তেলের সঞ্চয়াগারের চাপ থেকে উৎপন্ন বলে ধারণা করা হলেও পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় সেখানে কেবল মিথেন নয়, রয়েছে অন্য সব গ্যাসও। আর এই মিথেনটাও কিন্তু তেলের চাপে উৎপন্ন কিছু নয়। বরং কোনো এক ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা তৈরি এটি। টনক নড়ে সবার। তারমানে এই আগ্নেয়গিরির অতল গহ্বরের ভেতরেই রয়েছে ছোট ছোট কোনো কীট। যেটা কিনা সাহায্য করছে আগ্নেয়গিরিকে মিথেন উদগীরণ করতে!
বলে রাখা ভালো যে, এর ভেতরে পরীক্ষা করে জানা যায় যে আগ্নেয়গিরিগুলো সোডিয়াম বাইকার্বোনেটসহ বৃষ্টি আর তুষারের মিশ্রণের মতন দেখতে একরকমের তরল পদার্থও উদগীরণ করে। আর সেই তরলকে ভালো করে দেখতে গিয়ে পাওয়া যায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু কীটকে। পানির নিচের খনিজের প্রচণ্ড চাপে এই কীটসহ আরো নানারকম পদার্থকে তরল অবস্থায় বাইরে বের করে দিতে বাধ্য হয় আগ্নেয়গিরিগুলো। আর দশটা সাধারণ আগ্নেয়গিরির মতন এই তরলও থাকে প্রচণ্ড গরম। কিন্তু সেটা কেবল ভেতরে থাকা অবধিই। বাইরে আসতে আসতেই পানির সংস্পর্শে একেবারে শীতল হয়ে পড়ে সেগুলো।
আর এভাবে শীতল অবস্থায় থাকা কিছু আগ্নেয়গিরির কীটকেই পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা। জানা যায় সাধারণত ৭ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বাকৃতির এই কীটগুলো আরেকটি পানির নিচের কীটের সমগোত্রীয়। যাদের জন্ম এই মাটির নিচের অন্ধকারে। মৃত্যুও। কেবল অসাধারণ তাপমাত্রার বাড়া-কমা সহ্য করার ক্ষমতাই নেই এদের, রয়েছে অনেক বেশি টিকে থাকার প্রবণতাও। এদের একটা দল যখন পানির শীতলতায় জমে যাওয়া পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকে, তেমনি অন্য দল তখন প্রচণ্ড গরমের ভেতরেও টিকে থাকে। এদের না আছে চোখ, না আছে খাবার হজম বা গ্রহণ করার জন্য পাকস্থলীও! মনে করা হয় গ্যাসকে নিজের ভেতরে নিয়েই জীবন নির্বাহ করে এরা।
সাধারণত সব সময় অন্ধকারে থাকাটাই অভ্যাস এদের। সেই সঙ্গে রয়েছে বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শ। তবে এসব কিছুতেই কোনো সমস্যা বোধ করে না আগ্নেয়গিরির এই কীটেরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, হয় এই কীটেরা মিথেন, অথবা হাইড্রোজেন সালফাইড গ্রহণ করছে আর উৎপন্ন করছে ইলেকট্রন। যেটা কিনা সরবরাহ করছে শক্তি।
এমনিতে আগ্নেয়গিরির সবখানে বাস করলেও এই কীটেরা আগ্নেয়গিরির কিছু স্থানে অবস্থান করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এদের সাধারণ আকৃতি কম হলেও এরা জীবনের একটা সময় গিয়ে ২ মিটার অবধি লম্বা হয়। তবে সেটা ১৭৫ থেকে ২০০ বছর পর। তবে এই পুরো গবেষণাটিতে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন বিজ্ঞানীরা যে, নতুন সব আগ্নেয়গিরিতে ততটা কীট থাকে না। যতটা না থাকে পুরোনোগুলোতে। আর একেবারে আনকোরাগুলোর ভেতরে তো কীট থাকেই না বলতে গেলে। কী করে হয় এটা? মনে করা হয় কম মিথেন গ্যাসই এটার জন্য বেশি দায়ী।
২০০০ সালে প্রকাশিত এক প্রকাশনায় বলা হয়, বর্তমানে গভীর সমুদ্রে রয়েছে প্রায় ১০০০টিরও বেশি পানির আগ্নেয়গিরি। যারা বছরের পর বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে পানির নিচের এক অসাধারণ বাস্তুসংস্থান। এক অনন্য জীব। যদিও এর থেকে উৎপন্ন মিথেনকে বিশ্বের বছরে উৎপন্ন মিথেনের ৫ শতাংশ মনে করা হয়, সেই তুলনায় এটি আমাদের প্রকৃতিকেও রাখছে অনেকটা সুন্দর আর অকৃত্রিম। কিন্তু দিনের পর দিন আর্কটিকে বাড়তে থাকা গরমের কারণে ধারণা করা হচ্ছে ক্রমেই কমে যাচ্ছে এই মাটির আগ্নেয়গিরি আর এর ভেতরে বসবাসরত কীটগুলোর সংখ্যা। যেদিকে সত্যিই নজর দেওয়া আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হলে তার আগে আমাদের জানতে হবে এই আগ্নেয়গিরি আর এর ভেতরের কীটগুলোকে আরো ভালোভাবে। যেটা কিনা আজও প্রতিনিয়ত অবিরতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে স্বৈরাচারী শাসক বললেন ট্রাম্প
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পবিস্তারিত পড়ুন

ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন

মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২২৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেবিস্তারিত পড়ুন