ভিক্ষুকে সয়লাভ নোয়াখালীর শহর
নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী এখন ভিক্ষুকের শহরে পরিণত হয়েছে। যদিও এ শহরে হাতেগোনা ভিক্ষুকের আনাগোনা ছিল চিরাচরিতভাবেই। কিন্তু ইদানীং নোয়াখালীর শহর ভিক্ষুকের শহরে পরিণত হয়েছে। অতিমাত্রায় হয়ে উঠেছে অপ্রীতিকর এই অত্যাচার।
পুরো শহর জুড়ে যেন ভিক্ষুকের ঢল নেমেছে। যদিও এর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি সমাজসেবা কার্যালয় থেকে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে এখন অতি বয়স্ক নারী-পুরুষসহ সব বয়সী ভিক্ষুকে ভরপুর এই শহর।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের রুটি রুজি বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ সার্বিক অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চারদিকে অভাবের চিত্র আঁচ করা যায় সহজেই।
হাট বাজার, অলিগলি, মার্কেট, মসজিদ, হোটেল রেস্তোরাঁ,শিক্ষাঙ্গন, হাসপাতাল, যত্রতত্র রাস্তাসহ বাড়ির আঙিনাতেও শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। শারীরিকভাবে অক্ষম পঙ্গু, অন্ধ, খোঁড়া, বয়স্ক মানুষের সঙ্গে দৈহিক সক্ষম বেশিরভাগ সুস্থ মানুষকেও ভিক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে হরহামেশাই।
যারা প্রকৃতপক্ষে ভিক্ষুক নয় অথচ দেখা যাচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসকে উপলক্ষ করে আশেপাশের এলাকা ও দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জ থেকে অনেকেই ভিক্ষা করতে চলে আসছে জেলার প্রধান শহর মাইজদীতে। সচেতন মহল বলছে, এ শহরে ভিক্ষাবৃত্তি এখন একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। অনেক সময় কোন কোন পরিস্থিতিতে বাজারগুলোতে দেখা যায় ক্রেতার চাইতে ভিক্ষুকের সংখ্যাই বেশি থাকে। বাজার করতে গিয়ে কোন পণ্য কেনার আগেই ভিক্ষুকেরা ঘিরে ধরে সাহায্যের জন্য।
একেকজনের একেক অজুহাত এক এক অঙ্গভঙ্গিতে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। পারতো পক্ষে একজন ক্রেতা সকলকে খুশি করতে পারেন না, যে কারণে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় সাধারণ মানুষকে।
শহরের আলিপুর গ্রামের বাসিন্দা কর্মজীবী নারী মাহমুদা আক্তার বলেন, বাসায় যতক্ষণ থাকি কিছুক্ষণ পরপরই বাসায় ভিক্ষুকেরা দরজায় কড়া নাড়ায়, যতটুকু সম্ভব হয় সাহায্য করি। রাস্তায় বেরোলেও পথে-ঘাটে কোথাও দাঁড়ানো যায় না, ভিক্ষুকেরা সাহায্যের জন্য স্বস্তিতে দাঁড়াতেও দেয় না। গাড়িতে উঠলেও একই সমস্যা। আবার গাড়ি থেকে নামা মাত্রই স্থির হয়ে দাঁড়ানোর আগেই ভিক্ষুকেরা যেন গতিরোধ করে ধরে সাহায্যের জন্য, আসলে চিত্রটা বেসামাল হয়ে উঠেছে।
নোয়াখালী মাইজদী পৌর বাজারে বাজার করতে আসা আব্দুল্লাহ মিয়া বলেন, প্রতি সপ্তাহে এখানে বাজার করতে আসি কিন্তু বাজার করতে গিয়ে বারবারই বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। একজনকে সাহায্য দিলে অপরজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে, তার পিছনে আবার আরেকজন আসে একটু সামনে এগিয়ে গেলে আবার আরেকজন আসে এভাবে চলতেই থাকে এসব অক্ষম ভিক্ষুকসহ সক্ষম পেশাদার ভিক্ষুকেরও অত্যাচার।
লক্ষীনারায়নপুর গ্রামের আব্দুল মালেক এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন, শহরে প্রকৃত ভিক্ষুকের চেয়ে পেশাদার ভন্ড ভিক্ষুকের সংখ্যাই বেশি। যারা কাজ করতে সক্ষম অথচ প্রতিনিয়তই বাজার করতে গেলে ঘুরেফিরে ওই পেশাদার চেনা মুখগুলোই বারবার অতিষ্ঠ করে তোলে। অনেক সময় তারা চেহারা ভুলে যায়, একবার সাহায্য দিলে আবারো ঘুরে ফিরে আসে সাহায্যের জন্য। এই শহরের সর্বত্রই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি চলছে।
বাজার করতে আসা শহরের আরেক বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, প্রকৃত ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি মেনে নিলেও সুযোগ সন্ধানী ভন্ড পেশাদার ভিক্ষুকের দৌরাত্ম্য বেসামাল করে তুলছে সুস্থ পরিবেশ। এ বিষয়ে প্রশাসন ভিক্ষাবৃত্তি নিরশনে ব্যবস্থা নিলে ভালো হয়।
টোকিও ফুড এর সামনে ইফতারি কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী শিক্ষক আমজাদ হোসেন বলেন, সামান্য বাজেট নিয়ে ইফতারি কিনতে এসেছি। দুজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়ার পরেও আরো কয়েকজন এসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তাদেরকে সাহায্য দিতে না পারাটা খারাপ লাগার অনুভূতি হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে তো সেই বাজেট নেই যা ছিল তা দিয়ে ইফতারি কিনে ফেলেছি।
শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করে বেড়ানো রামগতি লক্ষ্মীপুরের আজাদনগর থেকে আসা ইসমাইল হোসেন নামের এক ভিক্ষুকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সকালে আসি রাত্রে আবার বাড়ি চলে যাই। দিনভর ভিক্ষা করে গড়ে প্রতিদিন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা কামাই হয়। বললে তো আর আপনি নিয়ে যাবেন না। আল্লাহর রহমতে চলছে মোটামুটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহর মাইজদীর পৌরবাজার, কোর্ট মসজিদ রোড বাজার, দত্তের হাট বাজার, মাইজদী বাজার (জেলরোড) বাস স্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, সুপার মার্কেট, বড় মসজিদ, কোর্ট মসজিদ, ডিসি অফিস, পৌর পার্ক, রাজমহল হোটেল, আমানিয়া হোটেল, মোঘল দরবার হোটেল, মোহাম্মদিয়া হোটেল, টোকিও ফুড, রহমানিয়া হোটেল, সুপার হোটেল, গ্র্যান্ড হোটেল, আয়োজন, আলিফ রেস্তোরাঁ ও স্কুল কলেজসহ জেলায় বিভিন্ন উপজেলা শহরেও উল্লেখ যোগ্য স্পর্ট গুলোতে ভিক্ষুকের দৌরাত্ম্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অপরদিকে কর্মসংস্থান সংকটের কারণে যেমন বেকারত্ব বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। তার উপর আছে দুর্যোগ প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারের সংখ্যা। আরো আছে অকর্মা-অলস, শ্রমবিমুখ মানুষের ভন্ডামীর রূপ ধারণ করে পেশাদার ভিক্ষুক হওয়া। অথচ ভিক্ষাবৃত্তি কোন পেশা নয়, মর্যাদাকর কোন কাজও নয়। তাই ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য সরকার ২০১০ সালে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। তবে সেই কর্মসূচি যে কোন কাজে আসেনি, সেটি শুধু কাগজে-কলমেই বন্দি রয়েছে তা আঁচ করা যায় শহরের যে কোনো স্থানের অশোভনীয় দৃষ্টিকটু চিত্রে।
বর্তমানে এমনটাও অস্বীকার করা যায় না যে, অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারণেই ভিক্ষুক বাড়ছে, অভাব-অনটনে পড়েই অনেক মানুষ ভিক্ষুকে পরিণত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় মানুষ খাদ্যের যোগান সামাল দিতে পারছে না বলেই সেই অভাবী মানুষ সাহায্যের জন্য ছুটে আসছে শহরের মানুষের কাছে। যে কারণেই এখন তা আর শোভনীয় পর্যায়ে নেই। মূলত “ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক অনাচার” এর স্থায়ী সমাধানে সরকারকেই প্রতিকার খুঁজতে হবে।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কোন ভিক্ষুক স্বেচ্ছায় কর্মসংস্থানের সুযোগ চাইলে, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে আমরা তাদেরকে সরকারি তহবিল থেকে এককালীন সহযোগিতা করে ছোট্ট পরিসরে হলেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এছাড়াও ভিক্ষুক পুনর্বাসনে আরো নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে সরকার। আশা করছি তা বাস্তবায়ন হলে ভিক্ষুকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে তার ফলে ভিক্ষাবৃত্তি কমে আসবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
নোয়াখালীতে অস্ত্র ঠেকিয়ে কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগ
নোয়াখালীর সদর উপজেলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে সতের বছর বয়সী এক কিশোরীকেবিস্তারিত পড়ুন
নোয়াখালীতে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ
পেট্রলবোমা হামলার মামলায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাবিস্তারিত পড়ুন
নোয়াখালীতে মাজারের খাদেমকে গলা কেটে হত্যা
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলায় সোনা মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে ওবিস্তারিত পড়ুন