মার্ক জাকারবার্গ প্রতারক
ইরানি লেখক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক হোসেইন দেরাখশান। ব্লগে লেখালেখি ও বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে ২০০৮ সাল থেকে ছয় বছর জেলে ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে বের হয় তাঁর লেখা বই ‘দ্য ওয়েব উই হ্যাভ টু সেভ’। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গের সমালোচনা করে যুক্তরাজ্যের অনলাইন পত্রিকা ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসে ১০ মে এই লেখাটি লেখেন দেরাখশান।
ফেসবুকের বার্ষিক ইভেন্টে দেওয়া এক বক্তব্যে মার্ক জাকারবার্গ বলেন, কাজের কারণে তিনি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং এই বিশ্ব তাঁকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘আমি দেখছি মানুষ এবং জাতিগুলো ক্রমে অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে। সংযুক্ত এক বিশ্ব ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের ধারণা থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে।’
জাকারবার্গ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘কোনো রাগত কণ্ঠস্বর যেন আমাদের দেয়াল তুলে দিয়ে অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে যেতে বলছে।’ তার পর প্রবল ক্ষমতাশালী বিশ্বনেতার মতো সবার প্রতি তিনি আহ্বান জানান, ‘দেয়াল তৈরির বদলে আমরা সেতু তৈরির জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে পারি। এবং মানুষকে বিভক্ত করার বদলে তাদের একত্র করতে পারি।’
আমার কাছে জাকারবার্গের পুরো বক্তব্যই বিদ্রূপাত্মক মনে হয়েছে। কেন সেটা বলছি। ২০১৪ সালে আমার সাজা মওকুফ করে আমাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে আমি ছয় বছর জেলে ছিলাম ইন্টারনেটে আমার সক্রিয় কর্মকাণ্ডের জন্য। ২০০৮ সালে আমি জেলে যাই। তার আগ পর্যন্ত ইন্টারনেটে সবকিছুই ছিল ব্লগভিত্তিক। আলোচনা, সমালোচনা বা যেকোনো বিষয়ে মতামত জানানোর প্ল্যাটফর্ম ছিল ব্লগ।
ইন্টারনেটের জগতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো আবিষ্কার হচ্ছে ব্লগ। লেখালেখি ও প্রকাশনাকে গণতান্ত্রিক করেছে ব্লগিং। অন্তত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা প্রায় নিষ্ক্রিয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্যকে জোরালোভাবে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে ব্লগ। এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তারা বন্ধু, পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে একত্র করেছে। গঠনমূলক আলোচনা ও বিতর্কে উৎসাহ জুগিয়েছে ব্লগিং।
আর এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল মেধাবী ও শক্তিশালী, কিন্তু সাধারণ ও পরিমিত এক আবিষ্কারের কারণে, সেটা হচ্ছে ‘হাইপারলিংকস’। আন্ডারলাইন করা নীল রঙের ওই অক্ষরগুলোই কার্সারকে আপনার হাতে পরিণত করেছিল, যা আপনি বিশ্বের দিকে তা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ২০১৬ সালে এসে আপনাকে আরেকটা নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হচ্ছে, হাইপারলিংক বা লিংক কী বা এর ক্ষমতা কতটুকু? যাঁরা সেই সময়টা মনে করতে পারেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন।
ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব তৈরি হয়েছিল এসব লিংকের মাধ্যমে এবং লিংক ছাড়া কোনো ওয়েব দুনিয়া গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। লিংক ছাড়া ইন্টারনেটের কোনো জগৎ যদি কল্পনা করেন, তাহলে সেটা হবে খুব কেন্দ্রীভূত, একমুখী, নিষ্ক্রিয় ও অন্তর্মুখী ধরনের, যা এরই মধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। জাকারবার্গের নৈতিক বক্তৃতা এবং বহুলাংশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে এই লিংকগুলোকে ধ্বংস করার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। আর এর মাধ্যমে মুক্ত ইন্টারনেটের মৃত্যু ঘটছে এবং এর মাধ্যমে বিশ্বশান্তির সম্ভাবনাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
মার্ক জাকারবার্গ লিংকগুলোকে হত্যা করেছেন, কারণ তিনি এমন একটা জায়গা তৈরি করেছেন, যা কি-না ভবিষ্যতে ইন্টারনেট নয়, বরং টেলিভিশনের রূপ ধারণ করবে। তিনি যা প্রচার করতে চান, তা আসলে সঠিক নয়। ফেসবুক আমাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কামরায় আলাদা করে বন্দি করে ফেলছে। আমাদের আর কিছু করার দরকার নেই, শুধু বুড়ো আঙুল দিয়ে লাইক দেওয়া ছাড়া। এটাও হয়তো আর কিছুদিন পর দরকার পড়বে না, তখন চোখ স্ক্যান করেই হয়তো লাইক দেওয়া যাবে।
আমাদের টাইমলাইনে যেসব ভিডিও, ছবি বা লেখা দেখতে পাই, তার সবই আমাদের নিজেদের পছন্দ বা অভ্যাসবশত লাইক দেওয়া পেজ থেকে আসছে বা অন্যের শেয়ার দেওয়া কোনো ছবি, ভিডিও বা আর্টিকেল আমরা আবারও শেয়ার দিচ্ছি। আর এভাবেই ফেসবুক আমাদের ‘প্রেফারেন্স’ দেওয়া শিখিয়েছে। অর্থাৎ আমি নিজেই ঠিক করে দিচ্ছি, এ ধরনের জিনিসগুলোই আমি বারবার দেখতে বা পড়তে চাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা যে বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করি, সেই পেজ বা লেখাগুলোতেই লাইক দিই। এবং ফেসবুকে এমন কিছু নেই, যা আমাদের কষ্ট দেয় বা চ্যালেঞ্জ করে অথবা চমকে দেয়।
জাকারবার্গ এখন দেয়ালের জন্য বিলাপ করেন আর সেতুর প্রশংসা করেন, তার কারণ হচ্ছে, তার ফেসবুক অ্যালগরিদম কোটি কোটি আরামদায়ক বেলুন তৈরি করেছে, যা দেয়ালের চেয়েও শক্তিশালীভাবে আমাদের পৃথক করে রাখছে। সে সঙ্গে সম্ভবত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সেতু ‘হাইপারলিংক’-কে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
ব্যবহারকারীদের সারাক্ষণ ফেসবুকের আঙিনায় আটকে রাখার যে লোভ ফেসবুক-কর্মীদের, সেটাই তাঁদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দেয়। আর সে কারণেই বারবার তাঁরা ব্যবহারকারীদের ভিডিও আর নিউজ আর্টিকেল ও ছবি দিয়ে একই জায়গায় আটকে রাখার চেষ্টা করছেন।
শুধু দেশীয় ও আশপাশের কনটেন্টকেই এখন ফেসবুক আপনার সামনে হাজির করছে না, সে সঙ্গে নতুন ধরনের আইডিয়া, যেমন : ‘ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল’ বা ‘লাইভ’-এর মাধ্যমে চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব কনটেন্টকে মুক্ত ইন্টারনেটের বদলে ফেসবুকের একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। দূরবর্তী দ্বীপের মানুষগুলো সংযুক্ত করা জাকারবার্গের লক্ষ্য নয়। তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে, সবাইকে একটা বড় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে জড়ো করা, যাতে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য কেউ কোনো সেতুর খোঁজ না করে।
জাকারবার্গ আসলে যা করছেন, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে তা হলো তিনি সবাইকে বোঝাতে চাইছেন, ফেসবুক মানেই ইন্টারনেট। এবং তিনি এরই মধ্যে বেশ সফল। অর্ধেকের বেশি ভারতীয় বা ব্রাজিলিয়ান মনে করে, ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক।
আমার জন্য, যে কি না অনলাইনে সচেতনভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার জন্য ছয় বছর জেল খেটেছে, এটা হৃদয়বিদারক। যখন দেখি, মুক্ত ইন্টারনেটকে ফেসবুক শুধু একটা বিনোদন পোর্টালে পরিণত করছে, সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না।
অর্থ উপার্জনের জন্য মার্ক জাকারবার্গ মুক্ত ইন্টারনেটকে হত্যা করেছেন এবং মানুষকে সংযুক্ত করার মতো সব সেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। সেই জাকারবার্গই যখন নিষ্পাপ একটা মুখ নিয়ে দেয়াল, বিভক্তি ও অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে সচেতন করেন, এটা গভীর রাতের দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। বন্ধ সীমান্তের জন্য ওষুধ হিসেবে কাজ করতে পারত মুক্ত এই ইন্টারনেট। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গ সেটা ধ্বংস করেছেন।
ভাষান্তর : ফাহিম ইবনে সারওয়ার
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আজকের যত আয়োজন ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রে আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছেবিস্তারিত পড়ুন
মোবাইল নম্বর ঠিক রেখেই অপারেটর পরিবর্তন করা যাবে: প্রক্রিয়া শুরু
মোবাইল ফোনের নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর পরিবর্তন (মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি-এমএনপি)বিস্তারিত পড়ুন
স্মার্টফোন কিনে লাখপতি হলেন পারভেজ
নির্দিষ্ট মডেলের ওয়ালটন স্মার্টফোন কিনে পণ্য নিবন্ধন করলেই মিলছে সর্বোচ্চবিস্তারিত পড়ুন