ভয়েস রেকর্ডে যা বলে গেছে নিহত কল্যাণপুরের জঙ্গিরা
কল্যাণপুরের নিহত জঙ্গিদের ভয়েস রেকর্ড পাওয়া গেছে ঘটনাস্থলের জব্দকৃত বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে। এর আগে জঙ্গিদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি পাওয়া যায়। ছবির সঙ্গে ভয়েস রেকর্ডগুলো জঙ্গিরা ডিলিট করে দিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে বের করে আনেন সেই ভয়েস রেকর্ডগুলো। ভয়েস রেকর্ডে জঙ্গিরা তাদের বাবা-মাকে ভুল পথ ছেড়ে জিহাদের পথে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলো।
এ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষদের জিহাদের পথে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বেশকিছু বার্তা তুলে ধরেছে ৯ জঙ্গি। এই বার্তা এখন বিশ্লেষণ করছে পুলিশ। ৯ জঙ্গির কোনো ভিডিও রেকর্ড আছে কিনা তা জানতে জব্দকৃত নানা ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। জব্দকৃত অডিও রেকর্ড জঙ্গিরা বিদেশে তাদের কুশীলবদের কাছে পাঠিয়েছে বলে ধারণা পুলিশের তদন্তকারীদের। জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতগুলো সেলফোনের কল ইনকামিং ও আউটগোয়িং হয়েছে বিষয়টিও জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
সূত্রে জানা যায়, ৯ জঙ্গি যখন বুঝতে পারেন তারা আস্তানা থেকে পালাতে পারবেন না, মৃত্যু অবধারিত তখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে তারা আস্তানাতেই জামাত করে ফজরের নামাজ আদায় করেন। কালো পাজামা-পাঞ্জাবির আগে অথবা পরে তারা অস্ত্রহাতে ছবি তোলে ও প্রত্যেকে আলাদা করে নিজেদের ভয়েস রেকর্ড করেন।
কাউন্টার পুলিশের টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা গুলশানে জঙ্গি হামলার পর নিহত ৫ জঙ্গির হাস্যোজ্জ্বল ছবি আর কল্যাণপুর থেকে পাওয়া জঙ্গিদের ছবির পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষণ করে দেখছেন। দুই ঘটনায় প্রকাশিত ছবির মিল-অমিলও খুঁজছেন। তারা বলছেন, জঙ্গিদের অস্ত্র হাতে হাসিমাখা ছবিতেও জঙ্গিবাদের কিছু বার্তা রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ৯ জঙ্গি জেএমবি সদস্য হলেও নিজেদের আইএস মুজাহিদ প্রমাণ করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু কর্মকান্ড- তাদের করতে হচ্ছে। তার প্রথম কাজ হলো কোনো কিলিং অপারেশনে যাওয়ার আগেই অপারেশন স্কোয়াডকে কালো পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পেছনে আইএসের পতাকা দিয়ে ছবি তুলতে হবে। গত বছরের শেষ দিক থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু করে জঙ্গিরা। যার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে গুলশানে জঙ্গি হামলা থেকে।
কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলের ১০০-১৫০ মিটারের মধ্যে আরও ২টি জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়। ওই দুটি আস্তানায়ও যে জঙ্গিরা ছিল তা নিশ্চিত হয়েছে কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে সেখানে কোনো জঙ্গি পায়নি। তাদের ধারণা, ওই ২টি আস্তানার জঙ্গিরাও তাজ মঞ্জিলে আসে অভিযানের কয়েক ঘণ্টা আগে। সেখানে চূড়ান্ত অপারেশন ছক তৈরি করতেই অন্য আস্তানার জঙ্গিদের তলব করা হয়েছিল। এদিকে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পুলিশ কম্পিউটারে স্কেচ করা একটি ছবি পেয়েছে। যেটাকে জঙ্গিরা বেহেশত যাওয়ার রোডম্যাপ হিসেবেই বলছে।
নতুন জঙ্গিদের প্রশিক্ষণকালে তাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদে ধাবিত করতে এই স্কেচ দেখানো হতো বলে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি হাসান। সে পুলিশকে বলেছে, নতুনদের মগজ ধোলাই করতে এই স্কেচ গুরুত্বটপূর্ণ ভূমিকা রাখত। জঙ্গি হামলার মাধ্যমে বিদেশি, পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অন্য ধর্মের মানুষদের মারলে বেহেশতের টিকিট পাওয়া যে সহজ হবে তা বোঝানো হতো নতুন জঙ্গিদের। নতুন আসা জঙ্গিদের ইসলামের নানা অপব্যাখ্যাও দেওয়া হতো বলে হাসান পুলিশকে জানিয়েছে। তবে এই ব্যাখ্যাকে হাসান অপব্যাখ্যা বলতে নারাজি প্রকাশ করেছে পুলিশের কাছে।
ওদিকে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় মিরপুর থানার পরিদর্শক শাহজালাল আলম বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা করেছেন তাতে উল্লেখ করেছেন, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় তামিম চৌধুরী ছাড়াও রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জোনায়েদ খান, বাদল ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ নামে জঙ্গি নেতারা নিয়মিত যাতায়াত করত। তারা ছিল জঙ্গিদের মাথা।
এদিকে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় টার্গেট কিলিংয়ের মূল পরিকল্পনাকারী একজন গোয়েন্দা নজরে রয়েছে। তার বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। অন্তত ৩০টি হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তার যোগসূত্র পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গুলশানের হামলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ ছাড়া কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর বাড়িতে যে ১১ জঙ্গি অবস্থান করছিল তাদের ব্যাপারে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়েছে। একজনকে আহতাবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে; একজন পালিয়েছে। সেখানে অবস্থান করা ১১ জনের সবাই ওই বাড়ির বাসিন্দা ছিল না। তবে ওই আস্তানায় মাঠ পর্যায়ের জঙ্গিদের আরও ৯ পরামর্শদাতা, অর্থদাতা ও প্রশিক্ষক আসা-যাওয়া করত।
কল্যাণপুরের ‘জাহাজ বিল্ডিংয়ের’ ১০০ গজের মধ্যে আরও দুটি আস্তানায় তাদের যাতায়াত ছিল। ওই দুই আস্তানায় এরই মধ্যে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
সূত্রে আরও জানা যায়, কল্যাণপুরের আস্তানা পুলিশ ঘেরাও করার পর এক পর্যায়ে জঙ্গিরা তাদের ফ্ল্যাটে থাকা বেশ কিছু কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে। পুড়িয়ে ফেলা কাগজপত্রের মধ্যে জঙ্গিদের কয়েকজনের সনদ ছিল।
এ সময় তারা চিৎকার করছিল আর বলছিল, ‘সারাদেশের শিক্ষার্থীরা, তোমরা যে বিদ্যা অর্জন করছ তা চাকর হওয়ার জন্য। তোমরা জিহাদের পথে আস। প্রাচুর্যের আলো ফেলে তোমরা জিহাদে অংশগ্রহণ কর।’
এ ছাড়া জঙ্গিরা তাদের অভিভাবকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখে। সেখানে বলা হয়, ‘তোমরা ভুল পথে হাঁটছ। আমরা সঠিক পথে রয়েছি। তোমরা দাওয়াতের পথে এসো।’
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, শুধু গুলশান ও কল্যাণপুরের ঘটনায় জড়িতরা আইএস মতাদর্শী সেজে ছবি তোলে রাখেনি, এর আগে হোসেনী দালানে হামলার ঘটনায় জড়িতরাও কথিত ‘আইএস’ সেজে ছবি তুলেছিল। তারা টাঙ্গাইলের মধুপুর জঙ্গলে ছবি তুলেছিল। এ ছাড়া গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কল্যাণপুরের বাসা থেকে পলাতক ইকবাল জেএমবির একজন বড় মাপের নেতা। বাসা থেকে পালানোর সময় তার কাছে একটি একে-২২ রাইফেল ছিল। সব মিলিয়ে জেএমবির ১০-১২ জন শীর্ষ নেতা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তাদের কাছে অন্তত ৪-৫টি একে-২২ রাইফেল রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
তবে এরই মধ্যে গাইবান্ধার একজন শীর্ষ জেএমবি নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। গোয়েন্দাদের মতে, পলাতক জঙ্গিরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র বলছে, এর আগেও বিভিন্ন সময় জঙ্গি আস্তানা থেকে যেসব জঙ্গি পালিয়েছিল তারা অনেক নথিপত্র বাসায় রেখে গেলেও একে-২২ নিয়ে যায়।
এর আগে রায়হান কবির ওরফে তারেক নামে এক জেএমবি নেতার আস্তানায় তিন দফা অভিযান চালানোর পরও তাকে অস্ত্রসহ ধরা যায়নি।
জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে খোঁজ রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘জাহাজ বিল্ডিংয়ে’ যে ১১ জন জঙ্গি অবস্থান করছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন শেওড়াপাড়ায় একটি আস্তানায় কিছু দিন ছিল।
এ ছাড়া মিরপুর এলাকায় জঙ্গিদের আরও কয়েকটি আস্তানা রয়েছে। কেন মিরপুর এলাকায় এত জঙ্গি আস্তানা এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, উত্তরাঞ্চল থেকে অনেক জঙ্গি গাড়িতে এসে গাবতলীতে নামে। তাই তাদের জন্য গাবতলীর আশপাশ এলাকায় বাসা ভাড়া নেয় সঙ্গীরা।
এ ছাড়া মিরপুর এলাকায় অনেক ঘিঞ্জি পরিবেশ রয়েছে। এমনকি ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় সেখানে তুলনামূলকভাবে বাসা ভাড়া কম। তাই জঙ্গিদের অনেকে মিরপুরকে বেছে নেয়। এর আগে মিরপুরের শাহআলী, শেওড়াপাড়া ও মিরপুর-১ নম্বরে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাওয়া গেছে।
তবে মিরপুরের বাইরেও অনেক এলাকায় জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। ২০ জুলাই পুলিশের কাছে প্রথম তথ্য যায়, কল্যাণপুরে একটি বড় ধরনের জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। এরপরই এই তথ্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হয়। একাধিক ব্লক রেইড দিয়েও মূল জঙ্গি আস্তানার সন্ধান প্রথমে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত ২৫ জুলাই ব্লক রেইড দেওয়ার পরপরই জঙ্গি আস্তানার খোঁজ মেলে।
টার্গেট করা তরুণদের যারা দলে ভেড়াচ্ছে তারা নানা কৌশল নেয়। একই জায়গায় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের অনেক জঙ্গিকে বাসার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাদের সব আস্তানা সম্পর্কেও জানানো হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জঙ্গিরা যে কোনো অপারেশনের পর তাদের ছবি পাঠায় তামিম চৌধুরীর কাছে। তার হাত ধরে তা দেশের বাইরে যায়। কল্যাণপুরের ঘটনায় যে দশজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে তার মধ্যে কানাডাপ্রবাসী এই তামিম চৌধুরী রয়েছে।
২০১৩ সালে কানাডা থেকে দেশে ফিরে উগ্রবাদে জড়ায় সে। এ ছাড়া নারী জঙ্গিদের ব্যাপারে তথ্য নিতে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করেছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ধর্মের যেসব ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয় এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত জঙ্গি আস্তানা থেকে পাওয়া গেছে। জঙ্গিদের ভাষায়, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা ‘বেহেশতে যাওয়ার গাইডলাইন’ তৈরি করেছে। এসব গাইডলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরা তরুণদের মগজধোলাই করছে।
এর আগে রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিযান শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দাবি করেছেন, হতাহত জঙ্গিরা ও গুলশানের হামলায় অংশগ্রহণকারীরা একই গ্রুপের সদস্য।
কল্যাণপুরের অভিযানের পর পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছেন, কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত ৯ জন জেএমবি সদস্য। এরা নিজেদের আইএস বলে দাবি করে কিন্তু এরা সবাই আসলে এ দেশেরই জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
রবিবার যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
গ্যাস পাইপলাইনের মেরামত কাজ ও জরুরি স্থানান্তরের জন্য রবিবার দেশেরবিস্তারিত পড়ুন
জেমিনি চ্যাটবটে যুক্ত হলো মেমোরি, যে সুবিধা পাওয়া যাবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট জেমিনিতে নতুন সুবিধা যুক্ত করেছে গুগল।বিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা সিটি কলেজে ক্লাস বন্ধ রাখা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার সংঘর্ষেবিস্তারিত পড়ুন