ময়মনসিংহের সম্ভাবনাময়ী উজ্জল এক নক্ষত্র বাউল শিল্পী ফেরদৌস: ফাঁকি দিতেন বাবা মাকে, পিটুনিও খেতেন
বাংলা আর বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রাণের সাথে মিশে আছে বাউল সংগীত। বাউল গান কার না ভালো লাগে। আধুনিক যন্ত্র প্রযুক্তির এ যুগেও গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে, রাস্তার কোনে, চায়ের দোকানে ব্যাপক শুনতে পাওয়া যায় এ গান। বাউল গান যেমন জনপ্রিয় তেমনি একজন বাউল শিল্পিও। কথা বলেছিলাম এ প্রজন্মের একজন জনপ্রিয় বাউল শিল্পীর সাথে। নাম তার ফেরদৌস বাউল। ময়মনসিংহ শহরে বেড়ে উঠেছেন, কাটিয়েছেন জীবনের আনন্দময় সময়।
১. আপনি কত সাল থেকে সংগীত অঙ্গনের সাথে জড়িত ?
আমি প্রায় ১৯ বছর যাবৎ গান করি। ছোট বেলা থেকেই আমার লোক গানের প্রতি একটা দূর্বলতা ছিল। আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার, চরনিলক্ষিয়া গ্রাম। আমার গ্রামে প্রায় সব সময় বসত পালা গান, কিচ্ছা গান, গাজির পালা গান,আমি রাত জেগে শুনতাম। মা বাবা অনেক কড়া শাসন করত। কি আর করা মন তো আর ঘরে থাকেনা, ঢোল, মন্দিরা, দোতারার সুর বেজে উঠলেই মা বাবাকে ফাকি দিয়ে চলে যাইতাম গান শুনতে। আর গান শেষে বাড়িতে আসতেই মা বাবা দিতেন পিটুনি। স্মৃতিগুলো আজো মনে পড়ে যায়।
২. কার কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন সংগীত বিষয়ে ?
আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন আমার পাশের বাড়ির নুরইসলাম ভাইয়ের কাছে প্রথম তালিম করি। প্রাইমারি স্কুল শেষ করে ভর্তি হই। লেতু মন্ডল হাই স্কুলে। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমাদের গান শিখাতেন মনির বাউল নামে এক উস্তাদ। ঐ স্কুলে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ি আমি। তারপরে মা বাবা ভর্তি করে দিলেন ময়মনসিংহের খুব নাম করা মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে।
তখন উক্ত স্কুলে প্রতি বৃহস্রপতিবার ও শুক্রবার উস্তাদ আঃ সালাম স্যারের কাছে মেট্রিক পাশ করা পর্যন্ত তালিম করি। মেট্রিক পাশ করার পরে কলেজে পড়ার সময় ময়মনসিংহের খুব নাম করা সংগীত প্রশিক্ষক, শ্রদ্ধ্যেয় উস্তাদ ফারুখ হাসান নিখু স্যারের কাছে তালিম করি। বর্তমানে উনার কাছেই তালিম করি। নিখু স্যার প্রথম আমাকে সারেগামা শিখাতেন। আমি বলতাম স্যার আমার লোকগান খুব ভাল লাগে আমি লোক গান শিখতে চাই। কিন্তু উস্তাদজি আমাকে বলতেন তুমি কিছু নজরুল/রবীন্দ্র সংগীত শিখতে থাক আর পাসাপাসি লোকগান শিখ, আমি তাই করলাম। বর্তমানে নজরুল / রবীন্দ্রসংগীত আগের মত নিয়মিত গাই না মাঝে মাঝে গাই। এখন শুধু লোক গানেই গাই এবং শিখি।
আমি ২০০৯ সালে একটি লোক দল গঠন করি যার নাম ( রঙের বাউল ) দলে মিউজিশিয়ানসহ আমরা ৮ জন। আমি নিজে গান করি।
৩. আপনার সুদীর্ঘ্য সংগীত জীবনের কয়েকটি জনপ্রিয় বাউল গান এর কথা বলুন যেগুলো শুনে শ্রোতাগণ অনেক আনন্দ পেয়েছে ?
কবি জালাল খাঁ এর ‘চোরেরা খায় কুরমা পোলাও সাধু ঘোরে ধারে ধারে
তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবা দিন দুনিয়ার ব্যবহারে।’
কুদ্দুছ বয়াতীর গান – ‘আমার জমুনার জল দেখতে কালো সান করিতে লাগে ভাল যৌবন মিশিয়া গেল জলে।’
শাহ আঃ করিম : ‘গ্রামের নৌজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউল গান আর মুর্শিদী গাইতাম আগেকি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
শাহ আঃ করিম: ‘কালার প্রেমে কেন পাগল হইলাম
সহে না জ্বালা আমি কুলবালা
কলঙ্কের ডালা মাথায় লইলাম……।
ইত্যাদি।’
এছাড়াও আমার নিজের লেখা সুরে কিছু গান আছে তার মধ্যে – ‘অনন্ত আহবানে আমি অসীমের পানে ফিরাইওনা প্রভু মোরে নিয়তির টানে
দিবানিশি বিজনে হইয়া ফানাফিল্লাহ্।।’
‘আমি তো আর আমার মাঝে নাই
আমি আমায় পাই না খোজে
পাই শুধু তোদেরই মাঝে
রঙ্গিন সাজে প্রেম লাজে
তোদের মাঝে নিত্য বেড়াই।।’
৪.আপনি বাউল সংগীত ছাড়া আর কোন ধরনের গান কি করে থাকেন ?
আমি সাধারণত–লালন গীতি , শাহ আঃ করিম , জালালগীতি, কদ্দুছ বয়াতী , ময়মনসিংহের আঞ্চলিক গান, ভব সালাম বাউল , তাদের গান করি।পাশাপাশি নিজের লেখা কিছু গান করি।
তবে সচেতন মুলক গান করতে আমার বেশি ভাল লাগে যেমন, নারী দিবস, শিশু দিবস, ওয়ার্ল্ড ভিশন আয়োজন করে ভ্রাম্মমান বাউল গান তাতে অংশ গ্রহন করি। গানের কথায় জীবনের প্রেক্ষিতে প্রসঙ্গ,গ্রামীন ঐতিহ্য, বাস্তবতা,সংকট,ও সমস্যার খন্ড চিত্র তুলে ধরে গান করতে আমার ভাল লাগে।সরকারের তথ্য অফিস বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে, মাদক বিরুধী, বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে আমার জনগনের সচেতনতা বিকাশ।
৫.সংগীত জীবনে বিনোদনের আর কোন কোন মাধ্যমে গান করেছেন ?
সংগীত জীবনে আমি ২০১৪ জাতীয় শিশু মেলায় অংশ গ্রহন , বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি আয়োজিত ঢাকা বিভাগীয় লোক উৎসবে অংশগ্রহন,বাংলাদেশী আইডলে ৫ম রাউন্ড পর্যন্ত অংশ গ্রহন, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে অংশগ্রহন,বিটিভিতে ( মেঠুসুর ) অনুষ্ঠানে কদ্দুছ বয়তীর সাথে অংশ গ্রহন। বৈশাখী টিভিতে ময়মনসিংহের ব্যঙের বিয়ার গীতে অংশগ্রহন ইত্যাদি।
৬.মঞ্চে গান করার সময় দর্শকগন যখন প্রচন্ড উল্লাসে মেতে উঠে, আপনার তখন কেমন লাগে ?
আসলেই আওল বাউলের দেশ আমার এই বাংলাদেশ।এই জন্মেছে অনেক সাধক যা গাইলে শেষ হবেনা।সবারই তো রক্তে লোকগানের গন্ধ জরিয়ে আছে। দর্শক যখন আনন্দ করে নাচে তখন মনটা ভরে যায়, আমি সন্তানের বাবা হয়ে যতটুকু আনন্দিত হয়েছিলাম, ততটুকুই আনন্দিত হই আমি গান গাইলে দর্শক আনন্দিত হলে। আমি সংগীতের সেবক মাত্র সাধক / মহাজনদের গান গাইতে চেষ্টা করি। লোক গানের কিংবতন্তি কদ্দুছ বয়াতির সহযোগীতা ও প্রেরনার অধ্যায় একজন রঙের বাউল খ্যাতির পেছনে বড় একটা অবদান
৭. আমাদের দেশে বাউল সংগীতের প্রতি মানুষের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে, এর কারন কি বলতে পারেন ?
লোকগানেরর প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ার কারন হচ্ছে – বর্তমানে ছেলেমেয়েরা লোকগানের। সুর কে বিকৃত করছে,একটি গানকেই ভিন্ন ভিন্ন গায়ক / গায়িকারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গাইছে, ফলে দর্শকরা গান শুনার রুচি কমে গেছে। লোকগান হলো বাপপ দাদার আমলের গান। সাধকরা যে ভাবে সুর করেছেন ও গেয়েছেন। সেইভাবে গাইতে পারছেনা। গান ছাড়া মানুষের প্রান নেই সবার মনেই গান বাজে। আজকাল ছেলে মেয়েরা গুরুমুখী হয় খুব কম। ফলে অল্প শিখেই নিজেকে বিশাল কিছু মনে করে। আসলে সংগীত শিখার কোন শেষ নেই।আর। আমাদের দেশে সাধারণত দোতারা , একতারা,মন্দিরা,ঢোল, বাশী ইত্যাদি এই সব দেশীয় যন্ত্র আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কারন সবাই গান করে ডিজিটাল ইলেকট্রিক যন্ত্র দিয়ে । তাই দেশীয় যন্ত্র বাজেনা লোকগানও শুনে না।
8. বাউল জীবনের স্মৃতিময় এর কথা বলুন যা আজো আপনার মনে পড়ে যায় :
একবার গান গাইতে গেলাম টাঙ্গাইল।বিশাল বড় অনুষ্ঠান, দেশের বড় বড় নাম করা শিল্পীদের মধ্যে আমি নতুন,মনে মনে ভয় পাচ্ছি।তখন মননে হলো টাইঙ্গাই অন্য জেলা হলেও এটা তো আমাদের ময়মনসিংহের অংশ । মনে শক্তি পাইলাম গান গাইলাম প্রান খোলে। দর্শক শ্রোতাদের সাথে মিলেমিশে গিয়ে অনুষ্ঠান জমিয়ে ফেললাম। গান শেষে মঞ্চে উঠে আসলেন জেলা প্রশাসক। তিনি আমাকে টাইটেল দিলেন রঙের বাউল।সেই থেকে ফেরদৌস হয়ে গেল রঙের বাউল। আর রঙের বাউল নাম দিয়ে আমি লোক দল প্রতিষ্ঠা করেছি।
৯. আপনি সংগীত ছাড়া আর কিছু কি করেন ?
গানের পাশাপাশি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এস এস। ফাইনাল সেমিস্টারে পড়তেছি। যদি সুযোগ পাই গান গাওয়ার পাশাপাশি চাকরি করব।যদি পাই।
১০. আপনার জীবনের একটি স্বপ্নের কথা বলুন
এই দুনিয়াতে সবাই সপ্ন দেখে, আমিও দেখি। আমার সপ্ন হল বাংলাদেশের লোকসংগীতকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে, আমি সপ্ন দেখি সচেতন মুলক গান করে সমাজের কুসংস্কার দুর করে একটি ভাল সমাজ গঠন করতে। আমি সপ্ন দেখি আমাদের দেশের অনেক সাধক আছে তাদের গান গুলো নিজে গেয়ে এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছে তুলে দিতে যেন আমাদের দেশের লোকগান আজীবন বেঁচে থাকে।আমি সপ্ন দেখি আমার প্রতিষ্ঠিত লোক দল ( রঙের বাউল ) কে একদিন রঙের বাউল ফাউন্ডেশন বানাব।তার কাজ হবে সমাজে অসহায়, নির্যাতিত, অবহেলিত মানুষের পাশে দাড়ানো। যে ছেলে মেয়েরা টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারবে না তাদের আর্থিক সহযোগীতা করা।
১১. সংগীত একজন মানুষের জীবনে এমনকি একটি সমাজ পরিবর্তনে কিভাবে অবদান রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন
যারা সংগীত সাধনা করে তারা কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে আমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার পাশাপাশি আলাদা একটি গুন থাকা দরকার। যেমনঃ নাচ, আবৃতি, অভিনয়, উপস্থাপনা, গান শিখা, কৌতুক, অভিনেতা, অভিনেত্রি, খেলাধুলা, ইত্যাদি কোন না কোন একটি যদি আমরা শিখাতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ পরিবর্তন হওয়া সম্ভব।সবাই যখন সম্মানীত হয় তারা ধরে রাখার জন্য খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।সমাজের যত সমস্যা আছে তা গানের ভাষায় যদি দর্শকদের কাছে প্রকাশ করা যায় তাহলে সমাজ অনেকটা পরিবর্তন হবে।
১২. আপনার গান শুনেন যারা অর্থাৎ আপনার ফেনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন :
আমি সব সময় বলে থাকি – আমি তো আমার নই আমি সবার মাঝে বাচঁতে চাই যতদিন এই পৃথিবী আছে। আমি শুধু দিতেই জন্মেছি,আর বিনিময়ে পাচ্ছি সবার ভালবাসা। রাস্তায় যখন হেটে যাই দুর থেকে কানে আওয়াজ আসে আমাদের রঙের বাউল ফেরদৌস যাচ্ছে, তখন আনন্দে মনটা ভরে যায়। আমার ব্যক্তিগত কোন কাজে যদি কোথাও যাই আমার কাজটি সবাই সবার আগে করে দেয়। আর বলে আপনি আমাদের দেশের সম্পদ। মনে মনে ভাবি বন্ধুরা তোমাদের ভালবাসা পাই বলেই তো বেঁচে আছি আল্লাহর রহমতে।
“”বাউল বেশে আওলা কেশে, একতারাটার সুরে মিশে
দুঃখের মাঝে সুখ খোজে পাই,
রঙের বাউল নামটি ধরে দিলাম সবি উজার করে,
মরন কালে রেখো স্বরন, পরকালে শান্তি যে পাই।
আমি তো আর আমার মাঝে নাই।
আমি আমায় পাইনা খোজে পাই শুধু তোদেরই মাঝে, রঙ্গিন সাজে প্রেমের লাজে তোদের মাঝে নিত্য বেড়াই।
আমার গানের ভক্ত, বন্ধু, শ্রদ্ধ্যাভাজন যারা আছে তার কাছে আমি কৃতঘ্ন এই কারনে যে তারা আমার গান শুনে ভালবাসে।
ধন্যবাদ জানাই আমাদের কণ্ঠস্বর পরিবারের সবাইকে আমার মত নগন্য মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। যদি কখনও আপনাদের প্রয়োজনে আসতে পারি নিজেকে ধন্য মনে করবো। আপনারা যদি কোন সাংস্কৃতিক / কনসার্ট- করেন আমাকে বললে আমি আসব, যতদিন বেঁচে আছি ।ইনশায়াল্লাহ্।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সমুদ্র পাড়ে দুর্গারূপে নওশাবা
শুধু ঈদ কিংবা পূজা নয়, বিশেষ ধর্মীয় দিন উপলক্ষে ফটোশুটেবিস্তারিত পড়ুন
শুল্কমুক্ত গাড়ি খালাস করেছেন সাকিব-ফেরদৌস, পারেননি সুমনসহ অনেকে
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য আমদানি করাবিস্তারিত পড়ুন
আলোচিত নায়িকা পরীমনির পরিবার সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানতেন?
গভীর রাতে সাভারের বোট ক্লাবে গিয়ে যৌন হেনস্তা ও মারধরেরবিস্তারিত পড়ুন