‘মগের মুল্লুকে’ মুসলিম গণহত্যা
মিয়ানমারে চলছে মুসলিম নিধন। দেশটি থেকে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার পাঁয়তারা চলছে। জাতিসঙ্ঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও বলেছেন, মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে চায়। জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ম্যাককিসিক বলেন, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী নির্মমভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর এ রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হামলার পর ওই অঞ্চলে ব্যাপক সেনা অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমার। ‘উগ্রবাদী’ দমনের নামে সেনাবাহিনী সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এক দিনেই ৩৪ রোহিঙ্গাকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এ ছাড়া ধর্ষণ, লুটপাট ও শিশুদের আগুনে নিক্ষেপের মতো ঘটনাও ঘটছে। মংডু শহর ও আশেপাশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ৪০ হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে সৈন্যরা। হেলিকপ্টার গানশিপ থেকেও রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। অনেক নারী ও তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর সৈন্যরা হত্যা করেছে। ২০১২ সাল থেকে দেশটিতে চলছে রোহিঙ্গাবিরোধী আগ্রাসন। তবে এবার রোহিঙ্গানিধনে সরাসরি সেনাবাহিনী নেমেছে। ম্যাককিসিক বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনী পুরুষদের গুলি করে হত্যা, শিশুদের জবাই, নারীদের ধর্ষণ ছাড়াও লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং অনেককে নদী পার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছেÑ দেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়িত করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর খোদ জাতিসঙ্ঘের একজন কর্মকর্তার পক্ষ থেকেই এবার মিয়ানমারের বর্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিষয় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো। একবিংশ শতাব্দীর এ সভ্য যুগে এসেও এমন অসভ্য মগের মুল্লুকের বর্বরতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অবসানে কি জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ববাসীর কিছুই করণীয় নেই?
মিয়ানমারের আগের নাম ছিল বার্মা। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এখন রোহিঙ্গারা বার্মার নাগরিক হিসেবে পরিচিত ছিল। তারাও তখন অন্য নাগরিকদের মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছিল। কিন্তু জেনারেল নেউইন ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেন। এতে তারা নিজেদের দেশেই যেন পরবাসীতে পরিণত হলো। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, রোহিঙ্গারা কয়েক শ’ বছর ধরে উত্তর রাখাইন রাজ্যে বাস করে আসছে। হঠাৎ করে তারা সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আরব বণিকেরা আকিয়াব বন্দর ও এর আশপাশের এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। প্রাকৃতিক সম্পদ, উর্বর ভূমি ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণেই মূলত এই বণিক সম্প্রদায় ওই এলাকার প্রতি আকৃষ্ট হয়। বিয়ে করে তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। একসময় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাসিন্দারা উর্বর ভূমি ও জীবিকার টানে তদানীন্তন আরাকান অর্থাৎ বর্তমানের রাখাইন রাজ্যে আসতে থাকে। উত্তর রাখাইনের প্রাচীন নাম ছিল রোহাং। তাই সেখানকার অধিবাসীদের বলা হতো রোহিঙ্গা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বার্মায় স্বল্প সময়ের জন্য গণতন্ত্র বলবৎ ছিল। এ ছাড়া পুরো সময় ধরে বার্মা তথা আজকের মিয়ানমার সামরিক স্বৈরাচারের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে। সামরিক শাসকেরা বহির্বিশ্ব থেকে ছিলেন বিচ্ছিন্ন। তাই বাইরের দুনিয়া যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে এগিয়ে গেছে, মিয়ানমারে তার ছোঁয়া লাগেনি। নেউইনের দীর্ঘ শাসন এবং পরেও সামরিক শাসকদের আমলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তথা মুসলমানরা মারাত্মকভাবে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সব রোহিঙ্গা পরিবারকে একঘরে করে রেখে তাদের চলাচল ও জীবন যাপনের ওপর কঠোর শর্তারোপ করা হয়। এমনকি নির্যাতন ও কড়াকড়ির কারণে রোহিঙ্গারা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতেও তাদের সামরিক ক্যাম্পের অনুমতি নিতে হয়। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিয়ের অনুমতির জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। তবে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও বিয়ের অনুমতি পাওয়া যায় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রাইমারি ও মাধ্যমিকপর্যায়ের অনেক স্কুল বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষকের অভাবে। রোহিঙ্গারা ধর্মীয় শিক্ষার জন্য নিজেদের উদ্যোগে কিছু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে চালু রেখেছে। গোটা মিয়ানমারে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের উচ্চ শিক্ষার হার অথবা সরকারি চাকরি একেবারেই নগণ্য। রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। নিজেদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য, গবাদিপশু, মাছ ইত্যাদি পর্যন্ত সরাসরি হাটবাজারে বিক্রি করতে পারে না। এক অদ্ভুত নিয়মে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ সঙ্কটে পড়ে। কৃষিকাজেও তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। পরিকল্পিতভাবে গোটা জাতিকে ধ্বংস করার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকেরা ‘রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে আগত’ বলে যে কথা বলছে, তা ডাহা মিথ্যা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, গৌড়ের সুলতানদের সহযোগিতায় আরাকানের সম্রাট নরমেখলা ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পর ১৪৩০ সালে আরাকানের সিংহাসন ফেরত পান। পরবর্তীকালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আরাকানি রাজারা বাঙালি ও মুসলমানদের আরাকানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেন। সুতরাং আরাকানের রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই বহিরাগত নয়। তারা বার্মা স্বাধীন হওয়ার বহু আগে থেকেই সেখানকার অধিবাসী। বরং ১৭৮৫ সালে আরাকান দখলকারী বর্মিরাই হলো সেখানে নবাগত। বার্মার প্রথম প্রেসিডেন্ট উনু রোহিঙ্গাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বার্মার প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালে। রোহিঙ্গারা সেই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। ১৯৫১ সালে তারা আরাকানের অধিবাসী হিসেবে পরিচয়পত্র পেয়েছে। ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী উ বা রোহিঙ্গাদের ‘আরাকানের জাতিগোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করেন। স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও সোয়ে আইক ১৯৪৭ সালে বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই।’ কিন্তু পরে সামরিক সরকার ‘অপারেশন ড্রাগন কিং’ নামে রোহিঙ্গা মুসলিম বিতাড়ন কর্মসূচি শুরু করে এবং এর ধারাবাহিকতায় শাসকেরা সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জনিয়েছে, চলমান হামলায় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের এক হাজারেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। গত অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনী সেখানে অভিযানের নামে নৃশংসতা চালাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, নভেম্বরের ১০ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যচ্ছে, রোহিঙ্গাদের পাঁচটি গ্রামের ৮২০টি কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। সেনা অভিযানে সব মিলিয়ে এক হাজার ২৫০টি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। সংস্থাটি রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ দেয়ার দাবি জানালেও বর্মি প্রশাসন সেখানে কোনো সাংবাদিক বা ত্রাণকর্মীকেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আলজাজিরা ২০১৫ সালে আট মাস তদন্ত করে মিয়ানমারে গণহত্যার শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটি ল স্কুলের মূল্যায়নে এ তথ্য উঠে আসে। মিয়ানমারের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনাবাহিনী মিলেই এ গণহত্যা চালাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসে রাখাইনের সরকারি কর্মকর্তা কর্নেল তেইন লিন সরকারি পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা বসতির মধ্যে চীন-মিয়ানমার পাইপ লাইন তৈরি হচ্ছে বলে জানান। সেই পরিকল্পনার নাম দিয়ে ওই এলাকায় তাদের ভাষায় ‘অবৈধ’ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এ তালিকায় আছে আড়াই হাজার ঘরবাড়ি, ৬০০ দোকান এবং বহু মসজিদ ও ৩০টি বিদ্যালয়। মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে এখন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
ইতোমধ্যে শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া অং সান সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠেছে। মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে আর সরকারের শীর্ষব্যক্তি অং সান সু চি নীরবে তা সমর্থন করে চলেছেন। ‘অহিংসা পরমধর্ম’, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ বলে যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রচার করে, তারাই আজকে গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করছে। জোরপূর্বক নাগরিক অধিকার হরণ করে, গণহত্যা চালিয়ে তাদের ধর্মীয় বাণীকে নিজেরাই মিথ্যা বলে প্রমাণ করছে। আজ বিশ্ববিবেককে জাগ্রত হতে হবে। গণহত্যা চালিয়ে যারা মানবতাকে বিপন্ন করছে- সেই অসভ্য বর্বর সরকার ভিক্ষু ও বর্বর দেশটির পৈশাচিক নরহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। অবিলম্বে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ আরোপসহ তাদেরকে বিশ্ব থেকে আবার একঘরে করে তাদের বেনজির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধে বাধ্য করা এখন জরুরি। আর অসহায় শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান ও তাদের পুনর্বাসনে শুধু বাংলাদেশ নয়, জাতিসঙ্ঘ এবং এর সদস্য দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে অবশ্যই।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২২৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেবিস্তারিত পড়ুন
ইসরাইলি হামলায় আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর তান্ডবে প্রাণ গেছে আরও ৩৮বিস্তারিত পড়ুন