মাদক পাচারে বাড়ছে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার
মাদক পাচারে দিন দিন বেড়ে চলেছে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার। বিশেষ করে ভারত থেকে চোরাই পথে ইয়াবা ও ট্রাংকুলাইজার জাতীয় নেশার দ্রব্য পাচারে শিশু-কিশোরদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সীমান্তবর্তী ১৮ জেলার ১২৩ পয়েন্ট দিয়ে দেশে আসছে মাদকের অবৈধ চালান। ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, আফিম, মদ ও ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় এমন মাদক। ১৮ জেলার মধ্যে ১৭ জেলার সঙ্গে ভারতের এবং এক জেলার সঙ্গে মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে।
এসব সীমান্ত এলাকার মধ্যে যশোরের বেনাপোল, পুটখালী, চৌগাছা, নারায়ণপুর, শার্শা, চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনা, জীবননগর, মেহেরপুরের দরিয়াপুর, বুড়িপুতা, তেহাতা ও মুজিবনগর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ দেশের অন্য সীমান্তবর্তী জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ফেনসিডিলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেড়েছে ইয়াবার চাহিদা। এ ছাড়া প্যাথেড্রিন ইনজেকশনের দাম বাড়ায় মরফিনের চাহিদাও বেড়েছে। আর এগুলো বেশির ভাগই পাচার হচ্ছে শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে।
গত ১৪ এপ্রিল বেনাপোল-যশোর মহাসড়কের আমড়াখালি বিজিবি চেকপোস্টের দায়িত্বরত সদস্যরা একটি বাস থেকে তরিকুল ইসলাম (৪২) নামে একজনকে ১৮শ পিস ইয়াবাসহ আটক করে। এ সময় তার নিজের মেয়ে পায়েলের (১০) ব্যাগ তল্লাশি করে ছোট একটি পার্সের মধ্যে আরও ১২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি।
গত ২ এপ্রিল রাতে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর এলাকার ভবারবেড় থেকে ২০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মঈন (১৮) নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশ। এর আগে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের সাদিপুর গ্রাম থেকে ৩৪ বোতল ফেনসিডিলসহ আব্দুর রহিম (১৬) নামে এক কিশোরকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।
বেনাপোল সীমান্ত থেকে ৭১ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিলসহ ইমরান হোসেন (১৫) নামে এক কিশোরকে আটক করে বিজিবি। ওই কিশোর ফেনসিডিলসহ একটি বস্তা মাথায় নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে বিজিবি সদস্যরা ধাওয়া দিয়ে তাকে আটক করে। পরে কিশোরের কাছ থেকে জানা যায়, এক ব্যক্তি বাংলাদেশ সীমান্তে ওই বস্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইমরানকে ৩০০ টাকা দেয়।
এ প্রসঙ্গে যশোরের ২৬ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহাঙ্গীর জানান, বিজিবির নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গডফাদারদের তালিকা করার জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক তথ্যমতে, যশোরের বিভিন্ন সীমান্তে দুই শতাধিক শিশু মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য এসেছে, যা কিনা ভয়াবহ।
তিনি আরও বলেন, এ সমাজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার করা হচ্ছে। শিশুদের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হলে, তার বাবাকেও আটক করার নির্দেশ দেওয়া আছে। সম্প্রতি এ ধরনের ১৭টি ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিশুর বাবা অথবা তার সঙ্গে থাকা অপরাধীকে আটক করা হয়েছে। মাদক পাচাররোধে চোরাকারবারিদের কৌশলের সাথে বিজিবির সদস্যরা পেরে উঠছেন না বলে জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহাঙ্গীর।
মাদকাসক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেনসিডিলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়াতে ইয়াবা ও প্যাথেড্রিন ইনজেকশনের বিকল্প চাহিদা মরফিনের জ্যামেতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বোতল ফেনসিডিলের দাম আট শ থেকে ১২শ টাকা। এ কারণেই ইয়াবার চাহিদা বাড়ছে।
আসলাম নামে এক মাদকাসক্ত বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় ফেনসিডিলে আসক্ত ছিলাম। এত দাম দিয়ে ফেনসিডিল কেনার সামর্থ্য অধিকাংশ আসক্তদের এখন নেই। আর তাই কেউ কেউ ইয়াবার দিকে ঝুঁকছে। কেউ বা প্যাথেড্রিনের বিকল্প মরফিন গ্রহণ করছে। মিয়ানমারে ইয়াবার দাম ৪০০ টাকার ওপর। তাও ভেজাল থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা ইয়াবার দাম ১৮০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।
যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে বি কম পাস করা মাদকাসক্ত আসলাম আরও বলেন, অনেকে আবার কাঁশির সিরাপের সাথে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে ফেনসিডিলের ফিলিংস নিচ্ছেন। এর মধ্যে শীর্ষে টুশিবা/তুশকা ও ডেক্সপোটেন সিরাপ। একটির দাম ৫৫ টাকা আর অন্যটির দাম ৮০ টাকা। এ দুটো সিরাপ বাংলাদেশে বৈধ। যেকোনো ওষুধের দোকানে চাইলেই পাওয়া যায়।
যশোর জেলা সমাজ সেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক কোহিনুর আখতার বলেন, যশোরে ১২ থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোররা আশঙ্কাজনক হারে নানা ধরনের মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। তবে যশোর জেলায় এ সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। মাদকসেবীদের অধিকাংশই ধনী পরিবারের সন্তান। তবে এ সংখ্যাটি তিনগুণেরও বেশি হবে।
তিনি আরও বলেন, যশোরে কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র আছে। কিন্তু সেখানে কন্যা শিশুদের রাখা হয় না। মাদক পাচারকালে আটক হলে তাদেরকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। জামিনে বেরিয়ে এসে এই শিশুরা ফের নেমে পড়ছে এ ব্যবসায়।
র্যাবের তথ্যানুসারে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত এক যুগে সারা দেশে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যসহ ৫৯ হাজার ২৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও ৪৪৩.৭১৭ কেজি হেরোইন, ২৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৩ বোতল ফেনসিডিল, ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ২৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ লাখ ৪০ হাজার ৩১৫ বোতল বিদেশি মদ, ২৭ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৩ লিটার দেশি মদ, ৬৬ হাজার ৩১৪.০৩৭ কেজি গাঁজা, ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫১১ ক্যান বিয়ার, ২৭ কেজি কোকেন, ২৩.২২৯ কেজি আফিম, ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯৪৪টি ভায়াগ্রা ট্যাবলেট, ৫ হাজার ৯২টি আইসপিল ট্যাবলেট, ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৯৪টি নেশা জাতীয় ইনজেকশন, ২ লাখ ৮০ হাজার ৬০৯টি সেনেগ্রা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে র্যাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক মাদকাসক্ত বলেন, ইয়াবার পাশাপাশি মরফিন ইনজেকশনেরও চাহিদা বেড়েছে। এর দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে।
বিজিবির তথ্যানুসারে, চলতি বছরে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ১০৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৭০ হাজার ৪৯ বোতল ফেনসিডিল, ৪ হাজার ৮৪৬ কেজি গাঁজা, ৮৪ হাজার ২৯৪ বোতল বিদেশি মদ, ১ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭ পিস বিভিন্ন প্রকারের উত্তেজক ট্যাবলেট, ২৩ হাজার ৩৭৪ টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন এবং ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩০ পিস বিভিন্ন প্রকারের অবৈধ ট্যাবলেট জব্দ করেছে বিজিবি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (যশোর অঞ্চল) মোহাম্মদ নাজমুল কবীর জানান, গত ৬ মাসের মধ্যে তাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। তার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, জনবলের ব্যাপক সংকট। নেই যানবাহন। একটি পিকআপ আছে। তাও বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযান চালানো একেবারেই অসম্ভব। মাদক পাচারে শিশুদের ব্যবহার বেড়েছে বলে তিনিও এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
কোকেনের সবচেয়ে বড় চালানে জড়িতদের নাম পেয়েছে ডিএনসি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান জব্দের ঘটনায়বিস্তারিত পড়ুন
শপথ করছি, মাদক ছোঁব না
মাইকে ঘোষণা হলো ‘এখন মাদকের বিরুদ্ধে আমরা শপথ নেবো’। শপথবিস্তারিত পড়ুন
ক্ষতি বছরে ১ লাখ কোটি ডলারঃ ধুমপানের পিছনে
ধুমপানে প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয় এক ট্রিলিয়ন বাবিস্তারিত পড়ুন