‘ব্লগার হত্যাকারীদের ধরছে না সরকার’: জাতিসংঘে অভিজিতের স্ত্রী (ভিডিও সহ)
জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে ব্লগার অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিয়া আহমেদ বন্যা সম্প্রতি ব্লগার হত্যা ও হামলার ঘটনায় সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন সরকার ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেফতার করেছে তাই না? না। বরং লেখার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে আইসিটি আইনের আওতায় তারা উল্টো কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। বর্তমান সরকারকে অপমান করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে কয়েক সপ্তাহ আগে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়।’
সাংবাদিকদের ওপর হামলা বিষয়ক জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ‘এন্ডিং ইমপিউনিটি ফর ক্রাইমস এগেইনস্ট জার্নালিস্টস’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্যানেলে বক্তব্য এ কথা বলেন নিহত ব্লগার অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিয়া আহমেদ বন্যা। দীপনের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার দু’দিন পর ওই প্যানেল আলোচনাটি হয়।
বন্যা বলেন, ‘ব্লগাররা যখন তাদের কাছে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে আসা হুমকির বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন, পুলিশ তখন তাদের চুপচাপ এবং নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ পরামর্শ পেয়েছেন, দেশে নিরামদ বোধ না করলে বিদেশে চলে যাওয়ার। এভাবে অপরাধীদের পরোক্ষ সমর্থন দেওয়ার জন্য তারা সামান্যও লজ্জিত বা বিব্রত না।’
প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হওয়া হামলার ঘটনাগুলোতে বিচারহীনতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন বন্যা। বক্তব্যে তিনি বলেন, ২১ শতকের এই আধুনিককালেও সাংবাদিকদের ওপর হামলাগুলো দিনে-দুপুরে আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে।
বন্যা বলেন, ‘আজ থেকে দু’দিন আগে, শনিবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জন্য একটি রক্তাক্ত দিন ছিলো। ফেব্রুয়ারির পর থেকে এটি ছিলো এ বছরের ষষ্ঠ ঘটনা, যেখানে ইসলামিক জঙ্গিরা দিনের বেলা ব্লগার বা লেখকদের, এবং এবার এক প্রকাশকের ওপর হাজারো মানুষের সামনে হামলা চালালো। এর আগে তারা আঁধারে লুকিয়ে হামলা করতো। কিন্তু হামলাকারীরা শাস্তি থেকে বারবার এতো সহজে বেঁচে যাচ্ছে যে, তারা এখন দিনের আলোতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে, এমনকি অফিস বা বাসায় ঢুকে লেখক-প্রকাশকদের কোপাতে শুরু করেছে।’
‘এ বছর এখন পর্যন্ত তারা ৫ জন লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে হত্যা করেছে এবং আহত করেছে আরো অনেককে। আমার স্বামী ড. অভিজিত রায় এবং আমাকে ঢাকায় গত ২৬ ফেবরুয়ারি ভরদুপুরে রাস্তার মাঝখানে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আমরা একটি বইয়ের উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমাদের জন্মভূমিতে গিয়েছিলাম। মাথায় ৪টি আঘাত নিয়ে আর একটি আঙ্গুল হারিয়ে আমি বেঁচে গেলেও অভিজিৎ আমার মতো ভাগ্যবান ছিলেন না; হাসপাতালে মারা যান তিনি,’ বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন বন্যা।
‘এর একমাস পর তারা আমাদের সহকর্মী লেখক, ব্লগার অনন্ত দাশকেও সকালবেলা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে মেরে ফেলে। রাস্তার মাঝে তাদের পরবর্তী শিকার হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। এমনকি তারা ব্লগার নিলয়ের বাসায় ঢুকে সহধর্মিণীর সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করতেও একবার দ্বিধা করেনি।’
‘কিন্তু সেখানেই তারা থামবে কেনো? শুধু লেখক পর্যন্ত চাপাতির কোপ থামিয়ে রেখে কী হবে, যেখানে তারা জানে তারা যা-ই করুক না কেনো, বাংলাদেশ সরকার চুপ থাকবে? তাই এবার হামলাকারীরা দু’জন প্রকাশককে টার্গেট করলো যারা এসব লেখকদের মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাকস্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বই প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।’
‘পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই গুরুতর। এই রক্তাক্ত দিনগুলো যেনো একটা নিত্য বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদের কণ্ঠ আছে এমন মানুষদের কুপিয়ে হত্যা ইসলামিক সন্ত্রাসীদের জন্য এখন একটা মাসিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘এই শনিবার তারা জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করতে সফল হয়েছে। তার অপরাধ তিনি অভিজিত রায়ের দু’টি বই প্রকাশ করেছিলেন। আরেক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল নিজ অফিসে চাপাতির একাধিক কোপ খেয়েও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহিম তখন টুটুলের সঙ্গে তার অফিসে ছিলেন। তারা দু’জনেই আহত হন। তারেক রহিমের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। একাধিক চাপাতির আঘাতের ক্ষত এবং পেটে বুলেট নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি।’
‘আমরা জানি তারা আহমেদুর রশীদ টুটুলের জন্য আবার আসবে। আমি এই অনুষ্ঠানের ঠিক আগেই তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কাঁধ, ঘাড় ও চেহারায় কোপের আঘাত পাওয়ার কারণে টুটুল শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।’
‘আপনারা যদি মনে করেন আমরা শুধু এসব ধর্মীয় মৌলবাদী হত্যাকারীদের কাছ থেকেই হামলার শিকার হচ্ছি, তবে তা আপনাদের ভুল ধারণা। পরিস্থিতির ‘উন্নতি’ করতে আমাদের নিজেদের সরকারই তথাকথিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করেছে। এই আইসিটি আইন অনুসারে যেকোনো ‘মিথ্যা’ ও ‘অশ্লীল’ প্রকাশনা, সম্প্রচার বা ওয়েবসাইট এবং ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে বা করতে পারে এমন যেকোনো যোগাযোগকে বে আইনী ঘোষণা করতে পারে। আপনারা বুঝতেই পারছেন, এগুলো খুবই অস্পষ্ট ধারণা; এদের সংজ্ঞায়িত করা খুবই কঠিন।’
‘নতুন আইসিটি আইন অনুসারে, ইন্টারনেটে ধর্মীয় সমালোচনা করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদ- হতে পারে। এবং হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকজনকে এই আইনের আওতায় গ্রেফতার করেছে।’
‘এ বছর প্রথম ৩টি হত্যাকা- হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার একেবারে চুপ হয়ে থাকে। আর চতুর্থ হত্যাকা-ের পর যখন সরকারকে কিছু বলতে চাপ দেওয়া হয়, তারা আমাদের সতর্ক করে যেনো আমরা আমাদের কী লিখছি সে বিষয়ে সচেতন থাকি। সরকার খোলাখুলিই বলেছে, নির্বাচনী রাজনীতির কারণে খুব তারা সাবধানে চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের পক্ষ নিয়ে সরকার ধর্মীয় দলগুলোর সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে পারবে না।’
‘এখন পর্যন্ত কোনো প্রকৃত খুনীই গ্রেফতার বা বিচারের সম্মুখীন হয়নি। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে, তবে তাদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা এখনও দেখিনি। এদের কেউ কেউ আবার জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে।’
বন্যা হতাশা নিয়ে বলেন, ‘আমরা এমন এক দেশে এখন বাস করি, যেখানে লেখক, ব্লগার, সাংবাদিকরা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে এখন আর নিরাপদ অনুভব করেন না। অন্য কিছু দেশের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আমি আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
‘বাংলাদেশের সাহসী সাংবাদিক, ব্লগার, লেখক, প্রকাশকরা তাদের দেশকে ভালোবাসেন এবং মাতৃভূমির অবস্থায় পরিবর্তন আনতে চান। আমরা এখানে কথা বলার মুহূর্তেও তারা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটে এসব হত্যা, হত্যার বিচারহীনতা এবং বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। হুমকির মুখে থেকেও আমরা আমাতের কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মুক্তকণ্ঠ, বাকস্বাধীনতা এবং একটি স্বাস্থ্যকর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে রক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
রবিবার যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
গ্যাস পাইপলাইনের মেরামত কাজ ও জরুরি স্থানান্তরের জন্য রবিবার দেশেরবিস্তারিত পড়ুন
জেমিনি চ্যাটবটে যুক্ত হলো মেমোরি, যে সুবিধা পাওয়া যাবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট জেমিনিতে নতুন সুবিধা যুক্ত করেছে গুগল।বিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা সিটি কলেজে ক্লাস বন্ধ রাখা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার সংঘর্ষেবিস্তারিত পড়ুন